অপরাজিত -৯
অপরাজিত - ৯
নিবেদনে সম্পাদক
"মজঃফরপুরে আমাদের উকিলদের একটি ছোট্ট আড্ডা ছিল। আমরা প্রতি শনিবার সেখানে একত্রিত হইয়া গল্প করিতাম, রাজা উজির বধ করিতাম।
১লা মে শোনা গেল মজঃফরপুর হইতে ২৪ মাইল দূরে উষা নামক স্টেশনে একটি বাঙ্গালি ছাত্রকে পুলিশ ধরিয়া আনিয়াছে। দৌড়িয়া স্টেশনে গিয়া শুনিলাম পুলিশ ছাত্রটিকে লইয়া সোজা সাহেবদের ক্লাবের বাড়িতে গিয়াছে। সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ উডম্যান তাহার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করিতেছেন।
পরদিন সকালে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ উডম্যান বাঙালি উকিলদিগকে নিজের এজলাসে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। আমাদের মধ্যে প্রবীন উকিল শ্রীযুক্ত শিবচরণ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সরকারি উকিল। তাঁর সঙ্গে আমরা ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে উপস্থিত হইয়া দেখি, কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছে একটি ১৫/১৬ বছরের প্রিয়দর্শন বালক। এতোগুলো বাঙালি উকিল দেখিয়া ছেলেটি মৃদু মৃদু হাসিতেছে। কী সুন্দর চেহারা ছেলেটির, রঙ শ্যামবর্ণ কিন্তু মুখখানি এমনই চিত্তাকর্ষক যে দেখিলেই স্নেহ করিতে ইচ্ছা করে।
উডম্যান সাহেব যখন ছেলেটির বর্ণনা পড়িয়া আমাদের শোনাইতে লাগিলেন, তখন জানিলাম ছেলেটির নাম ক্ষুদিরাম বসু, নিবাস মেদিনীপুর।
ক্ষুদিরামের বর্ণনা পড়িতে পড়িতে ক্রোধে উডম্যান সাহেবের বদন রক্তবর্ণ ও ওষ্ঠ কম্পিত হইতেছিল।
দায়রায় ক্ষুদিরামের পক্ষ সমর্থনের জন্য কালিদাসবাবুর নেতৃত্বে আমরা প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। নির্ধারিত দিনে রঙপুর হইতে দুজন উকিল এই কার্যে সহায়তা করিতে আসিলেন। একজনের নাম সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী।
এজলাস লোকারণ্য, তিন-চার জন সাক্ষীর জবানবন্দী, জেরা ও বক্তৃতা শেষ হইলে, ক্ষুদিরামের উপর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হইল।
আদেশ শুনিয়া ক্ষুদিরাম জজকে বলিল, ‘একটা কাগজ আর পেনসিল দিন, আমি বোমার চেহারাটা আঁকিয়া দেখাই। অনেকেরই ধারণাই নাই ওই বস্তুটি দেখিতে কী রকম...’
জজ ক্ষুদিরামের এ অনুরোধ রক্ষা করিলেন না।
বিরক্ত হইয়া ক্ষুদিরাম পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবলকে ধাক্কা দিয়া বলিল, ‘চলো বাইরে।’
ইহার পর আমরা হাইকোর্টে আপিল করিলাম। ক্ষীণ আশা ছিল, যদি মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। জেলে তাহাকে এ প্রস্তাব করিতেই সে অসম্মতি জানাল, বলিল ‘চিরজীবন জেলে থাকার চেয়ে মৃত্যু ভাল।’ কালিদাস বোঝাইলেন, দেশে এমন ঘটনা ঘটিতেও পারে যে তোমায় বেশিদিন জেলে থাকিতে নাও হইতে পারে। অবশেষে সে সম্মত হইল। কলকাতা হাইকোর্টের আপিলে প্রবীন উকিল শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রনাথ বসু হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা দিলেন। কিন্তু ফাঁসির হুকুম বহাল রহিল।
১১ আগস্ট ফাঁসির দিন ধার্য হইল।
আমরা দরখাস্ত দিলাম যে ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকিব। উডম্যান সাহেব আদেশ দিলেন দুইজন মাত্র বাঙালি ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকিতে পারিবে। আর শব বহনের জন্য ১২ জন এবং শবের অনুগমনের জন্য ১২ জন থাকিতে পারিবে। ইহারা কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়া শ্মশানে যাইবে। ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকিবার জন্য আমি ও ক্ষেত্রনাথ বন্দোপাধ্যায় উকিলের অনুমতি পাইলাম। আমি তখন বেঙ্গলি কাগজের স্থানীয় সংবাদদাতা। ভোর ছ’টায় ফাঁসি হইবে। পাঁচটার সময় আমি গাড়ির মাথায় খাটিয়াখানি ও সৎকারের অত্যাবশ্যকীয় বস্ত্রাদি লইয়া জেলের ফটকে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, নিকটবর্তী রাস্তা লোকারণ্য। সহজেই আমরা জেলের ভিতরে প্রবেশ করিলাম।
ঢুকিতেই একজন পুলিশ কর্মচারী প্রশ্ন করিলেন, বেঙ্গলি কাগজের সংবাদদাতা কে?
আমি উত্তর দিলে হাসিয়া বলিল, আচ্ছা ভিতরে যান।
দ্বিতীয় লোহার দ্বার উন্মুক্ত হইলে আমরা জেলের আঙ্গিনায় প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম ডানদিকে একটু দূরে প্রায় ১৫ ফুট উঁচুতে ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে দুই খুঁটি আর একটি মোটা লোহার রড যা আড়াআড়িভাবে যুক্ত তারই মধ্যখানে বাঁধা মোটা একগাছি দড়ি ঝুলিয়া আছে। তাহার শেষ প্রান্তে একটি ফাঁস।
একটু অগ্রসর হইতে দেখিলাম ক্ষুদিরামকে লইয়া আসিতেছে চারজন পুলিশ। কথাটা ঠিক বলা হইল না। ক্ষুদিরামই আগে আগে অগ্রসর হইয়া যেন সিপাহীদের টানিয়া আনিতেছে। আমাদের দেখিয়া একটু হাসিল। স্নান সমাপন করিয়া আসিয়াছিল। মঞ্চে উপস্থিত হইলে তাহার হাত দুইখানি পিছন দিকে আনিয়া রজ্জুবদ্ধ করা হল। একটি সবুজ রঙের টুপি দিয়া তাহার গ্রীবামূল পর্যন্ত ঢাকিয়া দিয়া ফাঁসি লাগাইয়া দেওয়া হইল। ক্ষুদিরাম সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এদিক ওদিক একটুও নড়িল না।
উডম্যান সাহেব ঘড়ি দেখিয়া একটি রুমাল উড়াইয়া দিলেন।
একটি প্রহরী মঞ্চের একপ্রান্তে অবস্থিত একটি হ্যান্ডেল টানিয়া দিল।
ক্ষুদিরাম নিচে অদৃশ্য হইয়া গেল।
কেবল কয়েক সেকেন্ড ধরিয়া উপরের দিকের দড়িটা একটু নড়িতে লাগিল।
তারপর সব স্থির।
কর্তৃপক্ষের আদেশে আমরা নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়া শ্মশানে চলিতে লাগিলাম। রাস্তার দুপাশে কিছু দূর অন্তর পুলিশ প্রহরী দাঁড়াইয়া আছে। তাহাদের পশ্চাতে শহরের অগণিত লোক ভিড় করিয়া আছে। অনেকে শবের উপর ফুল দিয়া গেল। শ্মশানেও অনেক ফুল আসিতে লাগিল। চিতারোহণের আগে স্নান করাইতে মৃতদেহ বসাইতে গিয়া দেখি মস্তকটি মেরুদণ্ড চ্যুত হইয়া বুকের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে। দুঃখে–বেদনায়–ক্রোধে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মাথাটি ধরিয়া রাখিলাম। বন্ধুগণ স্নান শেষ করাইলেন তারপর চিতায় শোয়ানো হইলে রাশিকৃত ফুল দিয়া মৃতদেহ সম্পূর্ণ ঢাকিয়া দেওয়া হইল। কেবল উহার হাস্যজ্বল মুখখানা অনাবৃত রহিল।
দেহটি ভস্মিভূত হইতে বেশি সময় লাগিল না। চিতার আগুন নিভাইতে গিয়া প্রথম কলসি ভরা জল ঢালিতেই তপ্ত ভস্মরাশির খানিকটা আমার বক্ষস্থলে আসিয়া পড়িল। তাহার জন্য জ্বালা যন্ত্রণা বোধ করিবার মতন মনের অবস্থা তখন ছিল না। আমরা শ্মশান বন্ধুগণ স্নান করিতে নদীতে নামিয়া গেলে পুলিশ প্রহরীগণ চলিয়া গেল। আর আমরা সমস্বরে ‘বন্দেমাতরম’ বলিয়া মনের ভার খানিকটা লঘু করিয়া যে যাহার বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম। সঙ্গে লইয়া আসিলাম একটি টিনের কৌটায় কিছুটা চিতাভস্ম, কালিদাসবাবুর জন্য। ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলায় সে পবিত্র ভস্মাধার কোথায় হারাইয়া গিয়াছে ।"
----- বাঙলা কাগজের সংবাদদাতা ও উকিল উপেন্দ্রনাথ বসু ; ক্ষুদিরাম বসু ফাঁসি প্রসঙ্গে
সম্পাদকীয়
"Freedom" প্রবন্ধটিতে জর্জ বার্নাড শ বলেছিলেন, "What is a perfectly free person? Evidently a person who can do what he like,when he likes, and where is likes, or do nothing at all if he prefers it." এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা তাহলে কি স্বাধীনতা বলতে এটাই বুঝি, না আমাদের কাছে স্বাধীনতা মানে শুধুই ভোটাধিকার। যদি আমাদের দেশ ভারতবর্ষের কথায় বলি,1947 সালের 15 ই আগষ্ট থেকে আজকের 2020, স্বাধীনতার এতগুলি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে,কিন্তু আজও কি চিন্তায়,মননে,আদর্শ ও নীতিতে পূর্ণাঙ্গ রুপে স্বাধীন হতে পেরেছি আমরা? আধুনিক এই ভারতে আমরা সত্যিই কি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পেরেছি, সত্যিই কি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সেই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ আমাদের মননে দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছে? নাকি তা আজও শুধুই ইতিহাস হয়ে রয়ে গেছে,যা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের একটি পাথেয় মাত্র। যাক সে কথা,আজকের আলোচনায় প্রবেশ করি। 1700 খ্রিষ্টাব্দের অনেক আগের কথা,আমাদের দেশ ভারতবর্ষ তখন ব্যবসা,বানিজ্য,শিক্ষা,সম্পদ সবক্ষেত্রেই বিশ্বের অনান্য দেশগুলির থেকে বহুঅংশে এগিয়ে ছিল। আমরা জানি,মানুষের অচেনাকে চেনার ও অজানা কে জানার তাগিদ সৃষ্টির সময় থেকেই।তাই সেই উদ্দেশ্য কে মাথায় রেখেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কিছু অনুসন্ধানকারী নাবিক পাড়ি জমাল জলপথে। এরকমভাবেই প্রায় 522 বছর আগে যখন ইতালীয় নাবিক ভাস্কো-দা-গামা পৌঁছে গেছিল কলিকটের বন্দরে,তখন থেকেই ইউরোপিয়ানদের নিয়ত আসা যাওয়া লেগেই থাকত এই উপকূলবর্তী দেশগুলিতে। হঠাৎই এক বিট্রিশ ঔপনিবেশিক দল, ছলচাতুরির বলে মোঘল সম্রাট ফারুকশিয়ারের কাছে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার অনুমতি নিয়ে, সুরাটে তাদের অধিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করল, নাম 'ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি'। ব্যবসার খাতিরে নানাবিধ উপটৌকন ও তোষামোদের দ্বারা একে একে ঘাটি বিস্তারে সক্ষম হল,খুলল নানান ফ্যাক্টরি মাদ্রাজ(বর্তমান চেন্নাই), বোম্বাই(মুম্বাই), কলিকাতা(কলকাতা) নগরীতে। ক্রমশ বাড়তে লাগল ফ্যাক্টরির সংখ্যা,সাথে সাথে ইস্টইন্ডিয়া কম্পানির ক্ষমতা বিস্তার। শুধুমাত্র কূটনীতির দ্বারা কবে ব্যবসা ছেড়ে ভারতের রাজনীতিতে তাদের অণুপ্রবেশ ঘটে গেল টের পেলনা কেউই। 1750 সালের পর থেকেই আক্রমনাত্মক হয়ে উঠল এই 'ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি'। 1757 এর সেই বিখ্যাত 'পলাশীর যুদ্ধ', নিছকই ব্যবসা করতে আসা একটি কম্পানি পরাজিত করল বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাকে, স্থাপিত হল বিট্রিশ রাজ আর ভারত মায়ের চরণে পড়ল পরাধীনতার শৃঙ্খল। সময় গড়ালো,শুরু হল ভারতীয়দের প্রতি নির্মম অত্যাচার,লুঠপাঠ ও নানান পৈশাচিক ব্যবহার। ক্রমশ নামতে শুরু করল শিক্ষার হার,উৎপাদন কমল। ভারতবর্ষ যা ছিল তৎকালীন বিশ্বের ধনীদেশগুলির মধ্যে অন্যতম, তার 90 শতাংশ জনগন দ্রারিদ্যসীমার নীচে নামতে শুরু করল। শুরু হল এক অন্ধকার যুগের। অবশেষে এইসব অকথ্য অত্যাচারে অনিষ্ঠ হয়েই ভারতবাসী শুরু করল স্বাধীনতা ফিরে পাবার লড়াই,ভারত মায়ের হারানো গৌরব-মর্যাদাকে ফিরিয়ে দেবার লড়াই,নিজেদের প্রাপ্য অধিকারকে পুনরায় বুঝে নেবার লড়াই।ভারত মায়ের কোল রক্তেরাঙা হল, শেষ হল ঘাত প্রতিঘাতের লড়াই। অবশেষে ভারতবর্ষ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হল কিন্তু গায়ে চড়ল দেশভাগের ক্ষত। ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল মহাত্মা গান্ধী,আলিজিন্না,জওহরলাল নেহেরু,বল্লভ ভাই প্যাটেল,ভগৎ সিং প্রমুখ দের নাম। কিন্তু জানাগেল না, ব্রিটিশদের রক্তচক্ষুর সন্মুখে দাঁড়িয়ে যিনি বলতে সাহস করেছিলেন, "তোমরা আমাকে রক্ত দাও,আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।"; হ্যাঁ বীর সুভাষচন্দ্র বোস ওরফে নেতাজী,একজন বাঙালী যার অর্ন্তধান রহস্য আজও উদ্ঘাটন হলো না। বাঙালী বঞ্চিত হল সর্বক্ষেত্রে। আজ আমরা তাই স্মরণ করব ভারতমায়ের সেইসব বীর সন্তানদের,যাদের ইতিহাস হয়তো স্থান দেয়নি, দু-একজন ছাড়া যাদের অবদান কেও মনে রাখেনি, সেইসব বাঙালীদের। যারা শেখাল অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষ না করে,অহিংসা নীতিকে পরিত্যাগ করে সরাসরি আক্রমনের ভাষা।ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল পরাক্রমশালী ব্রিটিশদের, বুঝিয়ে দিয়েছিল এবার তাদের পরাজয় স্বীকার করতেই হবে। মনে পড়ে হে আমার দেশবাসি, সেদিনের সেই ভয় ডর হীন যুবক ক্ষুদিরাম বসুর কথা; যে নিদ্বির্ধায় ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ল একমুখ অকৃত্রিম হাসি নিয়ে, গানের সুরে,ভারতমায়ের বন্দনাগীতিতে- "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি"। মনে পড়ে হে আমার ভারতবাসী ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত "গান্ধিবুড়ি" র আত্মত্যাগের কথা, মনে পড়ে তাঁর সেই অদম্য জেদের কথা। বয়সের তোয়াক্কা না করে, আন্দোলনের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে পুলিশের গুলিতে বুক পেতে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল যাঁর দেহ তবুও মুঠোর মধ্যে শক্ত হাতে উঁচিয়ে রাখা পতাকা আর মাঠ,ঘাট,প্রকৃতিকে কাঁপিয়ে সেই "বন্দেমাতরম্" ধ্বনি;বজ্রনিনাদের থেকে কমকিছু ছিল না। মাষ্টার দা সূর্যসেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন কিংবা বিনয়-বাদল-দিনেশের সেই আত্মবলিদান তোমরা কি ভুলে গেছো? তোমরা ভুলে গেছো, 1905 থেকে 1911 বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দেশপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথের কথা, ভুলে গেছো জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে নির্দ্বিধায় ব্রিটিশ দের দেওয়া "নাইট" উপাধি পরিত্যাগের কথা। বাংলা কে বিভক্ত করতে তিনি দেননি, একে অপরের হাতে রাখি বাঁধার মধ্য দিয়ে মানবতা, সৌভাতৃত্ব কে বজায় রাখার দায়িত্ব যিনি নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন। মনে পড়ে হে আমার দেশবাসী বিপ্লবী রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ীর কথা। যাঁর তত্ত্বাবধানে একদল বিপ্লবী 1925 সালের 7 ই আগষ্ট কাকরি স্টেশনে ট্রেন দাঁড় করিয়ে ইংরেজদের খাজনা লুঠ করতে সাহস দেখিয়েছিল। মৃত্যু অবশম্ভাবি জেনেও যিনি দৃঢ়তার সাথে বলতে পেরেছিলেন,দেখেছিলেন স্বপ্ন- " পুর্নজন্মে বিশ্বাস করি,পরের জন্মে দেশ স্বাধীন করবই।" স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অন্যতম যোদ্ধা ও গুপ্তচর বিপ্লবী তৈলক্যনাথ চক্রবর্তীর কথা নিশ্চয় মনে আছে। যিনি কখনও হত্যা,কখনও বরিশাল ষড়যন্ত্র,ঢাকা ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে রাজাবাজার বোমা হামলা এরকম নানান বিষয়ে জড়িয়ে 1946 সাল পর্যন্ত জীবনের মূল্যবান 30 টি বছর কারাগারের ওই অন্ধকার কূটিরে কাটিয়ে দিলেন শত অত্যাচার সহ্য করে। বলো এই আত্মত্যাগ কি তুমি ভুলে যাবে? বলো তুমি কি ভুলে যাবে কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের আত্মবলিদান,যিনি ব্রিটিশদের হাতে গ্রেফতার হওয়া প্রথম ভারতীয় মহিলা। বলো হে বীর,ভুলে যাবে গুনধর হাজরার ভারতকে স্বাধীন করবার সেই অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষাগ্রহনের কথা। তবুও আমরা হয়তো কোনোদিন ভুলে যাব বাঙালীর এই আত্মত্যাগের চিরন্তন সত্যের গল্প, মেতে উঠব শুধুমাত্র একটি বিশেষ দিনের কথা ভেবে, আর তেরঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে গায়ব 52 সেকেন্ডের জাতীয় সংগীত- "জনগনমন অধিনায়ক জয় হে,ভারত ভাগ্যবিধাতা..."
~ সুমন ঘোষ।
কভার কাহিনি
দুশো বছর পরে উড়লো আমাদের তিরঙ্গা।আর চলবো না কারোর শাসনে, মানবোনা কোনো নিষেধ,আজ আমরা চলবো আপন পথে।
তাহলে বলি শোনো, এইতো সেদিন দেখলাম তথাকথিত প্রেমিক তার ভাড়া করা প্রেমিকাকে বলছে,"আমি কি বলেছিলাম ওর সাথে কথা বলতে ?কেন বলো?আমি থাকতে আর কাকে লাগে তোমার?"
মা বাবার আদরের মেয়ে একটা গরীব শিক্ষিত মানুষকে ভালোবেসেছে,না..ডিগ্রিধারী শিক্ষিত নয় তো!মা বাবা চাননা সম্পর্ক পরিণতি পাক,আজকে মেয়েকে পরিবারের কাছে সন্দেহের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
মেয়েটি সন্ধ্যাবেলা টিউশন পড়ে বাড়ি ফেরার সময় রেপ হয়ে গেলো,প্রশ্ন উঠলো কেন বাবা আনতে যায়নি একা ফিরছিল মেয়েটি?কেমন বাড়ির লোক! মেয়েটি নাহয় পড়ে বাড়ি ফিরছিল কিন্তু ছেলেটি অন্ধকার রাস্তায় কি করছিল?বাড়ির লোক কি মেয়ের থাকে শুধু?
অনেককে বলতে শুনি মেয়েদের একটা গণ্ডির মধ্যে রাখাই ভালো, ছেলে তো সোনা! সোনার আংটি আবার বাঁকা!ছেলেদের কি মানুষ করে তুলতে নেই?
এখন অনককে বলতে শুনে ভালো লাগে যে ছেলেদের কাঁদা বরণ কে বলেছে?আর কেনই বা বলবে?ওদের মনে কষ্ট হয়না বুঝি কখনোই? নাকি কাঁদার অধিকার শুধুই মেয়েদের আছে!কাছে গেলে বুঝবেন অনেকক্ষেত্রে মেয়েদের থেকে ছেলেরা সাহায্যের হাত বাড়ায় বেশি।
মাধ্যমিকের পর আমার এক বন্ধুর বাবা বন্ধুকে জোড় করলেন সাইন্স তাকে নিতেই হবে,বন্ধুটি কি চায় তার দিকটা হয়তো অজানাই ছিল। টুয়েলভে টেস্টের সময় আমার বন্ধুটি আত্মহত্যা করে ডিপ্রেশনে!বাবার মুখের ওপর আর কিছু বলতে পারেনি।।যদিও বন্ধুটির বাবা আজ পৃথিবীতে নেই!
এখনো এই সময়ে দাঁড়িয়েও অনেক জায়গায় শুনেছি, ইস্! ওরা নিচুজাতের,ওদের ঘরে বসে কেও জল খায়?ওদের বাচ্চাকে কে কোলে নেয়?
ওই দুশো বছরে রেল স্থাপন হয়েছে, হাওড়া ব্রিজ তৈরি হয়েছে, আরো অনেক কাজ যেগুলো হয়তো ইংরেজ শাসক নিজেদের স্বার্থে করেছে কিন্তু আখেরে লাভ আমাদেরই হয়েছে। মেয়েদের শিক্ষারও অগ্রগতি ঘটিয়েছিল ইংরেজ শাসন। খারাপের মধ্যেও ভালো থাকে, সেটা বাছতে জানতে হয়। না, আমি ওই পরাধীনতার বর্বর জীবনকে কখনোই সমর্থন করছিনা, আমি সুভাষের দেশের সন্তান, আমি নিজেদের স্বতন্ত্রতায় বিশ্বাসী।ঠিক এই বিষয়টাই আমাদের বিব্রত করে তোলে,কি বলতে চাই এটা নাকি ওটা? কোনটা আসল কোনটা নকল,কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। তাই যতক্ষণ না জ্ঞান অর্জন নিজের জীবনে প্রভাব ফেলবে ততক্ষণ আমাদের জীবনে স্বাধীনতা পা রাখতে পারবে না।
নিজের জীবনের পরিধি বুঝতে চেষ্টা করো।না উপদেশ দিচ্ছিনা,আমি দেখেছি মানুষকে,সময় থাকতে মূল্যবোধ জাগেনা। রাজনীতির বুলি আওড়ায় শুধু। কাছে যারা আছে তাদেরকেও বাঁচতে দাও আর নিজেও বাঁচো।প্রাণ খুলে বলো স্বাধীন দেশে স্বাধীন আমরা। আমার বয়স বেশি না,এগুলো আমার পরিচিত গুরুজনেরা পড়লে বলবেন বাব্বা!কথা শিখেছে খানিক,তোরা মা বাবার জ্বালা কি বুঝবি?মা বাবার সন্তানকে প্রয়োজন আর সন্তানদেরও মা বাবাকে প্রয়োজন,কেউই কাওকে ছাপিয়ে যায়না।তফাৎ শুধু সময়ের।
কেবল বাইরের দিকটা স্বাধীন কিনা তুমি খালি চোখে দেখতে পাবে না! বিন্দু বিন্দু দিয়ে যেমন সিন্ধু হয় তেমনি স্বাধীনতা একতরফা কেনা যায়না,এতে সবাই সমান ভাগিদার।
নিজের অধীনে চলাই স্ব - অধীনতা।আমরা দেশ দেখি,আমরা সমাজ দেখি,আমরা অন্য মানুষকে দেখি,কিন্তু কখনো নিজেকে দেখি?বিচার করি?কি চাই, কেন চাই, কতদূর চাওয়ার পরিধি এগুলো নিয়ে খুব কম মানুষ ভাবে। হয়তো মানুষ ভাবে কেও কোনো কাজে পারমিশন দিচ্ছেনা তাতে তার স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে, তা খানিক হচ্ছে বৈকি! কিন্তু নিজের ভিতরে মনের গভীরে ডুবে কখনো দেখেছো যে সেখানে কি পঙ্কিল জলাশয় আছে? স্ব-এর অধীনে ভাবনা চলে তো তোমার নিজের???নাকি শুধু স্বাধীনতা চেয়ে বেড়াচ্ছো?রাত্রে শোবার আগে নিজেকে প্রশ্ন করো নিজের অধীনে তোমার মন থাকে নাকি অন্যের কথায় উঠছে বসছে?আর নিজের কথায় চলছে মানে তুমি কারোর জীবনে মিসাইল ফাটানোর কথা ভাবছো সেটা সফল করতে চাও তেমন বিষয়ে পক্ষপাতিত্ব করে জাল সার্টিফিকেট দিচ্ছিনা।আমি বলছি এই মন এদিক ওদিক যায়,অন্যের জীবনে হস্তক্ষেপ করে এগুলোকে স্বাধীনতা বলতে আমি চাইনা। কিন্তু অন্যের কু মন্ত্রণা শুনে নিজের জীবনে পদক্ষেপ নেওয়া মানুষটা কি স্বাধীন? যে অন্যের জীবনকে নিজের মতো করে চালনা করতে চায় সেই মানুষ কি স্বাধীন? যেই মানুষ সন্দেহের গন্ধে সর্বদা দমবন্ধ করে কাছের মানুষকে বিশ্বাস না করে দূরে সরিয়ে দেয় সেই মানুষ কি স্বাধীন?নিজের সন্তানের ওপরেও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে স্বাধীনতায় পতাকা ওড়ানো যায়?দেশের খেয়ে দেশের উপজাতিকে হেয় করে নিজেদের জাতের বড়াই করেও লোক স্বাধীন বুঝি?
স্বাধীনতা স্বাধীন হোক
~ বর্ণালী
আলোচনা ১
শিশু ও শৈশব
~সন্দীপ দাস
এক চিলতে রোদ্দুর সকালের আকাশে । মেঘমুক্ত , দূষণমুক্ত মন । একটি স্বচ্ছ কাঁচ । এই সময়টাকেই শৈশব বলা হয় । শিশু মনস্তত্ব বুঝতে গেলে মানুষ জীবনের এই সময় কালকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে । আর তার জন্য যেটা সবথেকে বেশি প্রয়োজন সেটি হল নিজেকে শিশু করে তোলা । এখন আপনারা নিশ্চই ভাববেন শিং ভেঙে বাছুরের দলে কিভাবে নাম লেখাই ? না না সেটা করতে হবে না । শুধু যুক্তি তর্ক বাদ দিয়ে ওদের কাজ কর্মগুলো অনুসরণ করুন । দেখবেন ওই সময়টাকে নিজের মধ্যে আবার ফিরে পেয়ে গেছেন ।
আমি কিছু উপমার মধ্যে দিয়ে শিশু অবস্থার বর্ণনা দেবো । আশা করি তোমাদের বুঝতে খুব সুবিধে হবে ---
১. শিশু মন একটি ফাঁকা পাতার মতন । সেখানে আপনি যা লিখবেন , শিশুটিও তাই শিখবে । এবার বেশ কিছু ঘটনা ভেবে দেখা যাক । যখন মোবাইল এত জনপ্রিয় ছিল না , তখন শিশুরা ছোটবেলা থেকে মোবাইল পেতো না হাতের সামনে । কিন্তু ফুটবল পেতো , বই পেতো , ক্রিকেট ব্যাট পেতো । ফলে তারা বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় বই পড়া , খেলাধুলা করার নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়তো । মাঠ মুখি ছিল সে যুগের শৈশব । আবার ঘরে ঘরে টেলিভিশন পেতো কিন্তু কেবল টিভি পেতো না । ফলে ওই দুরদর্শনের মধ্যেই ডুবে যেত ওরা । এর থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার বলা যায় মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে যে জিনিসটি হাতের সামনে পায় , তাই দিয়েই তারা তাদের চরিত্র বপন করে । শৈশবের এই গুনটির মধ্যে দিয়ে আপনিও নিজেকে গড়ে তুলতে পারেন । নিজের মোবাইল , টেলিভিশন থেকে সরে কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠুন । সে কাজ আপনার অফিসের হোক বা বাড়ির । দেখবেন আপনাদের হাত ধরেই কর্ম সংস্কৃতি আবার ফিরে আসবে ।
২. এবার একটা পরিবারের কথা ভাবুন যেখানে বাবা বা মা সিগারেট খায় , মদ পান করে বাড়ি ফেরে , অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলে । সেই বাড়ির শিশুটি তাদের দেখে কি শিখবে ? সেও সিগারেট , মদ এসব কেই নিজের নেশা বানিয়ে বড় হয়ে উঠবে , তাই না ?
৩. শিশুরা অন্যদের অনুকরণ করে থাকে । তাই তার সামনে ভাল ভাল কাজ করুন । দেখবেন আস্তে আস্তে তারাও আপনাদের অনুকরণ করছে । যেমন ধরুন আপনি স্বপরিবারে ঘুরতে যান প্রায়ই । বাড়ির শিশুটিও ভ্রমন পিপাসু হয়ে উঠবে । এবার আপনি ঘুরতে গিয়ে প্রকৃতি কে নিজে অনুভব করার অভ্যাস করেন ও শিশুটিকেও সেই বিষয়ে সেখান , দেখবেন শিশুটি কি সুন্দর প্রকৃতিকে অনুভব করতে শিখে নেবে ।
৪. শিশুরা বিশ্বাস করে সকলকে । আপনি যখন কোন মন্দিরে গিয়ে শিশুটিকে নমো করতে বলেন । তখন শিশুটি আপনাকে প্রশ্ন পর্যন্ত করবে না , কেন করতে বলছেন আপনি । সে জাস্ট আপনাকে বিশ্বাস করে নমো করবে । এই বিশ্বাস ব্যাপারটা আজ আমাদের মধ্যে বড্ড অভাব । কথায় আছে , বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু ; তর্কে বহুদূর । তবু আমরা এই তর্কের মধ্যেই নিজেদের জড়িয়ে রেখেছি অনন্তকাল ধরে । শিশুদের মধ্যে থেকে এই বিশ্বাস মানুষের মধ্যে হিংসা রেষারেষি বন্ধ করতে পারে ।
সুতরাং , শিশু মানসিকতা আমাদের মধ্যেও বিস্তারের কতটা প্রয়োজন রয়েছে দেখা গেল । এর উপরে প্রতিটা বাবা মা র নৈতিক কর্তব্য হয় শিশুদের সঠিক জিনিস শেখানো । ভুল শেখালে তার প্রভাব শিশুর মধ্যে ভুল ভাবে পড়তে পারে । শিশুটি অন্য কাজের মধ্যে দিয়ে সমাজের ক্ষতি করতে পারে । কাজটি যদিও আলাদা কিন্তু শিক্ষা কিন্তু সেই অতীতের পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা । শিশুদের স্বার্থহীন হতে সেখান । শুধুমাত্র নিজের কথা ভাবা অভ্যাস করালে শিশু নিজের উন্নতি নিয়ে এতটাই ভাবতে শুরু করবে যে একদিন সে আপনাকেও ভুলে যাবে ।
সময় খুবই কম আর শিশুকে ভবিষ্যৎ সমাজের প্রতিনিধি আপনিই গড়ে তুলতে পারেন । এবার সিদ্ধান্ত আপনার হাতে ।
দীর্ঘ কবিতা
তোমার সংসারে আমি
~ বিকাশ দাস ( মুম্বাই )
তোমার কাজের মাসি কিছু না বলে হঠাৎ উধাও হলে,
তুমি রাগে গন গন।
তোমার চলা ফেরায় শুকনো লঙ্কার ঝাঁস, যদিও সাময়িক ঝনত্কার।
তবুও নিতে ভোলো না তুমি লতা মাসির খবর,
ওর মাতাল বর করলো না তো মারধর,
না কি বাড়লো দুম করে আবার ছেলেটার জ্বর ... ইত্যাদি।
মাথার ভেতর হাজার প্রশ্নের জমাট ভিড় তোমার পিছু পিছু ঘুরতে থাকে অবান্তর।
মাসি ফিরে এলেই ঠিক ঠাক জবাব কৈফিয়েত না পেলে রাগে বলে ফেলো :
এবার কাজে ফাঁকি দিলে তোর মাইনে কাটবো দেখে নিস, বলেই ...
তোমার ঠোঁটে এক চিলতে শুভ্র হাসির ঝিল। মাসিও জানে তোমার দরাজ দিল।
তোমার শরীর খারাপ, তাসত্তেও হয়না ভুল তোমার।
একগাদা কাপড় চোপড় কাচতে, এঁটো বাসন কোসন ধুয়ে রাখতে,
সন্ধ্যে সকাল বাড়ি উঠোন পরিষ্কার করে এলো চুল বাঁধতে,
আবার দু’হাতে সলতে পাকাতে, ফুলের আলপনায় পূজোর আসন সাজাতে,
ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সময়ে সন্ধেবাতি রাখতে। ছড়াতে ঘরের ভেতর বাহির সন্ধ্যা-সাঁজাল।
সময় করে আবার ফ্রিজে জল রাখতে,বেডকভার টান টান, সোফার কুশন ঠিক রাখতে, আনচান।
সবকিছু পরিপাটি না হলে, তোমায় খুঁত খুঁতানি চেপে ধরে তোমার সর্বাঙ্গ অস্থিরতায়।
তোমার শরীর সাতসতেরো ঝামেলা ঝিমানো কাঁটায়, তোমার চাউনি রা কাড়ে না কোনো ঝাপটায় ।
যেদিন তোমার নিরামিশী, আমাদের জন্য একটা না একটা আমিষপদ ভোলো না রাঁধতে ।
তোমার উপোস দিনে সবার খাবারের ভুল করো না আয়োজন রাখতে ।
সময় করে আন্তীয় পরিজনের নিয়ম মাফিক খোঁজ খবর প্রযত্নে রাখা ।
ছোটো বড়ো সকলের সুখ দুখ এ সামিল থাকা।
কক্ষনো ভুল কর না সম্পর্কগুলো অবাধে জোর রাখতে অজুহাতের জটিলতায়।
কোন তিথি পূর্নিমা,অমাবশ্যা, পুজো পার্বণ , পাঁজির বিবরণ তোমার নখদর্পণে।
সঙ্গে সব ষষ্টীর খেয়াল রাখা।
কোনো কিছুর ভুল ত্রুটির খামতি থাকে না। সব খুঁটিনাটির দিকে তোমার কড়া নজর।
রোজকার বাজার তুমি একাই সারো নিজের হাতে, আমার হাত খুব পাতলা, হিসেব হীন বলে।
রোজ এতো ভিড়ের মুখে আমার এলানো শরীর তোমার দু’হাতের স্পর্শের
আড়ালে আমার ঘুম জাগানো ।
উষ্ণ গরম চা আমার অলস হাতে বাড়ানো। আমার স্নান সারা হলেই ,
ইস্ত্রির পাট করা জামা কাপড় আমার হাতের নাগালে রাখা,
অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি সাজিয়ে তোলা,
আমার রুমাল,চশমা,মোবাইল,বটুয়া একে একে এগিয়ে রাখা।
তোমার আলতো হাতে নধর চোখে মুখশুদ্ধি পরিবেশন।
নিজের হাতে আতরের ইষৎ ফোঁটায় আমার শরীর ভিজিয়ে,
সদর দরজা অবধি তোমার আসা।
দু’হাত নাড়িয়ে প্রতিশ্রুতির প্রতিবেদন নিঃশব্দে জানানো
তোমার আধুত ঠোঁটের বিড়বিড়ানি... দুগগা দুগগা দুগগা।
কিন্তু ঘরে প্রবেশ বাইরে জুতো খুলেই, জুতোর প্রবেশ বারণ ঘরের ভেতর।
কখন ঠেকায় আমার হাত টানের সংসার ছিলো বিক্ষত,
লেগেছিলো পরিস্তিতির বর্গায় জোরুল আর চুনখসার আপদ।
এ সবের অভিযোগ বা সিকায়াত রাখোনি কোনদিনই তোমার কাছছাড়া।
বলোনি গলা বাড়িয়ে।
খুচ খাচ সঞ্চয়ের কৌটো থেকে ঠিক সময় ধারের কিস্তি
শোধ দিয়েছো অভাবের কাঠে আগুন নিভিয়ে ।
রোজকার রূপচর্চা,পরচর্চা বালাই তোমার অভিধানে বাতিল ও অরুচি।
বলো খামোকা উড়ান আদ্দিখেতামী ।
প্রতিদিনের অসংযত কাজের ফাঁকে, টবের মাটি কাটা, ফুল গাছে জল।
স্নান সারা। পুজো আর্চা। তুলসীর মূলে জল ঘোরানো,
মাথা ঠেকানো।সংসারের মঙ্গল চাওয়া টুকু একমাত্র তোমার কাম্য।
মধ্য দুপরের স্তব্ধতা আঁচড় কাটে তোমার শরীরে সারাদিনের ব্যস্ত জ্বালার আঘাত সারাতে।
রবিবার তোমাকে বেশি করে দেখার ইচ্ছে চোখে রাখি ধরে
সকালে কাছে পাওয়া বেশি করে, স্নানের পর ভিজে কাপড়ে
চুলের জল ঝাপটানো, জলের ছিটে আমার গায়ে লাগানো। এ সুখ পাড়া পড়শীর ঈর্ষা।
ঠোঁট ভিজিয়ে গুন গুন গান গাওয়া, হাত যখন কাজ গুছনোতে ব্যস্ত তোমার।
চুপ চাপ কান পেতে শোনা। আচমকা গা জড়ানো।
তোমার লজ্জার ঠেলায় গা ভাসানো।
ফিরতে আমার রোজ দেরী হয়।
জেনো ও সন্ধ্যে নামলে কাছের দূরত্বকে আরো কাছে টানার অভিসারের চঞ্চলতায়;
দু’চোখ তোমার সজাগ রাখো এ জানালা ও জানালার পর্দায়।
অথচ ভুল হয় না তোমার
গরম ভাত বা গরম ফুলকো রুটি বেড়ে দিতে।
অন্তিমে গরম দুধ খাওযার পীড়াপিড়ি তোমার।
গোঁসা হলেও আমার বুক জুড়াতো তোমার ভালোবাসার নিবীড় একান্তে।
একভাবে বসে তোমার দু’চোখ আমার খবর নিতো।
দুপুরে কি খেলাম, কাজের চাপ কমলো কি না, হাঁটুর ব্যথা কম আছে কি না,
ওর খোঁজ পেলে কি না, আরো অনেক কিছুর খোঁজ গোঁজা থাকতো তোমার আঙুলে।
প্রশ্নের কাঁটা ক্ষনিকের জ্বালা হলেও এ’জ্বালা ভালোবাসার চিরকালীন।
শোবার আগে আমার বাকি ওষুধ এগিয়ে দিতে সঙ্গে জলের গ্লাস।
আবছা আলোর সন্দিক্ষনের শিহরন অগোচরে।
তোমার দু’চোখের নীরব সরব সাক্ষাত্কারে, আমার সারা শরীরে বর্ষা নামতো।
সারাদিনের ঝক্কি ক্লান্তির জ্বর কুল পেতো, এসে তোমার আচঁলে।
আকাশের বিছানায় চাঁদ তখন ঘুমিয়ে পড়ে আলোর মশারিতে;
পাশাপাশি শুই পরস্পর কে ছুঁয়ে, আমার উতপ্ত শরীর শীতাপিত।
এত কিছুর পরও...
আমার সোয়াস্তির দরজায় তোমার দু’চোখ জাগিয়ে রাখো
যাতে এক চুল ব্যাঘাত না ঘটে আমার নিশিন্ত ঘুমের।
ধন্য তুমি ধন্য
হঠাৎ দেখি কাক ভোরের আলোতে তোমার না খাওয়া
জরুরী ওষুধ পড়ে আছে অবহেলায় তোমার বালিশের তলায়।
তখনও তোমার হাত আমার হাতে। এ সংকোচ আমায় ভাবিয়ে তোলে।
দু’চোখ কষ্টের জলে উপচে পড়ে, নিজেকে ধিক্কারের আগুনে পুড়িয়ে দিতে।
আমি কেন পারি না তোমার হাতে হাতে আমার হাত বাড়িয়ে দিতে।
তোমার কষ্টের ভাগ নিতে।
তুমিও তো পারো মুখ ফুটে বলে দিতে।
বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না তোমার।
এ কি তোমার অবোধ ভালোবাসা ।
না তোমার অভিমান ? না আমার খামতি সবার নজর থেকে আড়াল রাখা।
আজও
তোমার আদর শ্রমে সুখ সম্বৃদ্ধির ধান ফোটে আমার ঘর গেরস্থালীর সংসারে।
মানববাগান
~ তৈমুর খান
আমাদের কর্মপন্থাগুলি
আমাদের ধর্মপন্থাগুলি
দীক্ষিত হোক
মানববাগানের ফুল ফুটুক
সারস্বত আনন্দের প্রজাপতিগুলি
উড়ুক আজ —উড়ুক —উড়ুক
অনন্ত এখানে নামো
এখানে আমরা অনন্ত সবাই
জ্যোৎস্না চাদর ফেলে গেছে
যৌবন রহস্যময় হাঁটে
বয়ঃসন্ধি সম্মোহনের নদী
সোনালি আলোর আড়ালে
সেও দেখি হাসে
হাত ধরো
একটি হাত, দুটি হাত, অজস্র হাত
হাতে হাতে প্রাণের স্পর্শ জেগে আছে
মানববাগানে দিন
মানববাগানে রাত
মানববাগানে ভোর —গোধূলিসংকেত
চলো, কলরব বিছিয়ে বসি
চলো, স্তব্ধতা পেতে শুই
চলো, স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন রাখি
আমাদের মৃত্যু আছে?
আমাদের জন্ম আছে?
আমাদের ঈশ্বর?
আছে অথবা নেই
নেই অথবা আছে
দেখতে পাই অথবা না দেখা
ধারণা অথবা ধারণাতীত কিছু
সব নিয়ে মানববাগান
সব নিয়ে আমাদের গান
যে গাইতে পারে না
অথবা যে গাইতে পারে
গাওয়া না গাওয়াও
কথা আর সুরের সন্তান ;
নাস্তিক আস্তিক তারাগুলি আলো দেয়
আকাশে মহাকাশে তীব্র জ্যোতিষ্কবলয়ে
তাদের বিনম্র জাগরণ
টের পাই
আমাদের অনন্ত অস্তিত্বে আলো পড়ে
অপার্থিব আলোগুলি কোমল
অভিলোচনের মতো স্বয়ংক্রিয়
বিস্ময় জাগায় ;
ঘরের লণ্ঠনকে তবু পাশে রাখি
বউটিরও ডানা নেই বলে
মাঝে মাঝে ডানা-কাটা পরি
বিস্ময়কে আঙুল দেখাই
দুঃখের কাছে চোখ সরোবর
যে বোঝে না কিছু তাকেও বোঝাই ;
মায়া নেমে এসে ফুটেছে পদ্ম হয়ে
সম্পর্ক অলীক ভ্রমর
কেউ যদি কাপালিক হও
এ বাঁশিটি ফুঁ দিয়ে দ্যাখো
বাজলে কী সুর হয় তাতে
না বাজলে শুধুই দণ্ড
কেবল ব্যর্থ বাঁশ
সহিষ্ণু জ্বরের তাপে শরীর পোড়ে না
তবু ছাই ওড়ে
বিমর্ষ অদৃশ্য চিতা জ্বলে
এ চিতায় দাঁড়িয়ে থাকি সারারাত
যদি তুমি আসো হে কবিতা
নির্মোহ সংলাপ
আমিও তাহলে নাচতে পারি
মৃত্যুর ঘুঙুর পরে পায়ে
জীবনের অপার্থিব উত্তরণ পাই
যদিও লাইনগুলি ছোট
মাঝে মাঝে ছন্দপতন
যদিও মানববাগানে দুঃখধুলো
যদিও বিষাদ সেই নিগ্রো সনাতন
তবুও একপংক্তিতে ক্রিয়া বসে
সাপেক্ষ অব্যয় পদে বাক্য হয় ভালো
নষ্ট তারার কাছে এসে
সমস্ত পোশাক খুলে ফেলি
পার্থিব পোশাকগুলি মলিন কদর্য ধুলোবালি
তারাও ওঠে হেসে
শরীরও হাসে একা একা শূন্যতার তাপে
মানববাগানের ফুল কারা তুলতে আসে?
জানি না বিসর্গ-বিন্দু
আমিও অযোগবাহ বসি তার পাশে
উচ্চারণ তাড়নজাত
নিসর্গ ভাষায় বিদ্যুতের চমক
কিছুটা চমকানি পেয়ে ধাঁধায় ঘুরপাক
তবুও বৃষ্টি পড়ে
ভেজা ভেজা সতীর্থকাল
অলীক চেতনার মাঠে ক্ষণজীবী সুর
বেজন্মা গানের কলি খুঁজে পাই
ভিজতে ভিজতে উন্মুখ প্রহরে
হারানো স্মৃতির সঙ্গে দেখা হয়
বাক্যবিন্যাসগুলি বাগানের প্রাচীর
প্রাচীরের রন্ধ্রে ঘুম ও জাগরণ
যাওয়া-আসা করে
প্রশ্রয়ে ডুবে থাকা উদ্বেগের আয়ু
বাতাসিকে ডাকে শুধু চলন্ত হৃদয়ে
আসলে প্রস্বরে ঝড় হওয়া বায়ু
মূল্যহীনকে যদি ডাকে মূল্যবান
যদি-বা বিবাহ হয় ওদের
কে তবে হয় সন্তান?
একালে ওকালে ভবিষ্যতের চাতালে
চেয়ে থাকে আমাদের স্বয়ংক্রিয় বিস্ময়
বিবাহ সন্তান জন্ম, সন্তানের পরিণতিময়
একটি যুগ
একটি নিরক্ষর দার্শনিক
শিক্ষিত হবে বলে কেবল ধ্যানস্থ তার্কিক
হয়ে যেতে পারে
অথবা কিছুই পারে না —
মানববাগানে শুধু তোলে বুনোফুল
পর্যটন থেকে নিবৃত্তি আসে না
মনের আরোগ্য নেই
রোগ পুষে রাখার সামর্থ্যে
সব কল্লোল-কল্লোলিনী ঢেউ তোলে
বার্তা দেয়
বার্তার পাঠশালায় করুণ সদ্গতি
এ সমাধিক্ষেত্র থেকে নীল তিথি
আর সবাক তীর্থক্ষেত্রগুলি চেয়ে আছে
আমরা জন্তুর ধর্মে নিয়ন্ত্রণ সাজাই
যদিও অনিয়ন্ত্রিত দিন
অন্ধকার এসে খেয়ে নিতে থাকে
জীবনের প্রার্থিত সময়
এ বাগানে সত্য আছে?
কোন্ সত্যকে রোজ ডাকি তবে
ডেকে ডেকে অন্ধ হই
শূন্যতার পথে কার পদধ্বনি শুনি
অথবা নিরর্থ আলো এসে দৃষ্টির ধারণা দেয়
কিংবদন্তির পাড়ায় কত মোলায়েম গল্প
আহা গল্পের ভেতর অল্প নাচ লেগে থাকে
প্রবৃত্তিই সবকিছুর সমাধান চায়
যদিও সমাধান বলে কোনও ধান নেই কৃষকের
সবই তো মৃত খড়, আলুথালু বৈরাগ্য সমীচীন
আর যা আছে গার্হস্থ্য মেদুর বিছানায়
রতির বেহালা
বিশেষ্যের বদলে সর্বনাম
কর্তব্যের গেরস্থালি জুড়ে মূর্খ বিশেষণ
দিব্যি সেজে ওঠে
নিচে সুরক্ষিত বাড়িটি তার
বাড়িতে ঘুমায় কাম, অথবা জেগে থাকে
আমরা ছিপ হাতে সবাই শিকারি
অনেক সোনালি রুপালি মাছ ধরি
মানববাগানে অতিচেতনার হাঁস
বাসা বাঁধে, ডিম দেয়, বাচ্চা হয়
অনেক কাকলির ভেতর
নতুন নতুন কাকলি
বাসার চারিপাশ ঘিরে ঘোরে সর্বনাশ।
বিশেষ কবিতায়
তপস্যা
© হেমন্ত সরখেল
এমন অভাবকে স্বভাব বলে ফেললে বিশেষ ক্ষতি
হবে না আমাদের, বিশেষত যারা
হাঁটতে হাঁটতে খুলতে শুরু করেছি পোশাক আর
কালোয়াতিকে গজল ভেবে
মৌতাতে জড়িয়ে ধরেছি পরস্পর |
সপ্তডিঙা পেলেই মাধুকরীতে ভাসার অভ্যেস
তেমনিভাবেই আছড়ে ফেলেছে আমাদের পড়ন্ত বেলায়,
শূন্য কাছি আর হতাশ পৈঠা দোষারোপ করেছে নিজেকে, অথচ
আমরা তো জানি- লব্ধ তণ্ডুলে নাক ডুবিয়ে
গ্রহণের কী আকুতি ছিল-
কী ভীষণ নাকাল হয়েছি আমরা মৈথুন শেষে মাঝদরিয়ায়!
স্বভাবকে অভাবের যত্নে রেখে
যে কথাটা লুকিয়েছি বারবার, উত্তাল তরঙ্গের কাছে আজ, এসো, নতজানু হয়ে
স্বীকার করে নিই দুজনেই
'আমাদের কাম সাধনা হয়ে ওঠেনি আজও, তাই--
আবারও ভিক্ষা পাত্র হাতে বেহায়ার মতো এ চরাচরে
ভাসতে চাই...'
*****************
বিপক্ষ
©হেমন্ত সরখেল
এক রাশ প্রশ্নের ভারে কুঁজো তুমি - মৃত্যু।
আবাহনে নিঃশ্চুপ বিসর্জনে নির্বাক।বোবাকে বেষ্ঠিত দেখি শত্রুতে। থরথর পাতা কিট লেহনে। অথচ জবাব কতো জমে আছে যুগ যুগান্তর ধরে।
কেন স্বৈরাচার প্রশ্রয় দাও ? আমরা চাই, আমাদের সাথে এসে দাঁড়াও।
সবাক হও।
একবার স্বীকার তো করো জীবনের থেকে বড়ো তুমি নও !
★★★
চৌকিদার
-- হেমন্ত সরখেল
আমি কবি নই।
আজকাল শব্দটা বিদ্রুপ করে
তাড়া করে ফেরে ঘুমের ভেতরে
অক্টোপাসেরা জেগে থাকে অস্তিত্ব ঘিরে-
মুখ বুজে সই।
জানি - আমি কবি নই।
শত শত অপাপবিদ্ধ প্রাণ
ঘটনায়-রটনায়-যন্ত্রণায় অন্তিম শয়ান
সংবাদের ওজন বাড়ে মাত্র!
আমার নাগরিক পরিচয়পত্র
কখনো হিংস্র কখনো ব্যথিত কখনো অসহায়
নপুংশক খসখস্ খসখস্ - শুধু কলম চলে যায়
প্রশ্ন সেটা নয় - ভিজছে কিনা চোখের পাতা
জানি, কবি নই,
হবে না সৃষ্ট বাস্তবব্যথা।
তবু যে ঐ অস্বস্তিকর খসখস্
ভাবি,হয়তো বা চেনাবে কখনো জীবনের কষ্
কোনো এক প্রজন্ম বসে ভাববে এ কথা --
"-------লোকটা কী ছিল?
কিসের সাথে ছিল তার সখ্যতা?
ছিল সে কোন্ দায় -
কলম চললো কি শুধুই নৈতিকতায়?"
আর কিছু দিয়ে হয়তো হবেনা বিচার
কবি নয়,কবি নয় - জেনো এক চৌকিদার--
' --পড়বে সব এই পোড়া চোখ দুটোয়
চাইবে - তবু বাঁধা রইবে 'না-বলার' অসহায় খুঁটোয়,
বিধ্বংসী - আগুন জ্বলবে মনে
ভিজবে পৃষ্ঠা,পচবে ঘরের কোণে
কাজ তার শুধু খোঁজটুকু দিয়ে যাওয়া
কল্যান-অকল্যান? এই ই মাত্র পাওয়া--
শেষটা যে তার কপালে লেখেনি প্রভু
ভাগ্যের দোষ দিয়েই বেড়াই শুধু !'
এটুকু মাত্র অনুরোধ যদি মেনে নিতে পারো
জাতিস্মর হয়ে ফিরব - কলম ধরব আবারও...
------------
সম্মোহন
~ প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ
আকাশের মতো উদার হতে পারবো না
বরং একটা একটা করে জল থেকে
ছেঁকে নিই বাসি ভাতের টুকরো
সম্মোহনের আলিঙ্গনে প্রকাশিত হোক
আমার যাবতীয় লাম্পট্য
ভেজা অক্ষর আরো একবার
ভিজিয়ে দিক আমার হৃদয়
চোখের জলে
পুড়ে যাওয়া শব্দরা আমাকে জাপটে ধরুক
নদীর মতো বহমান হতে পারবো না
বরং একটা একটা করে
মাটি থেকে কুড়িয়ে নিই
ঝরে যাওয়া বকুলের পাপড়ি ।
আঞ্চলিক কবিতা
মা তুই কোটে গেছিস
~ গিরিশ সূত্রধর
যখন মুই ছোট ছিলুং হইছিল মোর জ্বর,
কাজ কামাই তুই ছাড়ি দিস মা তাও না ছাড়িস ঘর।
জলপট্টি, ওষুধ খোয়াইস শিতানৎ বসি নিন,
"নুন আইনতে পান্তা ফুরায় "সেটাও সুখের দিন।
এলা মা তুই কোটে গেছিস একলায় মোক ছাড়ি,
ধনদৌলত সগে হইচে তোক ছাড়া মা ফাঁকা নাগে বাড়ি।
সাকালে মুই অপিস যাং সইন্দ্যাৎ আইসোং বাড়ি,
বাপুই কওয়ার মানষি নাই,কায় কইবে হাত ঠ্যাং ধুইয়া আয় তাড়াতাড়ি।
জামাটা তুই খুলি দে ধইরবে নাতেন তিকু, হইবে আরো মইলা,
শুকাইবে না, সাকাল হইতে ইস্কুল যাবু কাংঐ না কয় তো এলা।
বাপের মুখখান দেখং নাই মুই য্যালায় ছিলুং কোলাৎ,
মাল্লির চাক কাটির যায়া,খবর পালু পোকায় বোলাইচে দোলাৎ।
তাও কছিস কোনো দিয়া কম নাই তোর, এলাং আছোং মুই ,
খুঁজি বেড়াং এদি ওদি চিল্লে কং মা কোটে গেছিস তুই।
দিনের শ্যাষোৎ বিছ্নাৎ যাং মনে হয় বৈশাখ মাসের কথা,
গরম নাগে ঘুম না ধরে ছটফটানি দেখি; তোর আঁচলের হাওয়া জন্য কোলাৎ দ্যাং মাতা।
কোনোটে একেনা গেইলে মুই ড্যাকে আনিস ঘর,
সুখের দিনৎ সগে আছে জীবনযুদ্দের মাঠখানৎ তুই মা হলু পর।
হুইর্কা আসিল সাতাও নাগিল সগে রইল্, ভাঙিল্ মাতার উপরের ছাতা,
এত ড্যাকাং ক্যানে মা তুই না কইস মোক কতা!
ভাবিছিনু পিন্দি তুই সাদা শাড়ি যাওয়ার লাগছিস মামা ঘরের বাড়ি,
এলাং মুই আছোং চ্যায়া কতক্ষণ আসিস ঘুরি, পৃথিবীটায় মোর আন্দার দেবী তোর মতো আলোক ছাড়ি!
কবিতা ১
বেনিয়ম
কবি:-নিতাই প্রসাদ ঘোষ
মধ্য গগনে সূর্য
ছায়া পড়ে লম্বের মত
অশরীরী আত্মা যেন।
কারণ নেই বা অকারণে
বৃষ্টি কাঁদে অঝোর ধারায়
এত চোখের জল কোথা থেকে আসে।
পাখিরা যেন ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যায়
কোন নির্দেশ বা নিয়ম নেই
ওরা চঞ্চল, কোন বাধা মানে না।
কচ্ছপ ও খরগোশের গল্প
~ সমাজ বসু
এত ব্যাস্ত চলাচলের মাঝে আমার ধীর গতি বড় বেমানান--
সবাই ছুটছে--
কে কার আগে আপেল কিংবা কমলালেবু নিয়ে পৌঁছবে গন্তব্যের সুতোয়--অথচ--
এই সব দৃশ্যে আমার কোন হেলদোল নেই,
রেটিনায় শুধুই নীল মাছের চোখ--
নীল মাছের চোখ জানে আমার একাগ্রতা-
স্থির অবিচল--
অতি মন্থর গতির কাছেও এক সময় হার মানে, অপরের ক্ষিপ্রতা।
খরগোশ পড়ে থাকে--
আর কচ্ছপ পৌঁছে যায় গন্তব্যের সুতোয়...
আবার হাসনুহানা
~ মানস চক্রবর্ত্তী
অনিন্দিতা অ- নিন্দিত তুমি
শব্দের আগে ঠিক যেন ওঁ |
শরীর স্পর্শের পাপ পোশাকের মতো খুলে রেখে
আমাকে বলো , বাসনায় রতি নেই কেন ?
বিকেলের মতো উদাসীন কেন উথাল-পাথাল ?
ছন্দ কেন পতনশীল লঘু দ্বন্দ্ব ?
আমি কি বেঘোরে হারিয়েছি ঠিকানা ?
রক্তকরবী নয় , সবুজ ধানের মতো মহার্ঘতা
প্রাচীন অথচ এখনও ক্রোধহীন শিহরণ |
শরীরে তিলের মতো ছুঁয়ে আছে স্পর্শ
কার্নিশে লেগে আছে এখনও হলুদ রোদ
বিষণ্ণ অবসরে জাগে জ্যোৎস্নার ক্রোধ
মায়া প্রতিবিম্বিত হয় অভিমানে |
অনিন্দিতা রাত্রি শেষ হলে তুমি কি
আবার আসবে ? শীতের রোদের মতো
হাসবে ? অন্যমনস্কতা হয়ে যাক ভুল |
আবার হাসনুহানা , জেটি ঘাট , আবার বটের মূল |
বীর পুত্রের জননী বিশাখা
শ্রাবণ কয়াল
"উড়ছে ধূলো ছুটছে অশ্ব ,রণভূমিতে তির শয্যা স্বয়ং ভীষ্ম"
ভীষ্ম বধের পর কুরু সেনাদের হার নিশ্চিত স্বয়ং কর্ণ তা বুঝে গেছে
ভয়ে বুক কাঁপছে সাধারণ কুরু সেনার
কে দাঁড়াবে বীর অর্জুনের সম্মুকে।
ত্রিলোকে এমন যোদ্ধা কে আছে ,যে কিনা অর্জুনকে পরাস্ত করবে!
স্বয়ং দ্রোণ ,ভীষ্ম ,যার বানে পরাস্ত সে কি আর একটু আধটু বীর
ভীষ্ম বধের পর
দিক বিদিক ধ্বনিত হচ্ছে অর্জুন জয়ধ্বনি
তারই মাঝে হঠাৎ নিন্দার সুর---- "ধিক আপনার অর্জুন ধিক "
শব্দের উৎস খুঁজতে মরিয়া পাণ্ডব সেনা
অর্জুন স্তব্ধ ,ব্যথিত হৃদয়ে অনুভব করছেন ভীষ্ম ,গুরু দ্রোণ হত্যার অপরাধ গ্লানি
যুদ্ধ জয়ের আনন্দের মাঝেও অর্জুন বিষাদ গ্রস্ত
তার লক্ষভেদী ইন্দ্রিয় শুধু নিন্দিত ব্যক্তিকে খুঁজছে
পিতামহ ভীষ্ম হত্যার অপরাধ গ্লানিতেএকাধিক প্রশ্নে যখন আত্মমগ্ন অর্জুনের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত
ঠিক তখনই মহলের বাহিরে স্ত্রী লোকের চিৎকার ___"আমাকে ছেড়ে দিন , আমাকে ছেড়ে দিন আমি আপনাদের ওই পাপের প্রাসাদ পুরিতে প্রবেশ করতে চাই না।"
অর্জুন বিলম্ব না করেই মহল থেকে বেরিয়ে আসে
স্ত্রী লোক অর্জুনকে দেখে _____"হে বীর আমাকে চিনতে পারছেন? নাকি উম্মত বাসনা জয়ের অভিলাসে দৃষ্টি শক্তি কমেছে আপনার!
হে জননী এই অজ্ঞাতকে আপনার পরিচয় প্রদান করুন
হে অর্জুন আপনি কি ভেবেছেন গান্ধারী জননীর মতো আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি?না অর্জুন না তা কখনই না
আপনার বিন্যাস দেখার অপেক্ষায় আজও আমি জীবিত
আমার তৃষিত নয়ন শুধু অর্জুন বিন্যাস মুহূর্ত দেখার অপেক্ষায়
হে জননী এই পাণ্ডব পুত্রের প্রতি আপনার এ হেন ক্রোধের কারণ কি তা জানতে পারি?
জননী আপনার কি মনে হয় এই ত্রিভুবনে অর্জুনের চেয়েও শ্রেষ্ট ধনুরবিদ রয়েছে?
ছিল অর্জুন ছিল আপনি শ্রেষ্টত্বের মোহে সেই বীরের বীরত্ব'কে হত্যা করেছেন
হে জননী আমি জানি যে আপনি গুরু দ্রোণ আর পিতামহ ভীষ্ম বধের মতো নিচ কার্যের জন্য ধিক্কার ধ্বনি দিচ্ছেন
না না অর্জুন সে তো আপনার যুদ্ধজয়ের কপটতা ছিল
আমি জানি অর্জুন ,শ্রেষ্ঠ বীর খ্যাতি অর্জনের জন্য এ হেন নিচ কাজ আপনার পক্ষে সম্ভব
অর্জুন যুদ্ধের জয় নিয়ে এত উল্লসিত হওয়া আপনার পক্ষে সভা পাইনা
আপনি ভালো ভাবেই জানেন এ যুদ্ধে আপনাকে জয়ী করা হয়েছে,
আপনি নিজের বীরত্বে জয় হাসিল করেননি
গুরু দ্রোণ'কে কে বধ করার জন্য আপনাকে ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছে,আর পিতামহ ভিষ্মের দুর্বলতার সুযোগ
আর কর্ণ ,তার কথা নাইবা বললাম...
হে জননী আমি আপনার হাজারো নিন্দা বানে জর্জরিত
আমাকে আর ভৎসনা করো না
সন্তান জ্ঞানে আপনার পরিচয় প্রদান করুন
মনে পরে অর্জুন সেই ছোটো বালকের কথা!
যে বালক শ্রেষ্ট ধনুরবিদ হতে চেয়েছিল
যে বালক হতে চেয়েছিল আচার্য দ্রোণের শিষ্য
মনে পড়ে অর্জুন আপনাকে শ্রেষ্ট ধনুরবিদ গড়ার স্বপ্নে যে গুরু এক শিষ্যের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলি গুরু দক্ষিনা চেয়েছিল!
যে বীরের ধনুক নিজ অভ্যাসে বাধা দেওয়া কুকুরের মুখমন্ডল অক্ষত রেখে চিৎকার থামিয়ে ছিল
অর্জুন আমি সেই বীর পুত্রের জননী বিশাখা।
চেতনার ঘুম
~ অভিমন্যু
------------------
চেতনার লোমকূপগুলোর ঘুম ভাঙে-
কোথাও ভোরে, কোথাও মধ্যাহ্নে,
আবার কোথাও সাঁঝবেলায়।
কখনো সেই ঘুম ভাঙতে অনেক সময় লেগে যায়।।
যখন সেই ঘুম ভেঙে অনেক রক্তক্ষরণ হয় ,
তখন সহ্যের আবরন অনেক কঠিন হয়ে যায়,
অনেক ঝাপটায় আর ঝড়ে তা ভেঙে পড়েনা --।।
গোলাপের পাপড়ির মতো ঝরে পড়েনা আবেগ
মন ভাঙতে ভাঙতে নিদারুন রক্তক্ষরণ, তবু অশ্রু রুদ্ধ হয়ে থাকে ;
বৃষ্টি হয়ে সব মেঘ আকাশ থেকে নেমে আসেনা,
কিছু মেঘ ভেসে যায় অন্যকোথাও
সহনশীলতার একটা নতুন হাত বেরিয়ে আসে --
সে হাত সব কিছু মাফ করে দেবার, অন্যভাবে সবকিছু সাজিয়ে নেবার।।
যুক্তির শানিত তরবারিতে, অনেক কিছুই আর খন্ডিত হয় না --
উদাস হয়ে তখন কি শুধুই দেখে যাওয়া,
হৃদয় ভারী হয়ে যায়, সেই দুঃসহ ভার নিয়ে এগিয়ে চলে মন;
চলতে চলতে অনেক বেড়া ভেঙে যায়,
অনেক দেওয়াল, এমনিই গড়ে ওঠে,
চেতনার ঘুম ভাঙে, ফুল ফুটে ওঠে।।
মন সন্ধানী
~ সঞ্জয় চক্রবর্তী
পাথর নই ।
গ্রীষ্মের দাবদাহে হা হা ।
শীতের কুঁয়াশায় তোমাকে খুঁজি,
শুধুই তোমাকে,
পাই না....।
কর্মমুখর পৃথিবীর সৃষ্টিশীলা গহ্বর,
কিংবা দেবশিশু সন্তরনের সু-বরদী সরোবর,
কখনও কোথাও পালাওনি,
তুমি চঞ্চলাবিহারিণী ।
মেঘলাদিনের স্নিগ্ধছায়ায়, সকাল থেকে দুপুর,
অশ্বত্থ-বট-সুপারী আর খেজুর
গাছের নীচে কোনো নীলকণ্ঠ পাখীর
স্বজন হারানো কুজন,
আর অজানা কোনো
ভাটিয়ালি সুরের গলা নেশাতুর;
ভরিয়ে তোলে হৃদয়-পথের খানা-খন্দ মধুর ।
নক্ষত্রের আগুন-রাঙা আলোয়;
উজ্জ্বল হয়ে খুঁজেছি তোমায়, আমি সুধাময় ।
উদ্যান-তাপসী হয়ে, জলে জঙ্গলে
কভু ছিলে লুকিয়ে ।
শরীরের শত বাঁকে, ধানি মৌচাক থরে থরে বাঁধা,
প্রথম রাতের বাবলাতলার তুমিই মাধবীলতা ।
কখনওবা মর্মভেদী বহুরূপী তুমি;
তুমুল বৃষ্টি হয়ে পড়েছ ঝরে বারে বারে,
মর্মান্তিক হৃদয়-আঙিনার
সাদা-কালো আর রক্ত-পিঙ্গলে ।
মেঘালয় থেকে মালব সাগর,
হিমালয় থেকে প্রান্ত নগর ...
যখনই যেখানে খুঁজে ফিরি তোমায়,
আমার অতীত স্মৃতি উপহার;
করে শীৎকার;
মজ্জায় মজ্জায়,
মন মোহনায়....!!
রম্য রচনা
বর্ণালি এক অভিজ্ঞতা সফর
----- বিজি
তিন বছরের টিউশন জীবন, কাওকে বাড়ি গিয়ে পড়াই আবার কেও বাড়ি আসে পড়তে, টুকিটাকি গয়না,শাড়ি এগুলো নিয়ে বিজনেস করি। এতে করে আমার পকেট মানি উঠে আসে।চলছিল ভালোই তারপর আসলো এই মহামারীর প্রকোপ।এরকম দিনের কথা হয়তো কেও কল্পনাও করতে পারেনি।যাই হোক,দিন কাটছে ঘরবন্দী হয়ে। ইতিমধ্যেই আমার টিউশন গুলো বন্ধ করতে হয় আর সাথে আমার ছোট্ট টুকিটাকি ব্যবসাও। ও আরেকটা কথা তো বলাই হয়নি,আমি বি.এড-এ প্রশিক্ষণরত। লকডাউনের ফলে কলেজও বন্ধ। একেবারেই গৃহবন্দী দশা যাকে বলে।ঘরের কাজ, একটু আধটু পড়াশোনা, গান এসব করে সময় কাটছিল। লকডাউনের প্রথম দিকে বাড়িতে যেই পিসি আসেন কাজ করতে তাঁকেও আসতে না করে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু আস্তে আস্তে দিনসংখ্যা বাড়তে লাগলো। তারপর পিসি আবার কাজে আসতে শুরু করলেন কিন্তু উনি দুবেলা আসতেন তা না এসে শুধু সকালে আসেন।মা-এরও অনেক সুবিধা হলো এতে,খানিক কাজের চাপ কমলো। এরকমই একটা দিনে, দুপুরে খেতে বসেছি, খাওয়ার টেবিলে অনেকরকম কথাই আলোচনা হয়। তো এইদিন কথা তুললাম আমি,বললাম আচ্ছা এই যে আমরা বাচ্চাদের পড়াই তাদের সাবজেক্ট কটা,কতদিন পড়াবো,গিয়ে পড়াবো না বাড়িতে এসে পড়বে সেগুলো জেনে তার ভিত্তিতে পেমেন্ট নিই,তাহলে পিসির মতো যারা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন তাদের তো রোজ দুবেলা করেই আসা যাওয়া করে শরীর দিয়ে পরিশ্রম করেন তাদের বেতনও ভালোই হওয়া উচিৎ! (কখনোই এমন নয় যে আমার পরিবারের মানুষের মাটিতে পা পড়ে না,কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি নিজের মতো ভাবতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি) শুরু হলো হঠাৎ যদি উঠলো কথার একটা এপিসোড-
মা বললেন-তোরাও মাথা খাটিয়ে পড়িয়ে রোজগার করিস।
আমি আবার - হ্যাঁ সে তো ঠিকই, কিন্তু কাজ তো কাজই হয় তাইনা,আর তাছাড়া আমি যেটা পারি সেটা দিয়ে আমি সাবলম্বী আর উনি যেটা পারেন সেটা করে উনিও তো সাবলম্বী তাই না, সৎ কাজে উঁচু নিচু থাকেনা। আর এখন ওনারাও এই কারণে নিজেদের কম বেতনে কাজ করতে চাননা।
দিদি বলে উঠলেন - তাহলে তুই যাস লোকের বাড়ি কাজ করতে!
যাক,আমি আর কিছু বললাম না,ছোট কিনা। তবে এতটুকু মনে হলো দিনশেষে সবাই নিজের আর পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্যই পরিশ্রম করে রোজগার করে,এখানেও উঁচু নিচু!
বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ব্যাক্তিগতভাবে আমি মনে করি ডিগ্রি বহু লোকের আছে,কিন্তু সৎ উপার্জন কি সব ডিগ্রি নেওয়া মানুষের আছে???যদি কখনো পেটে টান পড়ে ঈশ্বর যদি চান তবে অন্যের বাড়ি কাজ করতেও রাজি তবু যেন রোজগার পবিত্র হয়॥
আমার চোখে এরকম অনেক মানুষ পড়েন যাঁরা হয়তো তথাকথিত পুঁথিগত শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত নয় কিন্তু তার মানবিক শিক্ষা আমায় অত্যন্ত প্রভাবিত করে।বইতে যা লেখা থাকে তা কিন্তু জীবনে প্রতিফলন ফেলানোর জন্যই বটে তাও সেগুলো কজনে ধারণ করে! আফসোস শুধু এটাই যে লোক বিদ্যা অর্জন করে শিক্ষা ধারণ করেনা। তবে সবাই সমান হয়না অবশ্য,কিছু শিক্ষিত মানুষ সবদিক থেকে পরিপূর্ণ হন।আমার বলার উদ্দেশ্য একটাই যে বর্তমানে যশ খ্যাতি সব থাকলেও মনুষ্যত্ব বিলুপ্ত। ভেদাভেদ কোথাও না কোথাও মানুষের মনে বাসা বেঁধে আছে এখনো।একমাত্র প্রকৃত শিক্ষাই পারে এই ধরনের মানসিকতাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনতে।
কিছু কথা তাই সবসময় খেয়াল রাখা দরকার,যে আসলেই শিক্ষিত সেই মানুষের কোনো অহংকার থাকেনা। দ্বিতীয়ত,তুমি যে কাজ পারো সেই কাজ অন্যজন পারেনা,আর যেটা অন্যজন পারে সেটা তুমি পারো না,তাই নিজের যোগ্যতা নিয়ে অহেতুক গর্ব করা ঠিক নয়। তৃতীয়ত,যদি পারো তবে নিজের যা আছে সেটা দিয়ে অন্য মানুষকে কিভাবে সাহায্য করতে পারো সেটা ভাবো এতে করে তোমার দক্ষতা বাড়বে আর অপরজন উপকৃত হবে।
সমাজে প্রতিটা পেশা একে অপরের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক জলের তলার প্লেটের মতো,একটা থেকে একটা সরে গেলেই বিপর্যয়। বিভিন্ন পেশায় যুক্ত মানুষ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল,কোনো চাকরিরত ব্যাক্তির গাড়ি চালানোর ড্রাইভার ছাড়া হয়তো তিনি অফিসেই যেতে পারবেন না।আবার যেমন আমাদের সাইকেল খারাপ হলে রিপেয়ারিং এর দোকানে নিয়ে যাই। যেমন করে একটা একটা ইঁট দিয়ে বাড়ি তৈরি হয় ঠিক তেমনি সমাজে প্রত্যেকটা পেশা একেকটা স্তম্ভ,একে অপরের পরিপূরক।এগুলোকে নিয়ে ভাবনায় ভেদাভেদ আছে,কাজের কোনো বিভেদ হয়না।সৎ পথের সব কাজই ভালোবেসে করতে পারলে জীবনে ঠিক সফলতা পাওয়া যায়।সময়ের সাথে সাথে আমরা যেন এই ধারণাগুলো জীবনে নিয়ে এগোতে পারি।
জানি ভেদাভেদ কোনোদিনই মুছে যাবেনা,তবে হ্যাঁ, খারাপটা আছে বলেই ভালোর এত মূল্য।যারা খারাপটা দিচ্ছেন তাঁদেরকে ঋণাত্মক ভাবে না নিয়ে তাদের কথাগুলোকে জীবনে আশীর্বাদ হিসেবে নিয়ে এগিয়ে চলাই হল প্রকৃত লড়াই, এই লড়াই আমার তোমার সবার।তাই আর বেশি কিছু না ভেবে অহংকার ঝেড়ে ফেলে মনের ভালোবাসা দিও ঢেলে,জীবন দ্বিগুণ করে তোমায় ফিরিয়ে দেবে ।।
আলোচনা - ২
বিবেকানন্দ
(বর্তমান সমাজে শিকাগো বক্তৃতার প্রাসঙ্গিকতা)
~ টুলটুল দেবনাথ ( শিপ্রা)
বিশ্বের সকল ধর্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে আমেরিকার শিকাগোয় "দ্য পার্লামেন্ট অফ ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নস" নামে একটি ইনস্টিটিউটে বসেছিল এক মহা ধর্মসম্মেলন আজ থেকে ১২৬ বছর আগে ১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর। সেদিন আমাদের ভারতবর্ষের আদর্শ শ্রী স্বামী বিবেকানন্দ উক্ত ধর্মীয় মহাসভায় উপস্থিত ছিলেন এবং সেদিন তিনি ভারতের হয়ে সেই ধর্মীয় মহাসভায় নিজের বক্তৃতা রেখেছিলেন।স্বামীজির দেওয়া সেদিনের বক্তৃতাটি ছিল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তৃতা গুলির মধ্যে অন্যতম একটি।তার অমূল্য বক্তৃতার মাধ্যমে সেদিন তিনি সেখানে উপস্থিত সমগ্র আমেরিকাবাসীর মন জয় করে নিয়ে তাদের হৃদয়ে নিজের জন্য চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন। সাথে ভারত তথা সমগ্র বিশ্ববাসীর মানসপটে সেদিন তিনি স্থায়ীভাবে নিজের জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন।স্বামীজি তাঁর বক্তৃতায় ১১ সেপ্টেম্বর এবং তার পরবর্তী বক্তৃতা গুলিতে মানবতা ,ধর্ম ,শিক্ষা,সংস্কৃতি,ইতিহাস ,সভ্যতা , স্বাস্থ্যএসব বিষয় নিয়ে অনেক শিক্ষা মূলক এবং উপদেশ মূলক কথা বলেছিলেন। তিনি নিজের দেওয়া বক্তৃতায় যা কিছু বলেছিলেন তা আজ একুশের দশকেও বর্তমান সমাজে অধিকতর প্রাসঙ্গিকতা রাখে কেননা সমগ্র বিশ্বের যে চিত্র আমরা আজ দেখছি তার থেকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার চিত্র আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠে।
শিকাগোর সেই ধর্ম সম্মেলনে স্বামীজি নিজের বক্তৃতায় অন্ত: ধর্ম সমন্বয়ের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন।তিনি নিজের বক্তৃতায় খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে আমাদের ভেতরে অন্তর- মনের সংকীর্ণ মনোভাবই নিজেদের মধ্যে অশান্তি ঝগড়াঝাঁটি ও বিবাদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন-আমি ও আপনি একজন হিন্দু বা খ্রিস্টান বা অন্য ভিন্নধর্মী যাই হই নিজের ধর্মে বিশ্বাসী। অর্থাৎ নিজেকে একটা ছোট্ট গণ্ডিতে আটকে রেখেছি। একটা ছোট্ট কুয়োতে নেমেই আমরা ভাবছি যে এটাই বুঝি সমুদ্র এটাই বুঝি সমগ্রবিশ্ব।আসলে আমি বা আমরা নিজেদের চিন্তা ভাবনা এবং চেতনাবোধ কে সেই একটা ছোট্ট দুনিয়াতে আটকে রেখেছি অহংকার ভাবাপন্নএকটা অতি ক্ষুদ্র পরিসরে। স্বামীজি তার বক্তৃতায় এই কথাটাই প্রত্যেক ধর্মের উপস্থিত ব্যক্তিদের বুঝাতে চেয়েছিলেন যে কেউ যদি মনে করে থাকে যে কোন একটা নির্দিষ্ট ধর্ম নিজের মতবাদ প্রচার করে জিতে যাবে আর বাকি ধর্ম নিঃশেষ হয়ে যাবে বিলীন হয়ে যাবে এই ভাবে ঐক্য স্থাপন হবে তবে সেটা বাস্তবে মোটেও ফলপ্রসূ হবে না।তিনি বলেছিলেন আমাদের প্রত্যেককেই ভিন্নধর্মের সার বস্তু গ্রহণ করতে হবে এবং অন্যের ধর্মকে সমান মর্যাদা দিতে হবে সমান গুরুত্ব দিতে হবে তৎসঙ্গে নিজের ধর্মের অস্তিত্ব এবং মান সম্মান বজায় রাখতে হবে নিজেদের করণীয়র মাধ্যমে । পবিত্রতা ,উদারতা,মানবিকতা ,সততা এসব গুণগুলি কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই এই গুণগুলো অন্তর্নিহিত হয়ে আছে এবং থাকা দরকার। অর্থাৎ সর্বধর্ম সমন্বয়ের মিলিত সার টুকু নিয়ে আমাদের মনুষ্যত্ব সার্থক করতে হবে। মানব ধর্মে ব্রতী হতে হবে। মানব চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। প্রত্যেকটা ধর্মসম্প্রদায় যুগে যুগে অনেক অবতার পুরুষ এবং মহামানবদের জন্ম দিয়েছেন। তার বক্তব্য বিশ্লেষণ এর তাৎপর্যে আমরা বুঝতে পারি যে প্রত্যেক ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা মানবতার স্বার্থে সর্বধর্মের সমন্বয় ঘটানো কতটা প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিজের বক্তব্যে স্পষ্ট এবং বজ্রকঠিন সর্তকতা জানিয়েছেন যে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বায়ু কতটা ভয়ঙ্কর এবং ধ্বংসকারী। ধর্ম উন্মত্ততা হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা এবং গোড়াঁমির ভয়াবহ পরিণাম এ কথাও তিনি নিজের বক্তব্যে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছিলেন। এক একটা ভয়ঙ্কর দানব হিংসা-হানাহানি তে বিদ্বেষে পৃথিবীর বাতাস পূর্ণ হচ্ছে বিষাক্ত হয়ে উঠছে। মানুষের রক্ত ঝরছে সভ্যতা-সংস্কৃতি ধ্বংস হচ্ছে সমগ্র বিশ্বকে হতাশার গ্লানি ডুবিয়ে দিচ্ছে। হিংসা-হানাহানির মত জিনিসগুলি না থাকলে মানব সমাজ আরো কত উন্নতি হতে পারত।স্বামীজীর বলিষ্ঠ সত্যনিষ্ঠ বাক্যোচ্চারণ সমূহই তাকে সেই সম্মেলনের মধ্যমনি করে তুলেছিল যখন বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা নিজ নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে ব্যস্ত ছিলেন। স্বামীজীর জীবনাদর্শ ছিল আত্ম বিশ্বাসে বলিয়ান এবং সম্পূর্ণ ইতিবাচক। তিনি শিক্ষিত সমাজ আত্মবিশ্বাসে বলিষ্ঠ ইতিবাচক জাতি গঠনে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার মতে ইতিবাচক শিক্ষা ছোট ছোট বাচ্চাদের উৎসাহিত করে তাদের আত্মপ্রকাশ এবং আত্ম বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। পৃথিবীর ইতিহাস রচিতই হয়েছে কিছু আত্মবিশ্বাস সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের জন্য। মানুষের ভিতরে আত্মবিশ্বাস জাগলেই মানুষের অন্তর্নিহিত সৎভাব জেগে উঠবে মানুষ দেবত্ব লাভ করবেএবংমানুষ নিজের মনের পশুত্বকে সংহার করতে পারবে।
স্বামীজীর মতে যে সমসাময়িক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রজন্মকে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করতে পারেনা মানুষের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি করতে পারেনা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে দেয় না সে শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই এবং সে শিক্ষাব্যবস্থা মূল্যহীন। স্বামী বিবেকানন্দের মতে শিক্ষা কখনো তথ্যসমষ্টি হতে পারেনা, গভীর উপলব্ধি এবং তদানুযায়ী কাজই হলো শিক্ষার প্রকৃত অর্থ। মানুষ তৈরি করা সুন্দর জীবন দান চরিত্র গঠন মহান চিন্তাধারা এবং মানবিকতার দৃঢ়সংকল্প ইত্যাদির সমষ্টিকে একসাথে তিনি শিক্ষা বোঝাতে চেয়েছিলেন । অহংকারের বলে রাজ্যশাসন আর সমগ্রদেশের বিদ্যাবুদ্ধি মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে অর্পিত এবং তাদের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা। স্বামীজী জাতি ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল জনসাধারণের জন্য এমন একধরনের শিক্ষা চেয়ে ছিলেন যার দ্বারা কোন মহৎ বা কল্যাণময় কিছু সৃষ্টি হতে পারে। যে শিক্ষার মধ্যে থাকবে বলিষ্ঠ মনোভাব তৈরি করার মতো এবং আত্মোন্নয়ন ঘটানোর মতো কিছু প্রয়োজনীয় উপাদান। এমন শিক্ষাই হলো মানুষ গড়ে তোলার মতো আদর্শ শিক্ষা।প্রথম থেকে মানুষ যদি এভাবে গড়ে ওঠে তাহলে তার মনে সমাজ চেতনা বোধ এবং মানবতাবোধ তৈরি হবে।সেই মানুষগুলোই পারবে এক একটা সমাজকে উন্নতির চরম শিখরে পৌছে দিতে।স্বামীজীর মতে তাইতো শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রবল আত্মবিশ্বাসী এবং সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তোলা যাতে করে সমাজের শিরদাঁড়া শক্ত এবং মজবুত হতে পারে।কারণ মনোবল যদি দৃঢ় এবং বলিষ্ঠ হয় তাহলে চরম বিপর্যয়ের মুখে ও মানুষ তার সাহসে ভর করে দুঃসময় কাটিয়ে উঠে তাকে সুসময়ে বদলে দিতে পারে।
বর্তমান বিশ্বের যে সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অরাজকতা বা সমাজ ব্যবস্থার পরিকাঠামো তাতে স্বামীজী যে উদার মনোভাব আত্ম-উপলব্ধি এবং শিক্ষার যে পদ্ধতির কথা বলেছেন সে সবগুলো বর্তমানে ভেঙ্গে পড়া মানবসমাজকে নিশ্চয়ই করে মুক্তির পথ দেখাতে সক্ষম হবে বলে আমার পূর্ণ ধারণা এবং দৃঢ় বিশ্বাস।স্বামীজী এমন অনেক অমূল্য বাণী আমাদের জন্য রেখে গেছেন যেগুলো আমাদের ভেতর থেকে অনুপ্রাণিত করে অন্তর মনে দৃঢ় প্রত্যয় জেগে ওঠেএবং বর্তমান সময়ে তার বক্তৃতার প্রত্যেকটি কথা এই প্রজন্মের জন্য ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। তার মুখনিসৃত কথা গুলো সেদিনের বক্তৃতায় শুধু আমেরিকা বা ভারতবাসীকে নয় সমগ্র বিশ্ববাসী অনুপ্রাণিত করেছিল প্রত্যেকে খুব গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। একাধারে তিনি ধর্মবীর তথা কর্মবীর ছিলেন। তিনি বলেছিলেন "যে ধর্ম গরিবের দুঃখ দূর করে না মানুষকে দেবতায় পরিণত করতে পারে না তা আবার কিসের ধর্ম"? তার এই ধর্ম সম্পর্কিত বিখ্যাত উক্তি আজও আমাদের ধর্মের ঊর্ধ্বে যেতে সাহায্য করে থাকে। যুগ নায়ক শ্রী স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো বক্তৃতায় যে উক্তি গুলি করেছিলেন তা আজও বর্তমান সময়ে সমান মাত্রায় প্রাসঙ্গিক।
গল্প ও অনুগল্প ১
নতুন গ্রহের সন্ধানে
--ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়
সেদিন কাগজে খবরটা পড়েই একেবারে হকচকিয়ে গেল তৃষ্ণা। সে এবারে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। অবশ্যই বিজ্ঞানে। কলেজে ভর্তি হতে এখনও কিছু দেরি আছে। জয়েন্ট দেয় নি। ইচ্ছে আছে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়ার। আর পরে পড়বে মহাকাশ পদার্থবিদ্যা বা অ্যাস্ট্রো ফিজিক্স নিয়ে। মহাকাশ তাকে বড় টানে। ঐ যে দূরে দেখা যায় সাদা তারা বিছোন গভীর নীল আকাশ সেটা নাকি তার আসল রং নয়। এটা হয়েছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ধুলিকণার উপস্থিতির জন্যে। আলোকের বিক্ষেপনের জন্যে। আসলে মহাকাশের কোনও রং নাকি হয় না। সে যেমন অনন্ত বিস্তৃত তেমনি নাকি কুচকুচে কালো।
কিন্তু খবরটা কী? যা দেখে সে এত বিচলিত হয়েছিল? সেটা ছিল পৃথিবী বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর একটি মারাত্মক বক্তব্য। তিনি বলেছেন, পরিবেশ দূষণ নাকি যেভাবে চলেছে তাতে এ পৃথিবী আর বড় জোর একশ বছর মানুষের বাসযোগ্য থাকবে। এর মধ্যেই মানুষকে নাকি খুঁজে নিতে হবে অন্য কোনও বাসযোগ্য গ্রহ।
সেই যে পড়েছে আর টি-ভিতে দেখেছে হকিং সাহেবের সাক্ষাৎকার তাতে খুব বিচলিত সে। ক’দিন তো ভাল করে ঘুম হয় নি। শুধু ভাবছে এ বড় বিপদ পৃথিবীর সামনে। কিন্তু সে আর কি করতে পারে? সে তো বড় কোনও বিজ্ঞানী নয়।
চুপি চুপি মাকে বলে ফেলেছিল কথাটা। মা তো এসে একেবারে অস্থির। বলল, মা, তুই একটা মেয়ে হয়ে আর বেশি কি করতে পারবি? ওসব আলতু ফালতু চিন্তা মাথা থেকে দূর করে পড়ায় মন দে। জয়েন্টও তো দিলি না। সেটা দিলে একটা চাকরি তো অন্ততঃ বাঁধা থাকত? আজকাল একটা ইঞ্জিনীয়ারের কত চাহিদা জানিস? শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বেই।
ইতিমধ্যে বাবা অফিস থেকে কখন এসে বাড়ি ঢুকেছে এরা কেউ বুঝতে পারে নি।
---বাঃ তোর মা কল্পনা চাওলার নাম কোনদিন শোনেনি মনে হচ্ছে তৃষ্ণা। ভুলে গেছে কলম্বিয়া নামের সেই স্পেশ শিপে পুড়ে গিয়ে তাঁর আত্মার মহান হয়ে যাবার কথাটা। এই মহতী মহিলা নাসার হয়ে কলম্বিয়াতে করে মহাকাশে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় কোনও অশুভ কিছু হয় নি। কিন্তু ফেরার পথে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে কলম্বিয়া সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয় সঙ্গে কল্পনাকে নিয়ে সাত মহাকাশচারী।
কথাটা বলেই হাতের অ্যাটাচিটা ধপ করে বিছানায় ফেলে গলার টাই খুলতে লেগেছেন ভদ্রলোক।
বাবাকে গিয়ে তৃষ্ণা জড়িয়ে ধরে। বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, চিন্তা কি মা? মেয়ে আর ছেলে বলে ফারাক কিছু নেই আজকাল। তুই পারবি মহাকাশে যেতে। আর পারবি এই একশ বছরের মধ্যেই পৃথিবীর মানুষকে একটা বাসযোগ্য গ্রহ খুঁজে দিতে। হ্যাঁ, স্টিফেন হকিং-এর কথা আমি শুনেছি তো? কাগজেও পড়েছি। অফিসে অনেক আলোচনাও হয়েছে এ ব্যাপারে। তবে তারা সবাই হাসাহাসি করলেও আমি কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি মা হকিং সাহেবের আশংকার কথা। তা একশ বছর অনেক দেরি আছে। এর মধ্যেই তোকে তৈরি হয়ে যেতে হবে মা। তোকেই খুঁজে পেতে হবে সেই গ্রহ।
বাবার কথায় আনন্দ আর উৎসাহ খুব পেল তৃষ্ণা। কিন্তু সেই থেকে আর ঘুম নেই তার। বাবার উৎসাহ তাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কিন্তু সে তো অনেক দেরি। কলেজ, ইউনিভার্সিটি, রিসার্চ –সে তো অন্তত গোটা দশ বছরের ধাক্কা। তর আর সইছে না। যদি এক্ষুনি সে হাজির করতে পারত এমন একটা গ্রহ। রূপকথায় অনেক পক্ষীরাজ ঘোড়ার গল্প শুনেছে আর পড়েছে। আহা যদি এমন কোনও পক্ষীরাজ ঘোড়া পাওয়া যেত।
ছাদে মা শখ করে টবে অনেক বাহারি ফুলের গাছ লাগায়। বেশ ভাল লাগে তৃষ্ণার। সেই ফুলগুলোর ওপর কেমন বাহারে রঙিন ডানা মেলে প্রজাপতিরা এসে বসে। এ গাছ সে গাছ এ ফুল সে ফুল করে ঘুরে বেড়ায়। কী সুন্দর লাগে তার কে জানে। মোহিত হয়ে দেখে। আজও অন্যমনস্ক হয়ে একটা ফুল থেকে ফুলে উড়ে যাওয়া প্রজাপতিকে সাগ্রহে লক্ষ করছিল। কী সুন্দর আর স্বাধীন এরা। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কেমন অবাধে ঘুরে বেড়ায়।
তখন গরমের সময়। প্রচন্ড গরম। নাভিশ্বাস উঠছে মানুষের। সবাই বলছে গত বছরের থেকে গরম বেশি। আর আগামী বছর গরম নাকি আরও বাড়বে। রোদ পড়ে আসতেও গরম কমে না। ছাদেও ভ্যাপসা গরম। তাতে একটুও হাওয়া নেই।
কিছুক্ষণ ছাদে এদিক ওদিক পায়চারি করে আবার ঘরে ফিরে এ-সি-টা একটু অন করে কিছুক্ষণ বসে থাকবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু বসে পড়ল একটা ওলটানো ফাঁকা টবের ওপর। এই গরমে শরীর সর্বদাই যেন কেমন ক্লান্ত ক্লান্ত মনে হয়। এমন সময় কে যেন তার কানে কানে বলল, বিজ্ঞানীরা কি বলেছেন জানো না?
এদিক ওদিক কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু তবু বেয়াড়া প্রশ্নটা একটা কৌতূহলের রঙিন জামা পরে ঘুরতে লাগল তার মনের মধ্যে। খানিকটা নিজের মনেই প্রশ্ন করল, কী বলেছেন?
--বিজ্ঞানীরা মানে তোমাদের পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বলেছেন শক্তির অপচয় না করতে। কেননা শক্তি তৈরি করতেও পরিবেশ দূষণ হয় আর তাতেও গরম আরও বেড়ে যায়।
এবারও কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু গলাটা মনে হল একটা কচি মেয়ের। তার থেকেও আরও কম বয়েসের কারোর। কিন্তু ইগো বলে একটা কথা আছে। তার চেয়েও ছোট কেউ তাকে জ্ঞান দিয়ে যাবে এ তো হতে পারে না। একটু ঝাঁঝ নিয়ে বলল, জানি জানি। সব জানি। পদার্থবিদ্যার কথা আমাকে শিখিও না। আমি এবার হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছি। আর হাই ফার্ষ্ট ডিভিশন যাব সেটা জানো কি?
উত্তর নেই। অধৈর্য হয়ে আবার বলল, কে হে তুমি অমন আড়াল থেকে জ্ঞান দাও? একটা জেনারেল নলেজের বই পড়ে ওরকম তো অনেকেই অনেক কিছু বলতে পারে। সামনে এসে দেখা দিচ্ছ না কেন শুনি?
কিন্তু আবার সব চুপচাপ। এমন সময় সেই কথাটা মানে সেই ‘বিজ্ঞানীরা মানে তোমাদের পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা’ কথাটা মনে এসে গেল। তার মানে যে বলছে সে কি পৃথিবীর বাইরের কেউ? নাহলে একথা বলবে কেন? কিন্তু এদিক সেদিক তাকিয়েও তো কাউকেই দেখা যায় না।
এমন সময় চারদিক থেকে একটা মিষ্টি হাওয়া বইতে লাগল। গরমটা একটু কমে গেল। তৃষ্ণার মনে হল আরও খানিক ছাদে থেকে এই মিষ্টি হাওয়াটা উপভোগ করে। এমন সময় দেখল ভোঁ ভোঁ মিষ্টি একটা শব্দ করে কী একটা যেন উড়ছে ছাদের ওপর দিয়ে। গুবরে পোকা নাকি? এত বড়? আরে না না এটা একটা প্রজাপতি না মৌমাছির মত। মৌমাছির মত দেখতে কিন্তু প্রজাপতির মত বাহারে বিশাল ডানা। কিন্তু আকারেও বিশাল। যেন এক প্রজাপতি দৈত্য।
খুব ভয় হল তার। এ আবার কী অজানা উৎপাত। বাবাও এখনও অফিস থেকে ফেরেনি। বাবা থাকলে একটুও ভয় করে না সে। বাবা তার সাহস বাবা তার শক্তি। প্রজাপতিটা একটু কাছে আসতেই দেখল সেটা যেন হাসছে। খুব সুন্দর এক হাসি। হেসে সে বলল, হাই তৃষ্ণা!
অবাক হয়ে চোখের পলক না ফেলে কোনরকমে রিটার্ণ হাই করল তৃষ্ণা।
--আমাকে ভয় পেতে হবে না। আমি মহাকাশের পাখি। সারা মহাকাশ ঘুরে বেড়াই। যাই বিভিন্ন নক্ষত্র মন্ডলের বিভিন্ন গ্রহে। এই যেমন আজ এসেছি তোমাদের পৃথিবীতে।
ভয় আর জড়তা অনেকটা কেটে গেল তৃষ্ণার। কিন্তু কৌতূহল মাথা চাড়া দিয়ে উঠল আবার। বলল, তুমি মহাকাশের ঘুরে বেড়াও? মহাকাশের সব খবর রাখ?
খুব মিষ্টি করে হেসে প্রজাপতি বলল, বটেই তো। কী জিজ্ঞেস করবে কর না?
--আচ্ছা এই যে আমাদের গ্রহটা মানে পৃথিবী। তার মত আর কোনও গ্রহ আছে মহাকাশে? জল আছে বাতাস আছে আর আছে এমন সুন্দর একটা সাদা তারাভর্তি নীল আকাশ?
পাখা নেড়ে নেড়ে আনন্দ করতে করতে প্রজাপতি বলল, আছে আছে। খুব আছে।
মনে মনে দারুন উৎসাহিত হয়ে পড়ল তৃষ্ণা। তার মানে পৃথিবী ধ্বংস হলেও তাদের কোনও ক্ষতি নেই। সেই ‘আর একটা গ্রহে’ চলে যেতে পারবে সবাইকে নিয়ে।
--তবে একটু খুঁজে নিতে হবে।
নিরুৎসাহিত হল তৃষ্ণা। সে আবার কি। প্রজাপতি বলল, সে তো বটেই গো? শুধু খুঁজে পেলেই হবে না। তাকে তৈরিও করে নিতে হবে নিজের মত করে।
--বুঝলাম না তো ঠিক?
---এই যে তোমাদের পৃথিবীটা –বল তো এটা তোমাদের মত করে গড়ে নিতে কত কোটী বছর লেগেছে? তোমাদের এই সভ্যতা গড়ে উঠতে কত বছর লেগেছে?
তা অবশ্য ঠিক। তৃষ্ণা ভেবে দেখল। গ্রহ তো আর হাতে গরম ফুচকা নয় যে শালপাতা ধরে থাকলেই একটা টুপ করে এসে পড়বে। তবে কি—
প্রজাপতি বলল, মন খারাপ করার কিছু নেই দিদিমণি। আগে তো বরং দেখেই এস গ্রহটা। পছন্দ হলে নয় পরিষ্কার ঝরিষ্কার করে নিজেদের মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে। তোমরা খুব বুদ্ধিমান আর বিজ্ঞান জানা লোক। তোমাদের বেশি সময় লাগবে না।
--আগে বরং দেখে এস মানে? তুমি কি মহাকাশে সেই গ্রহ দেখাবে নাকি?
--হ্যাঁ তা তো দেখাতেই পারি। তবে তার জন্যে তো তোমাকে আমার পিঠে একটু কষ্ট করে বসতে হবে ভাই?
উঠে বসতে একটুও কষ্ট হল না কিন্তু তৃষ্ণার। নরম মখমলের মত প্রজাপতির পিঠটা। তার আবার পাখির মত পালকে ভরা লেজ। লেজের একটা নরম পালক তৃষ্ণার পিঠের কাছে খাড়া করে দিতেই সে দিব্বি ঠেসান দিয়ে বসল। বসে ভারি মজা পাচ্ছে। এবার ওড়া কেমন লাগবে কে জানে। কিন্তু সেকথা ভাবতে না ভাবতেই আকাশে বিরাট উঁচুতে সে উঠে পড়েছে। তার বাড়ি বা রাস্তা তো দূরে থাক পৃথিবীটাই দেখাচ্ছে ছোট্ট একটা বলের মত। আর কোথায় সেই নীল আকাশ। চারিদিক অন্ধকার। তবে সেই অন্ধকার আকাশেও কিন্তু তারারা ঝিকিমিকি খেলে বেড়াচ্ছে। বাবা এত তাড়াতাড়ি চোখের পলক ফেলার আগেই সম্পূর্ণ অন্য এক জগতে সে চলে এল!
--আমরা তোমাদের সৌরজগত ছাড়িয়ে এসেছি গো দিদিমণি। এখানের আকাশ নীল নয়। এখানে কোনও ধুলিকণা নেই যার ওপর সূর্যের আলো পড়ে বিক্ষেপন হয়ে নীল আলো তোমার চোখে আসবে।
তৃষ্ণা তো ভেবেই পায় না এই সামান্য প্রজাপতি ফিজিক্সের এত তত্ত্ব জানল কি করে? উত্তর দিল প্রজাপতিই, আমি সামান্য প্রজাপতি নই গো দিদিমণি। আমি একজন বিজ্ঞানী। আমি একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী মানে স্পেশ সায়েন্টিস্ট। আমাদের গ্রহে সব প্রাণী আমার মত দেখতে। তারাও সারা মহাকাশ উড়ে বেড়াতে পারে। আমাদের রিমোট সেন্সিং মানে দূর থেকে সব বুঝে নেবার ক্ষমতা তোমাদের পৃথিবীর অন্তত এক কোটী গুণ। সেখান থেকেই আমি তোমার সব কথা জানতে পেরেছি। তোমাদের বিজ্ঞানী হকিং সাহেবের কথাও। বুঝেছি তুমি বড় হয়ে একটা নতুন গ্রহ খুঁজতে চাও। তা আমি ভাবলাম যদি আমাদের এই গ্রহ তোমাদের ভাল লাগে তো আমরা ভাগ দিতে পারি।
দেখতে দেখতে সেই নতুন গ্রহ এসে হাজির। প্রজাপতি বলল, এই গ্রহ কিন্তু তোমাদের পৃথিবীর থেকে প্রায় এক লক্ষ গুণ বড়।
ওপর থেকে সব গ্রহটা পাক খেয়ে খেয়ে দেখাতে লাগল প্রজাপতি। এ মা কী বিচ্ছিরি। গাছ নেই পালা নেই হাওয়া নেই আলো নেই জল নেই। আর কী বিদকুটে গন্ধ। তৃষ্ণা বলল, আমাদের পৃথিবীর লোক এমন গ্রহে থাকতে পারবে না। আমাকে অন্য গ্রহ দেখাও। দূর এই গ্রহে কি মানুষ থাকে?
--বেশ তবে আর একটা দেখ। বলে প্রজাপতি তাকে পিঠে করে নিয়ে গেল অন্য এক গ্রহে। কিন্তু গ্রহ কোথায়? এ যে বিরাট বড় অন্ধকারের পুঁটলির মত। কিন্তু প্রজাপতি হুড় হুড় করে নামছে সেদিকেই। তৃষ্ণা ভয়ে কাঠ হয়ে বলল, ওখানে যাব না ওটা ভূতের গ্রহ।
---ভূতের গ্রহ? তুমি হাসালে দিদিমণি। ভূতটা আবার কী গো? আমি এত বড় বিজ্ঞানী কিন্তু কোনদিন ভুতের নাম তো শুনিনি?
গ্রহটা যতই কাছে আসছে ততই কেমন শোঁ শোঁ গোঁ গোঁ শব্দ আসছে সেই জমাট অন্ধকার থেকে। মাঝে মাঝে চিড়িক চিড়িক করে জ্বলে উঠছে আলোর ফুলকি। তৃষ্ণা কল্পনা করে নিল ওগুলো সব ভূতের ডাক। এরপর হয়ত নাচবে কংকাল। দাঁত বার করে হি হি অট্টহাসি।
--ভূ ভূ ভূত। আমি ঐ গ্রহে যাব না। চীৎকার করে কেঁদে উঠল সে। হো হো করে হেসে প্রজাপতি বলল, বিজ্ঞানে ভূত বলে কিছু হয় না তা জানো না দিদিমণি?
হুড়হুড় করে নেমে গেল সে গ্রহে।
শুধু গাছ আর গাছ। বিশাল বড় বড় গাছের জঙ্গল সারা গ্রহটা। এক একটা গাছ প্রায় সাততলা দশতলা বাড়ির সমান উঁচু। নক্ষত্রের আলো ঢুকতেই পারছে না সেই গাছের পাতা আর ডালপালা ভেদ করে। সেই অন্ধকারে বিশাল বিশাল জোনাকি জ্বলছে। তৃষ্ণার মনে হল ওগুলো ভূতের জ্বলন্ত চোখ। চোখ বুজে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, এই গ্রহে আমি থাকব না। পায়ে পড়ি তোমার আমাকে নিয়ে চল।
এরপর প্রজাপতি তাকে নিয়ে চলল আর একটা গ্রহের দিকে। কিন্তু সে গ্রহে আবার কোনও গাছপালাই নেই। শুধু তার বুকে রয়েছে একটা যেন অগ্নিপিন্ড। কী আগুনের হলকা। একটা বিশাল মরুভূমিতে বিরাট অগ্নিকান্ড হলে যেমন হয় তেমন। যত নিচে নামছে ততই তাপটা অসহ্য হয়ে উঠছে।
--না না এখানে থাকব না এত গরম সহ্য হবে না আমাদের। আমরা এত গরম সইতে পারি না। আমাদের পৃথিবীতে গরম বেড়ে যাচ্ছে বলেই তো আমরা নতুন গ্রহ খুঁজতে এসেছি নাকি? এতবড় সায়েন্টিস্ট হয়েছে আর এইটা বোঝ না? খুব বিরক্ত হয়ে কথাটা বলল তৃষ্ণা।
বিরক্ত হল প্রজাপতিও। বলল, তাই তো বললাম দিদিমণি আমাদের গ্রহে চল। অনেক বড় গ্রহ। তোমাদের সকলকে ধরে যাবে। তা তুমি তো চাইলে না সেটা।
--না না আর একটা দেখাও—
--না না আর হবে না। আমার ডানা ব্যথা করছে উড়তে পারছি না। তুমি নামো।
নামবে? এই অগ্নিকুন্ডে! ভেবেই তো হাত-পা সেঁদিয়ে এল তৃষ্ণার। বলল, না-না—
প্রজাপতি ডানা ঝাঁকাল। তৃষ্ণা পড়ে গেল পিঠ থেকে। প্রজাপতি উড়ে চলে গেল তার নিজের গ্রহের দিকে। আর তৃষ্ণা পড়তেই থাকল। পড়ছে আর ভাবছে। প্রজাপতি চলে গেল তো সে পৃথিবীতে ফিরবে কী করে? ইস বাবা অফিস থেকে ফিরে তাকে দেখতে না পেলে কি করবে? মা তো কেঁদেই মরবে। মা তো আবার গরম পকোড়া করছিল তার জন্যে। এখন কী হবে?
--না না আমি এ গ্রহে নামব না। আমি পড়তে চাই না পড়ব না বুঝলে তুমি? আমি পড়ব না। প্লিজ তুমি ফিরে এসে আমায় নিয়ে যাও প্রজাপতি---
এদিকে সে নীচে তো পড়েই যাচ্ছে। যত নামছে ততই গরম বাড়ছে। আগুনের হলকা। শেষে পড়ল একটা দারুণ গরম চাতালে। সারা দেহ তার যেন জ্বলে যেতে লাগল।
চোখ মেলতেই দেখল মা সামনে দাঁড়িয়ে।
--কী রে এমন পড়বি না পড়বি করছিলি কেন?
সেই ঠান্ডা হাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেছে। একটু বোধহয় ঢুলুনি মতন এসে গিয়েছিল। আর তার চোটেই গড়িয়ে একেবারে ছাদের মেঝেয়। ছাদ আবার মোজেক টালি করা। তেতে একেবারে আগুন।
--ঐ পাশের বাড়ির বিল্টু বলছিল ওর কাছে একটা কমিক্সের বই আছে আমি পড়ব কিনা। তৃষ্ণা বলল, কিন্তু আমার তো এখন কলেজের ফাস্ট ইয়ারের পড়া ধরার কথা মা। তাই ওকে বলছিলাম কমিক্স এখন পড়ব না।
--কিন্তু ছাদের এই গরম মেঝেতে শুলি কেন?
--কিছু নয় মা। একটু হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম তো তাই। তোমার পকোড়া হয়ে গেছে?
ঝুলন্ত শবদেহ
তাবাসসুম
সুভদ্রার শরীরটা ভয়ে কাঁপছে, এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে সে। বিশ্বাস করার মত সবকিছু আজ চোখের সামনে অন্ধকার। পৃথিবীটা যেনো হিংস্র লালসার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। ভাবতে পারছে না কিছু আর, মাথার ভিতর ঝিমঝিম করছে। নিজের ওপর ধিক্কার হচ্ছে, মেয়ে বলে জিবনে প্রথম আজ অসহায় বোধ করলো। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বাইরে যাবে কিভাবে ও। সমাজে মুখ দেখাবে কি করে! নিজেরই তো ঘেন্না আসছে এই শরীরটার প্রতি। না ভেঙে পড়লে চলবে না, সে নিজেকে শক্ত করে নিল। মনে মনে ভেবে নিলো তাকে এবার কি করতে হবে। পোশাকটা বিছানার একপাশে পড়ে ছিল, সেটা পরে নিয়ে দরজা খুললো। বাইরেটা ভীষণ উজ্জ্বল, সূর্য্য বোধ হয় আজ একটু বেশিই তেজ দিচ্ছে। মাথার ভেতর টা কেমন জানি ঘুরে উঠলো,দেওয়ালে ভর করে নিজেকে সামলে নিলো সুভদ্রা, তারপর রাস্তার মাঝে মিলিয়ে গেলো অজস্র মানুষের ভিড়ে।
.……....................…..............……....….........
জন্মের সময় বাবা কাছে ছিল কি না জানে না সুভদ্রা, তবে জ্ঞান হবার পর থেকে বাবাকে কখনো দেখেনি।মাকে নিয়ে একটা ছোট বাড়িতে সুভদ্রা থাকে। মা স্কুলের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষিকা। সেখান থেকে যা স্যালারি পায় তাতেই তাদের দুজনের স্বচ্ছল সংসার চলে যায়। সুভদ্রা আগের বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে বাংলা অনার্স নিয়ে। সাহিত্যের প্রতি তার খুব অনুরাগ। একটু একটু লিখতও। কয়েকবার স্কুল ম্যাগাজিনে কবিতা প্রকাশ করেছে। কলেজে আসার পর সাহিত্যে অনুরাগ টা আরো দৃঢ় হয় সুভদ্রার। বাংলা অধ্যাপক সুবিমল বসু খুব ভালো পড়ান, সেই সঙ্গে তিনি একজন কবিও বটে। সুভদ্রা কে সব সময় উৎসাহ দিতেন লেখার জন্য, তার নাকি সম্ভবনা আছে অনেক। উৎসাহ পেয়ে লিখতে শুরু করে সুভদ্রা, কয়েক টা লেখা প্রকাশও করে দিয়েছেন স্যার বিভিন্ন পত্রিকায়। আগ্রহ বাড়তে থাকে লেখার প্রতি, স্যারের সঙ্গেও বেশ ক্লোজ হতে থাকে সুভদ্রা।
এভাবেই চলছিল কিছুদিন। তারপর সবকিছু কেমন জানি হতে লাগলো, সুভদ্রা কে কখনো পড়ার বিষয়ে কখনও বা লেখালিখির বিষয়ে ডাকতে লাগলো যখন তখন। পত্রিকার বিষয় নিয়ে বাড়িতেও ডাকতে লাগলেন স্যার। বাড়িতে কেউ থাকতো না, স্যার একাই থাকতেন। পরিবার গ্রামের বাড়িতে থাকে বলে সুভদ্রা জানত। ঠিক এমনই একদিন কলেজে স্যার সুভদ্রা কে বললেন," রবিবারে বাড়িতে এসো, বেশ কিছু সাহিত্যিক ব্যক্তি আসবেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।তুমি আসলে অনেক কিছু শিখতে পারবে"।
রবিবার বেলা 11টা সুভদ্রা মাকে বলে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু গিয়ে দেখে কোথায় কি, স্যার একা বসে কি একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। ওপরে নগ্ন নারীর ছবি সব, তাকিয়েই কেমন গা গুলিয়ে গেলো। স্যার ওকে দেখে বললেন,
---"এসো এসো, বসো এখানে।"
--- "কিন্তু স্যার.... আপনি যে বলেছিলেন অনেক সাহিত্যিক ব্যক্তি আসবে।"
--- হ্যাঁ,বলেছিলাম। এত তাড়াহুড়ো কি আছে। উনারা এসে পড়বেন যেকোনো সময়। চা খাবে?
মিনিট পাঁচেক পর একজন পরিচারিকা এসে চা দিয়ে গেলেন।চা খাবার পরের মাথার ভেতর কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো.....তারপর আর কিছু মনে নেই।যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে বেডের ওপর নগ্ন অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করে। কোনো কিছুই বুঝতে বাকি রইলো না সুভদ্রার। নিজের ওপর রাগে ঘেন্নায় মরমে মরে যাচ্ছিলো সে।
.……....................…..............……....….........
স্যারের বাড়ি থেকে ফিরে এসে সোজা বাথরুম গিয়ে ঢুকলো সুভদ্রা। অনেকক্ষন ধরে স্নান করল,তারপর বেরিয়ে এসে নিজের পরিকল্পনার দিকে মনোনিবেশ করল, ঘর অন্ধকার।তার মুখটা এখন দেখা যাচ্ছে না,কিন্তু দেখা গেলে যে কেউ বুঝতে পারতো মুখের ওপর কি ভয়ংকর এক দানবের প্রতিচ্ছায়া দেখা যাচ্ছে।
.……....................…..............……....….........
প্রায় মাস তিনেক পর। খবরের কাগজে বড়ো বড়ো করে লেখা বেরোলো অধ্যাপক সুবিমল বসু খুন হয়েছেন, যৌনাঙ্গ কেটে তাকে খুন করা হয়। শরীরের ওপর এলোপাথাড়ি ছুরির আঘাত।
তারপরের দিনই আর একটা লাশ মিলল একটি মেয়ের, কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুভদ্রার মৃতদেহ উদ্ধার করলেন তার ঘরের সিলিং ফ্যানে আটকে থাকে ওড়নার গিটবন্ধন থেকে, দড়ি হিসাবে সেটাকেই কাজে লাগানো হয়েছিল...।।
লাথি
~ আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
"কি গো দাদি,কি করছ?"
"বিড়ি বাঁধছি।আয়।বোস।"
জরিনার এটা নিজের দাদি নয়।তার নিজের দাদি নেই।অনেক দিন আগে স্তন ক্যানসারে মারা গেছে।জরিনার এটা পাড়া দাদি।নাম নূর বিবি।
জরিনা বসল গিয়ে,"কেমন আছো?"
"ভালো আছি।তুই ভালো আছিস?"
"হ্যাঁ দাদি,ভালো আছি।"
নূর বিবি তখন বলল,"তোদের যে এখন ভালো থাকারই বয়স।তা ভালো তো থাকবিই।" তারপর বলল,"তা হ্যাঁ রে জরিনা,শুনলাম তোর বলে বিয়ের কথা আলোচনা চলছে?কাল বলে তোকে দেখতে লোক আসবে?তা সত্যি আসবে নাকি?"
জরিনা বলল,"হ্যাঁ, আসবে।"
নূর বিবি তখন বলতে লাগল,"তা এখুনি বিয়ে করে ফেলবি?সে কি রে ! সবে তো ক্লাস নাইনে উঠলি।কলেজে পড়বি না?"
জরিনা বলল,"পড়ার ইচ্ছে তো ছিল।কিন্তু মা আর না পড়ালে কি করে পড়ব?"
"তোর মা'র কথা তুই শুনবি কেন?সে পড়াশোনার মূল্য কি বোঝে?"
জরিনা তার উত্তরে বলল,"মা'র-ও হয়তো পড়ানোর ইচ্ছে ছিল।কিন্তু না পারলে কি করে পড়াবে?মা-র অবস্থার কথাও তো দেখতে হবে। মায়ের সঙ্গে জুলুম করে শুধু পড়লে তো হবেনা। বাপ বেঁচে থাকলে অবশ্য এখন বিয়ে দিত না। আমিও বিয়ে করতে রাজি হতাম না।মা'র হঠাৎ যদি এখন কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার কে বিয়ে দিবে?চতুর্দিক ভেবে চিন্তে দেখে বিয়ে করতে রাজি হলাম।"
নূর বিবি অমনি টপ করে বলে ফেলল,"কেন,আমরা ছিলাম না?আমরা তোর বিয়ে দিতাম। আমরা বুঝি তোর কেউ না!"
জরিনা বলল,"কেউ হবেনা কেন?আমি কি বলেছি,কেউ হও না?"
নূর বিবি বলল,"মুখে না বললে কি হবে?তোর কথা থেকে সেটাই বোঝা যাচ্ছে।যাইহোক, কোন দেশে বিয়ের কথা আলোচনা চলছে তাই বল।"
জরিনা বলল,"গ্রামের নাম রূপ খালি। বর্ডারের কাছে।"
নূর বিবি বলল,"অতদূরে বিয়ে করবি?যদি তোকে মেরে দেয়?তা অতদূরে কে বিয়ে লাগাল শুনি!"
জরিনা বলল,"সম্পর্কে আমার খালুজি হয়।"
"তোর মায়ের কি বুদ্ধি সুদ্ধি নেই?অতদূরে কেউ মেয়ের বিয়ে দেয়?যেতে পারবে তো?বাসে তো চাপতে পারেনা।বমি করে।মাথা ঘোরে বলে। তাহলে একটা মেয়ের বিয়ে অতদূরে দেওয়া কেন? তা ছেলে কি করে?"
"কি করবে?জমিতে চাষ আবাদ করে।"
"তারমানে ছেলে মাঠে খাটে তাইতো?"
"হ্যাঁ।"তারপর জরিনা বলল,"তাছাড়া আমাদের মতো গরিব ঘরের মেয়েছেলেদের কি চাকরি করা ছেলের সাথে বিয়ে হবে?কোন দিনই হবেনা।"
নূর বিবি সেটা মানতে পারল না।সে বলল,"না হওয়ার কি আছে।কপালে থাকলে হতেও পারে।"
জরিনা বলল,"যদিওবা হয় লাখে একটা। ওকে হওয়া বলে না।"
"বেশ, তোর কথাই ঠিক হল।"জরিনার কথা নূর বিবি পরে মেনে নিল।নিয়ে বলল,"ছেলে দেখতে ফর্সা তো?"
"খুব একটা ফর্সা হবেনা।সে না হোক।ওতে অসুবিধা নেই।আমি তো ফর্সা আছি।"
শুনে নূর বিবি চমকে উঠল,"কি বললি!ছেলে ফর্সা হবেনা?তোর মতো মেয়ে শেষে মাঠে খাটা কালো কুচ্ছিত একটা রাখালকে বিয়ে করবি?ছি:! ছি:!ছি:!"
জরিনা বলল,"তুমি যত কালো বলছ,অত কালো হবেনা।"
"তুই দেখেছিস?"
"দেখিনি।"
"দেখিসনি তো বলছিস যে?"
"আমার সেই ঘটক খালুজির মুখে শুনেছি।"
"তারমানে আমি যা বলেছি তার থেকে আরো বেশি কালো হবে ধর।ঘটকরা কোনদিন সত্যি কথা বলে না।তোকে ওরকম বলেছে তাই। আমি বলছি, তুই ও ছেলেকে বিয়ে করিসনা। কালো ছেলে বিয়ে করে জীবনে সুখী হতে পারবিনা।আমার কথা শোন।টাকা পয়সা লাগছে না নাকি?"
"তো লাগছে না?টাকা ছাড়া আজকাল বিয়ে আছে নাকি?পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ লাগছে। বাপের তো কিছু ছিল না।ভিটা মাটি টুকু ছাড়া। তবে মা তার বাপের মাঠান পাঁচ কাঠা জমি পেয়েছে।ওই জমিটা বিক্রি করে আমার বিয়ের টাকা দিবে।"
টাকা লাগার কথা শুনে নূর বিবি আরো চমকে উঠল,"কি বললি!পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগছে!"তারপর সে বলল,"টাকা দিয়ে কালো ছেলে বিয়ে করবি কেন?টাকা যদি দিতেই হয় একটা ভালো ফর্সা ছেলেকে দিবি।তোর মা না হয় স্কুলে লেখাপড়া করেনি।তার বুদ্ধি সুদ্ধি কম থাকতেই পারে। তুই তো লেখাপড়া করেছিস।তা-ও তোর বুদ্ধি এত কম!"
"কি করব বলো।আমার কপালে যদি কালো ছেলে লেখা থাকে ফর্সা ছেলে পাবো কোথায়?"
নূর বিবি অমনি মুহূর্তের মধ্যে জরিনার কথা উড়িয়ে দিল,"ছাড় তোর কপাল!আমার কথা শুনে ও ছেলেকে তুই বিয়ে করবিনা।ফর্সা ছেলে বিয়ে কর।"
জরিনা বলল,"তোমার কথা শুনে করব তো ফর্সা ছেলে পাবো কোথায়?তোমার হাতে আছে নাকি?"
"আমার হাতে আছে কি রে ! আছেই তো।না থাকলে বলব কেন?দেখতে খুব সুন্দর একটা ছেলে আছে আমার হাতে।একেবারে নায়ক।তোর সাথে দারুণ মানাবে।রোজগারও করে খুব ভালো। তোর কোন জিনিসের অভাব রাখবে না।পাকা বাড়ি।বাড়ির ভিতরেই পায়খানা, বাথরুম।মাঠে পায়খানা ফিরতে যেতে হবেনা।নিজস্ব মোটরসাইকেল আছে।মোটরসাইকেলে চেপে দু-জনে হলে সিনেমা দেখতে চলে যাবি।আহা,কি সুখ!"
জরিনা বলল,"ছবি আছে?"
"থাকবেনা কেন?ঘরে বাক্সের ভিতর ঢোকানো আছে।বের করে এনে তোকে এক্ষুনি দেখাচ্ছি।" নূর বিবি অমনি ঘরের ভিতর থেকে বাক্স খুলে ছবিটা বের করে এনে জরিনাকে দেখাল,"দ্যাখ!"
জরিনা ছবিটা হাতে নিয়ে দেখল।পরনে নীল জিনস প্যান্ট।গায়ে রঙিন শার্ট।চোখে চশমা পরে বাইক চালাচ্ছে।দেখতে দেখতে জরিনা একবার নূর বিবির দিকে তাকাল।
নূর বিবি বলল,"দেখতে নায়ক নয়?"
জরিনা মুচকি হেসে বলল,"হ্যাঁ।"
নূর বিবি এবার ছবিটা তার হাত থেকে নিয়ে বলল,"এই ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে লাগাব।"
"লাগাও।"জরিনা তখন মুখে বিয়ে লাগাতে বললেও পরে বলল,"বড়লোকের ছেলে আমার মতো গরিব মেয়েকে বিয়ে করবে?
নূর বিবি বলল,"করবে।"
"করবে?"
"হ্যাঁ, করবে।"
জরিনা বলল,"করেও যদি টাকা বেশি চাইবে। আমার মা কি বেশি টাকা দিতে পারবে? তাহলে বিয়ে আর হচ্ছে না।"
নূ্র বিবি তখন অমনি বলে দিল,"অত চিন্তা করছিস কেন?এক টাকা চাইবে না।তোকে শুধু বিয়ে করবে।"
"তোমাকে বলেছে?"
"না বললে জানলাম কি করে?কালই তো ফোন করেছিল।কথা হল।একটা ভালো মেয়ে দেখতে বলল আমাকে।বলল কোন টাকা পয়সা লাগবে না।শুধু মেয়েটা ভালো চাই।গরিব ঘরের মেয়ে হলেও কোন অসুবিধা নেই।তাই তোকে বলছি, ওই কালো ছেলে তুই আর বিয়ে করিস না। রাকিবকে বিয়ে কর।কথায় আছে কি জানিস,সুন্দর স্বামীর কাছে থাকা আর স্বর্গে থাকা এক জিনিস।এক বেলা খেতে না পেলেও শান্তি। বুঝলি?"তারপর বলল,"রাকিব কে চিনতে পারলি?"
জরিনা বলল,"কে?"
নূর বিবি বলল,"যার ছবি দেখলি।আমার বাপের দেশে বাড়ি।সম্পর্কে আমার ভাই হয়।থাম,রাকিবকে একবার ফোন লাগিয়ে দিই।কথা বল।"
জরিনা ফোন লাগাতে নিষেধ করল,"থাক,এখন ফোন লাগাতে হবেনা।আমি ফোনে কথা বলব না।লজ্জা লাগবে।"
"ফোনে কথা বলবি তো লজ্জা কি?"নূর বিবি শুনল না।অমনি সে ফোন লাগিয়ে দিল।
"হ্যালো!"ফোন রিসিভ হল।
"কে,রাকিব?"নূর বিবি বলল।
"হ্যাঁ, বলো।"
"বলছি,তুই একটা মেয়ে দেখতে বলেছিলি না আমাকে?তো আমি একটা মেয়ে দেখেছি।মেয়ে দেখতে খুব সুন্দর।আমাদের নিজেদের মধ্যে। ব্যবহারও খুব ভালো।যাকে বলে অমায়িক মেয়ে। বিয়ে করলে তুই জীবনে সুখী হতে পারবি।জীবনে শান্তি পাবি। সে এখন আমার কাছে বসে আছে। কথা বল..." বলতে বলতে নূর বিবি জরিনাকে টপ্ করে ফোনটা দিয়ে দিল,"নে জরিনা,কথা বল।"
জরিনা আর না বলতে পারল না।ফোনটা হাতে নিয়ে কানে ধরে সে "হ্যালো" বলল।
"কে,জরিনা?"
"হ্যাঁ।কিন্তু আপনি কি করে জানলেন, আমার নাম জরিনা?"জরিনা বলল।
"এক্ষুনি নূর বিবির মুখে শুনলাম না?"
"ও,আচ্ছা।"
"তোমার নামটা কিন্তু দারুণ!"
জরিনা হাসল।
রাকিব বলল,"আমার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, জরিনা।তুমি দেখতেও দারুণ।তাই আমি তোমাকেই বিয়ে করব।"
জরিনা বলল,"দাদির মুখে আপনার অনেক গল্প শুনলাম।এবং আপনার ছবি দেখলাম। আপনি বড়লোকের ছেলে।এবং দেখতে খুব সুন্দর।আপনি কি আমার মতো গরিব মেয়েকে বিয়ে করবেন?"
"বিশ্বাস হচ্ছে না?তুমি ওখানেই বসো।আমি এক ঘণ্টার মধ্যে চলে আসছি।আর হ্যাঁ, ফোনটা নূর বিবিকে একটু দাও।তার সঙ্গে জরুরি দুটো কথা আছে।বলে নিই।"
জরিনা নূর বিবিকে ফোনটা দিল,"নাও,দাদি। তোমার সঙ্গে কথা বলবে।"
নূর বিবি ফোনটা হাতে নিয়ে কানে ধরে একটু সরে গেল,"কি বল।"
"তুমি এক্ষুনি জরিনাকে এক কাপ চায়ের সঙ্গে ট্যাবলেটটা গুলে খাইয়ে দাও।দিয়ে তোমার কাছে বসিয়ে রাখো।আমি এক্ষুনি চলে আসছি।"
"ঠিক আছে।তাড়াতাড়ি আয়।"
সঙ্গে সঙ্গে রাকিব লাইন কেটে দিল।নূর বিবি জরিনাকে তখন বলল,"রাকিব আসছে।তুই একটু আমার কাছে বোস।আর হ্যাঁ, তোকে এক কাপ চা বানিয়ে দিই।খা।"
জরিনা বলল,"তা বানাও,খাই।"
নূর বিবি এবার ঘর থেকে এক কাপ চা বানিয়ে আনল।জরিনা চা খেতে শুরু করল।খেতে খেতে বলল,"চা খেতে খুব একটা ভালো লাগছে না, দাদি।মন বলছে, ফেলে দিই।"
নূর বিবি বলল,"আমি কি আর তোদের মতো অত ভালো চা বানাতে পারি?ফেলবি কেন, খেয়ে নে।আমি তোর জন্য কষ্ট করে বানালাম।খেলেই কাজ দেবে।"
নূর বিবির কথায় জরিনা খেয়েই নিল।সে তাকে বুঝতেই দিল না যে,চায়ের সঙ্গে সে একরকম একটা ট্যাবলেট মিশিয়ে দিয়েছে।যা খেলে মেয়েদের শরীরে ও মনে অকস্মাৎ কামক্ষুধা জেগে ওঠে।কোন পুরুষ তার সঙ্গে তখন অনায়াসে মিলিত হতে পারে।তাই চায়ের স্বাদ তাকে বিস্বাদ লাগছে।
দুই
সাদা রংয়ের একটা আর টি আর মোটরবাইকে চেপে রাকিব চলে এল।এসে বাইকের উপর থেকে কায়দা করে নামল।ছবিতে আগে দেখা ছিল বলে জরিনা তাকে দেখেই চিনতে পারল।সত্যি সে নায়ক একটা।
রাকিবের তাকে আগে দেখা ছিল না।তবু তার তাকানো আর লাজুক হাসি দেখে রাকিব তাকে ঠিকই চিনতে পারল।এরপর সে তাকে বলল,"আমি বলেছিলাম না, আমি আসব?এলাম?"
জরিনা মুখ টিপে হাসল।
রাকিব বলল,"আমি মুখে যা বলি কাজেও তাই করি।অন্য কোন প্রেমিকের মতো আমি শুধু মুখেই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে প্রেমিকার মন ভোলাই না।"
জরিনা এবারও হাসল।
রাকিব তার সেই হাসি দেখে বলল,"অপূর্ব!" ও সে পরে নূর বিবির উদ্দেশ্যে বলল,"কই গো,বসতে জায়গা টায়গা দেবে না নাকি?"
নূর বিবি তাদের বসার জন্য একটা বন্ধ ঘরের দরজা খুলে দিল।দিয়ে বলল,"তোরা এই ঘরে বোস।বসে গল্প কর।আমি বাইরে আছি।কোন প্রয়োজন হলে জানলা দিয়ে টুক করে ডাকবি। তাহলেই আমি দরজা খুলে দেব।"
ভিতরে তারা ঢুকে গেল।পরে নূর বিবি বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।ভিতরে একটা চৌকি আর দুটো বালিশ ছাড়া কিছু নেই।নিচে পা ঝুলিয়ে চৌকির উপর তারা বসল।বসে রাকিব বলল,"আমি যে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসি এবার সেটা প্রমাণ হল তো?"
নত মুখে জরিনা বলল,"হল।"
রাকিব জরিনার চিবুক ধরে তখন বলল,"তুমি খুব সুন্দর, জরিনা।দেখতে তুমি দারুণ সুন্দর। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।"
জরিনা বলল,"আমাকে তাহলে বিয়ে করবেন তো?"
"করবো না তো কেন এসেছি?..."বলতে বলতে রাকিব জরিনার মাথার চুলের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে চুল নাড়তে লাগল।নাড়তে নাড়তে বলল,"তোমার মাথার চুল খুব সুন্দর!"তারপর নাকে শুঁকে ঘ্রাণ নিয়ে বলল,"আ:,কি সেন্ট ! চুলে কি মেখেছ?"
জরিনা বলল,"কি মাখব?কিছু মাখি নি।"
রাকিব এবার জরিনার হাত ধরল।ও তার হাতের আঙুল নাড়ল।নাড়তে নাড়তে বলল,"তোমার হাতের আঙুল গুলোও কি সুন্দর!"
জরিনা এবার চুপ করে থাকল।
রাকিব এরপর জরিনার ঠোঁটে হাত দিল,"তোমার ঠোঁটও দারুণ!"
জরিনা এবারও কিছু বলল না।এবারও চুপ করে থাকল।ও চৌকির উপর শুয়ে গেল।
তার চুপ করে থাকা ও কিছু না বলা আর চৌকির উপর শুয়ে যাওয়া দেখে রাকিব বুঝতে পারল ওষুধের কাজ শুরু হয়েছে।রাকিব তখন আর দেরি করল না।তার চোখের আর মনের নেশা মেটাতে শুরু করল।....
এরপর সন্ধ্যার আঁধার যখন নেমে এল রাকিব তখন জরিনাকে বলল,"তোমার সঙ্গে আমার যখন শারীরিক সম্পর্ক ঘটেই গেল তখন আমি তোমাকে আর রেখে যাবোনা,জরিনা। তোমাকে আমি সঙ্গে করে নিয়েই যাবো।নিয়ে গিয়ে তোমাকে আমি আজকেই বিয়ে করব।তুমি কি বলছ,বলো।"
জরিনা বলল,"আমি কি বলব?"
"তাহলে আজকেই আমার সঙ্গে তোমাকে যেতে হবে।"
জরিনা এক কথায় রাজি হয়ে গেল,"যাবো।"ও রাকিবের হাত দুটো ধরে পরে বলল,"নিয়ে গিয়ে আমাকে কষ্ট দিও না যেন।আমি তোমাকে বিশ্বাস করে-------"
রাকিব বলল,"কষ্ট দেব না।কষ্ট দেব কেন?"
"ঠিক আছে।চলো তাহলে।"জরিনা বললে পরে রাকিব সঙ্গে সঙ্গে জানলা দিয়ে মুখ বের করে নূর বিবির উদ্দেশ্যে বলল,"কই গো,আছো নাকি?"
নূর বিবি সঙ্গে সঙ্গে জানলায় চলে এল,"হ্যাঁ, আছি।"
"তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দাও।"
নূর বিবি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল।
রাকিব তখন তাকে বলল,"আমরা এক্ষুনি বেরিয়ে যাবো।"
রাকিবের বলা শেষ হলে পরে জরিনা বলল,"মা তো খুব খোঁজাখুঁজি করবে।এবং কান্না কাটি করবে।তুমি মাকে বুঝিয়ে রেখো।"
নূর বিবি জরিনাকে বলল,"তুই কোন চিন্তা করিসনা।আমি ঠিক বুঝিয়ে রাখব।"
"ঠিক আছে।আমরা যাচ্ছি তাহলে।"রাকিব বলল।
নূর বিবি বলল,"তোরা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছিস।আমাকে মিষ্টি খেতে কিছু দিয়ে যাবি না?"
"অবশ্যই দিয়ে যাবো।"রাকিব প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করে সেখান থেকে কিছু টাকা নিয়ে নূর বিবির হাতে দিল,"এটা তোমাকে দিলাম।তোমার যা ইচ্ছা করবে কিনে খেয়ো।"
নূর বিবি খুব খুশি হল,"আমি পাঁচ অক্ত নামাজ পড়ি।প্রত্যেক নামাজ অন্তে আমি তোদের জন্য জায়নামাজে বসে দোয়া করব।তোদের দাম্পত্য জীবন যেন সুখের হয়।তোরা যেন খুব সুখী হতে পারিস।"ও পরে বলল,"যাবি তো এক্ষুনি চলে যা।শুভ কাজে দেরি করতে নেই।তোরা বেরিয়ে গেলে পরে আমি সন্ধ্যার নামাজ পড়ব। তাছাড়া হঠাৎ যদি আরমিনা এখন চলে আসে তোদের বিয়ে ভালো করেই দিবে।আমারও বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।"
রাকিব জিজ্ঞেস করল,"আরমিনা কে?"
নূর বিবি বলল,"আমি বলব না।জরিনাকে জিজ্ঞেস কর।"
রাকিব জরিনাকে জিজ্ঞেস করল,"কে গো,জরিনা?"
জরিনা বলল,"আমার মা।"
শুনে তো রাকিব ভীষণ ভয় পেয়ে গেল।ও তাড়াতাড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে জরিনাকে নিয়ে ছুটলো।
ওজু করে নূর বিবি এবার সন্ধ্যার নামাজ পড়বে।তার আগে রাকিব তাকে কত টাকা দিয়ে গেল মুঠো খুলে সে টাকাটা একবার দেখে নিল। পুরো পাঁচ হাজার টাকা।রাকিবের সঙ্গে এটাই তার কথা হয়ে আছে।একটা মেয়ে ঠিক করে দিলে সে তাকে পাঁচ হাজার টাকা দেবে।যত মেয়ে ঠিক করে দেবে তত পাঁচ হাজার দেবে।
তিন
রাকিবের গাড়ি হাওয়ার বেগে ছুটে চলল। ফলে জরিনার মাথার চুল, বুকের উড়না বাতাসে সব এলোমেলো হয়ে গেল।বাতাসের ঝাপটায় চোখ দিয়ে তার জল ঝরল।জরিনা তাই রাকিবকে তখন গাড়ি আস্তে চালাতে বলল,"গাড়ি আস্তে চালাও।"
মাথায় হেলমেট পরা রাকিব জরিনার কথা শুনতে পেল কি পেল না কোন উত্তর করল না। গাড়ি তার হাওয়ার বেগে ছুটেই চলল।খানিক বাদে জরিনা ফের বলল,"গাড়ি আস্তে চালাও।" এবার সে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আগের থেকে জোরে বলল।
রাকিব বলল,"এখন কি গাড়ি আস্তে চালানোর সময় আছে?ধরা পড়ে গেলে তুমি আমি দু'জনেই ভীষণ বিপদে পড়ে যাবো।তোমার কি কোন অসুবিধা হচ্ছে?"
জরিনা বলল,"পড়ে যাবো বলে ভয় করছে। আর বাতাসে চোখ দিয়ে জল ঝরছে।"
রাকিব বলল,"পড়বে না।তুমি আমাকে ভালো করে ধরো।আর চোখ বন্ধ করে বসো।"
রাকিবের কথা মতো জরিনা তাই করল।পরে ঘণ্টা দুয়েক গাড়ি ছোটানোর পর রাকিব জরিনাকে নিয়ে শহরে পৌঁছে গেল।শহরের একটা পাঁচতলা হোটেলে উঠল।এবং হোটেলের একটা রুমে জরিনাকে বসিয়ে রেখে বলল,"তুমি এখানে একটু বসো,জরিনা।আমি একটু আসছি।"
"কোথা থেকে?"
"বাইরে থেকে।"
জরিনা বলল,"আমি একা বসতে পারবো না। একা বসতে আমার ভয় করবে।আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।"
রাকিব জরিনাকে সাহস দেওয়ার জন্য তখন বলল,"ভয় কি!কোন ভয় নেই।"
"না,তা-ও আমার ভয় করবে।কেউ যদি এসে চেপে ধরে আমি তখন কি করব!এখানে আমি কাকে চিনি?"
রাকিব ফের তাকে সাহস দিল,"বললাম তো ভয় নেই।এখানকার মানুষ সবাই খুব ভালো।কেউ তোমাকে কিছু শুধিয়ে দেখবেনা।বিরক্ত করবেনা।"
জরিনা তখন বলল,"তুমি বাইরে কোথায় যাবে?"
রাকিব বলল,"সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। এখানে তো সিগারেট পাওয়া যাবে না।তাই রাস্তার ওপারে একটু যেতে হবে।"
"আজ অমনি থাকো।সিগারেট খেতে হবে না।একটা রাত সিগারেট না খেলে কিছু হবেনা।"
"তোমার মাথা খারাপ!সিগারেট না খেলে হয়?ভাত না খেয়ে থাকতে পারব।কিন্তু সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারব না।"রাকিব বলল।
জরিনা যখন কোন ভাবেই তাকে আটকাতে না পারল তখন অত্যন্ত ভীতা হয়ে বলল,"যাচ্ছ যাও।কিন্তু খুব বেশি দেরি করোনা যেন।তাড়াতাড়ি চলে এসো।"
রাকিব "যাবো আর আসব" বলে বেরিয়ে গেল।
চার
ঘণ্টা খানেক হতে চলল তবু রাকিব ফিরে এল না।একা ঘরে জরিনার তখন ভয় করতে লাগল। তার কাছে কোন ফোন টোনও নেই যে, রাকিবকে ফোন করে ডাকবে।যদি না আসে সে কি করবে? বা কোন পুরুষ এসে যদি তাকে এখন.... ভাবতে ভাবতে ভয়ে জরিনার কণ্ঠ তালু শুকিয়ে গেল। ফলে বারবার সে ঢোঁক গিলল।
আর ঠিক এই সময় রাকিবের থেকে বয়সে কিছু বড় হবে এক ব্যক্তি ঘরে এসে ঢুকল,"কি করছ,সুন্দরী?"
জরিনা অমনি ভীষণ ভাবে আঁতকে উঠল। তারপর চিৎকার করে বলল,"কে আপনি?"
"বলব বলব।অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন?আগে দরজাটা বন্ধ করতে দাও।দরজাটা আগে বন্ধ করি।"
জরিনা চিৎকার করে উঠল,"না, দরজা বন্ধ করবেন না।দরজা বন্ধ করবেন না, বলছি।"
সে শুনল না।দরজা বন্ধ করেই দিল,"কি হল,এবার বলো।"
"আপনি দরজা বন্ধ করলেন কেন?দরজা খুলে দিন।দরজা খুলে দিন, বলছি।নাহলে রাকিব এসে পাবেনা।"
সে তখন বলল,"রাকিব আর আসবে না।"
জরিনা আরো ভীতা হয়ে তখন পিছনের দেওয়ালের দিকে সরে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল,"আপনি কে?এখানে কেন? বেরিয়ে যান।বেরিয়ে যান,বলছি।"
হাসতে হাসতে সে বলল,"আমি এই হোটেলের মালিক।সুতরাং তুমি বেরিয়ে যেতে বললেই তো আমি বেরিয়ে যাবোনা।কক্ষনো না।"
দৃপ্ত কণ্ঠে জরিনা এবার তার উত্তরে বলল,"আপনি হোটেলের মালিক হতে পারেন।তা বলে একা একটা মেয়ের ঘরে আপনি আসতে পারেন না।এটা অন্যায়।আপনি এক্ষুনি বেরিয়ে যান। রাকিব আসুক তখন যা বলার ওকে বলবেন। আমার সঙ্গে আপনার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি এখন আসতে পারেন।"
"রাকিবের সঙ্গে প্রয়োজন আমার মিটে গেছে।প্রয়োজন এখন আমার তোমার সঙ্গে।"
"আমার সঙ্গে!আমার সঙ্গে আপনার কি প্রয়োজন?"
সে বলল,"অতদূরে থাকলে কি করে বলব? কাছে এসো তবে তো বলব।"জরিনাকে সে আহ্বান করল।
জরিনা তখন "না" বলে বলল,"আপনি ভালোই ভালোই বেরিয়ে যান বলছি।নাহলে রাকিব এলে তাকে সব বলে দিয়ে আপনাকে কঠিন শাস্তি দেওয়াব।"
জরিনার কথা শুনে সে "হো হো" করে হাসল,"তুমি এখনো রাকিবের কথা ভাবছ?রাকিব আর আসবে না বললাম না?"
"কে বলল আসবে না?"
"আমি বলছি।রাকিব চলে গেছে।"
"চলে গেছে!কোথায় চলে গেছে?"
"বাড়ি।রাকিব বাড়ি চলে গেছে।"
জরিনা বিশ্বাস করল না।সে বলল,"এ হতে পারে না।সে আমাকে ভালোবাসে।আমিও তাকে ভালোবাসি।আর আপনি বললেই হল নাকি? রাকিব সিগারেট কিনতে গেছে।হয়তো দোকানে ভিড় আছে বলে আসতে দেরি করছে।সিগারেট পেয়ে গেলে ঠিকই চলে আসবে।রাকিব কথা দিয়েছে সে আমাকে বিয়ে করবে।"
জরিনার কথার উত্তরে সে হাসল,"তুমি হলে পাড়া গ্রামের অতি সাধারণ মেয়ে।তাই বুঝতে পারোনি।রাকিব তোমাকে আমার কাছে বিক্রি করে দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেছে।ফিরে আসবে না।"
"কি!"
"হ্যাঁ।"
তখন চমকে উঠলেও পরে জরিনা বলল,"আমি আপনার কোন কথা বিশ্বাস করি না। আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।হ্যাঁ, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।"
"আমি মিথ্যা কথা বলছি না।আমি তোমাকে সত্যি কথাই বলছি, জরিনা।"
জরিনা তার মুখে নিজের নাম শুনে অবাক হল,"এ কি!আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?"
সে হাসল,"টাকা নিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় রাকিব আমাকে বলে গেছে।"তারপর বলল,"জানো তো,মেয়েছেলে আমি কেনাবেচার ব্যবসা করি।তোমাকে রাকিব বিয়ে করবে বলে নিয়ে এসে আমার কাছে বিক্রি করেছে।শুধু তুমি নও,আরো অনেক মেয়ে সে এইভাবে বিক্রি করেছে।তোমরা গ্রামের মেয়েরা হলে বোকা।তাই তোমরা যেকোন ছেলের প্রেমের প্রলোভনে সহজে পড়ে যাও।আর তার সঙ্গে বেরিয়ে চলে আসো।আসার আগে তার সম্পর্কে একবারও ভেবে দেখ না।"
জরিনা বলল,"আমি তাকে বুঝতে পারিনি। আমি তাকে চিনতে পারিনি।"
সে বলল,"তুমি তাকে চেনা বা বোঝার কোন চেষ্টাই তো করোনি।তুমি আসলে রাকিবের সুন্দর চেহারা দেখে ভুলে গিয়েছিলে।জানো তো,রাকিব তার ওই সুন্দর চেহারা দিয়ে তোমার মতো মেয়েদের সহজে শিকার করতে পারে।তোমাকে ধরলে রাকিবের একশো একটা মেয়ে শিকার করা হল।সব তারা তোমার মতো গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে।সব গ্রামে ওর একটা করে মেয়ে ফিট করা আছে।তারাই রাকিবকে মেয়ে ঠিক করে দেয়। রাকিবের কাছ থেকে তারা পয়সা পায়।মেয়ে প্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে।
জরিনার অমনি নূর বিবির কথা মনে পড়ে গেল।তার এই দাদিই তাকে সেরেছে।সে তখন বুঝতে পারল।এবং পরে তার মনে হল,এখান থেকে সে যদি বেরিয়ে যেতে পারে ওই নূর বিবির বিরুদ্ধে বিচার ডাকবে।তাকে শাস্তি দিতে হবে। নাহলে সে গ্রামের আরো অনেক মেয়ের সর্বনাশ করবে। তার সর্বনাশের হাত থেকে গ্রামের মেয়েদের বাঁচাতে হবে।বিষয়টা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে হবে।ও সে নিজে একটা সংগঠন গড়ে তুলবে।হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মেয়েদের নিয়ে।সেই সংগঠনের কাজ হবে মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো।মেয়েদের সতর্ক করা।ভুল পথে ভুল করেও যাতে মেয়েদের পা না পড়ে। মিথ্যা ভালোবাসার শিকার মেয়েরা যাতে না হয়।....
এরপর জরিনা তার কাছে মুক্তি চাইল,"....আপনি আমায় মুক্তি দিন।"
সে মুক্তি দিল না।
পাঁচ
রাত্রে জরিনার মা জরিনার খোঁজে বের হল। পাশের বাড়ি গুলো দেখল।ও আরো অনেক লোককে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করল।কিন্তু জরিনার খোঁজ কেউ দিতে পারল না।জরিনাকে কেউ দেখেনি বলল।জরিনার জন্য তার মনে তখন চিন্তা হল।মন খারাপ করে সে বাড়িতে বসে থাকল। থাকতে থাকতে তার নূর বিবির কথা মনে পড়ল। জরিনা নূর বিবির কাছে যায়।এবং বসে।সব বাড়ি গেলেও তার নূর বিবির বাড়ি যাওয়া হয়নি।তার কাছে গেলে সে জরিনার খোঁজ পেতে পারে। ভেবে সে নূর বিবির বাড়ি গেল,"চাচি,তোমার কাছে আমার জরিনা আসেনি?"
নূর বিবি বলল,"না তো।"তারপর বলল,"তুমি এসেছ ভালো করেছ।নাহলে তোমার কাছে আমাকে যেতে হতো।"
"কেন?"
"তোমার জরিনা আমাকে ফোন করেছিল। খবরটা দেওয়ার জন্য।"
জরিনার ফোন করার কথা শুনে সে চমকে উঠল,"ফোন করেছিল!"
"হ্যাঁ।"
"কখন?"
"আধঘণ্টা হল।"
"কিন্তু জরিনার কাছে তো ফোন নেই। তাহলে সে ফোন করল কি করে?"
নূর বিবি বলল,"কার ফোন থেকে করেছিল তা তো বলতে পারব না।আমার নাম্বার ও জানে।তাই আমার মোবাইলে করেছিল।"
"করে কি বলল?"সে জানতে চাইল।
"তোমাকে খোঁজাখুঁজি করতে এবং চিন্তা করতে নিষেধ করল।"
"কোথায় আছে বলল?"
"সেসব কিছু বলল না।জিজ্ঞেস করলাম তা-ও বলল না।তবে একটা কথা বলল।"
"কি বলল?"
নূর বিবি বলল,"কাল বলে ওকে দেখতে লোক আসবে।ছেলে বলে দেখতে ভালো না। কালো।কালো ছেলে ওর পছন্দ না।তাই কোথাকার একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে।"
"কি বললে তুমি!"
"হ্যাঁ।ফোনে আমাকে যেরকম বলল আমি তোমাকে সেরকমই বললাম।"
সে তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না।তারস্বরে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল,"জরিনা, ও জরিনা, এ তুই কি করলি মা....এ তুই কি করলি....জরিনা..."
নূর বিবি তাকে কাঁদতে নিষেধ করল।এবং আল্লার কাছে জরিনার জন্য দোয়া করতে বলল।
দুই হাত তুলে সে তখন দোয়া করতে লাগল,"আল্লা,ও আল্লা।আমার জরিনাকে তুমি সুখে রাখো।শান্তিতে রাখো।হেফাজত করো।..."
ছয়
তিন বছর বাদে জরিনা বাড়ি ফিরে এল। হোটেলের এক কর্মচারীর সঙ্গে হাত করে পালিয়ে। বাড়ি এসে জরিনা সব কথা তার মাকে খুলে বলল।দুই মা মেয়ে গলা ধরে তখন খুব কাঁদলো। পরে তারা দুই মা মেয়ে মিলে নূর বিবির বিরুদ্ধে সালিশ ডাকল।সালিশে প্রচুর লোক জমায়েত হল।সকল লোকের সামনে জরিনা উঠে দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য পেশ করল।সকলে মিলে তার বক্তব্য শুনল। শোনার পর নূর বিবিকে সালিশের লোক উঠে দাঁড়াতে বলল।নূর বিবি উঠে দাঁড়াল। সালিশের লোক তখন তাকে জরিনার বক্তব্যের সত্যতা জিজ্ঞেস করল।অর্থাৎ জরিনা যা বলল সেসব কি সব সত্যি?
কালো ঘোমটার আড়ালে নূর বিবির মুখ ঢাকা রয়েছে।ঘোমটার আড়াল থেকে সে বলল,"না।বিলকুল মিথ্যা।"
জরিনা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করল,"না।ও মিথ্যা কথা বলছে।ওর কথা আপনারা কেউ শুনবেন না।কেউ বিশ্বাস করবেন না।"
সালিশের মধ্যে থেকে একজন লোক তখন জরিনাকে বলল,"তুই-ই যে সত্যি বলছিস তার গ্যারান্টি কি?"
জরিনা বলল,"রাকিব আমাকে যে হোটেলে বিক্রি করেছিল সেই হোটেলই হল গ্যারান্টি প্রমাণ।"
নূর বিবি জনগণকে সাক্ষী করে তখন বলল,"আমি যে এরকম কাজ করব আপনারদের কি বিশ্বাস হয়?"
সালিশের অর্ধেকেরও বেশি লোক হাত উঁচিয়ে তখন বলল,"না, আমাদের কারো সেটা বিশ্বাস হয় না।"
আর অর্ধেক লোক চুপ করে থাকল।
নূর বিবি বলল,"আমি কিছু বলব না।গ্রামের মানুষ আপনারাই ভালো জানেন, আমি কি রকম মানুষ।আমার স্বামী কি রকম মানুষ।তাছাড়া কিছু দিন হল আমরা পবিত্র মক্কা ভূমি ভ্রমণ করে এসেছি। আর ও একটা চরিত্রহীনা মেয়ে।তিন বছর হোটেলে ছিল।ওর জাত ধর্ম বলে কিছু নেই।সব চলে গেছে। আপনারা ওর কথা কি শুনছেন?ওকে মারুন, মারুন ওকে।"
তারপরই সালিশের লোক উত্তেজিত হয়ে জরিনাকে মারতে শুরু করল।আর গালি দিতে। শালি,একটা খানকি মেয়ে হয়ে....শালি...
ভদ্র সালিশের ব্যবহারে জরিনার মা স্তম্ভিতা হয়ে গেল।এ কি!এর প্রতিবাদের সে কোন রাস্তা খুঁজে পেল না।ফলে দমদম করে খালি লাথি মারল মাটিতে।দমদম করে খালি লাথি মারল।
পুনশ্চঃ নূর বিবির মতো মানুষেরা সমাজে এই ভাবেই বেঁচে যায় চিরকাল।আর মার খায় জরিনারা।
কবিতা- ২
কোভিড ১৯
~ আলোক
ধরণী জুড়ে মানব কাঁদছে আজ পরাধীন শক্তির আগমনে। রাস্তা ঘাট আজ নির্জনে ভরা নিঃশব্দ শুধু তোমার কারনে। পথে থাকো পথে ঘুরো অদৃষ্টিতে আতঙ্কে হচ্ছে বন্দি,সবাই ঘরে। অস্থায়ীভাবে জীবন চলছে আজ দিনের পর দিন সংগ্রাম করে। ছোট্ট একটি ভাইরাস করছে.. বিশ্বে মানবদেহ বিনাশ। হাসপাতালে আর কবরস্থানে, ঘুমিয়ে আজ লাইন দিয়া লাশ। ইচ্ছে হলেও কিছু উপায় নে ।
যুদ্ধ
~ সৌম্য শংকর
লড়ছি আমি, লড়ছো তুমি, এ যুদ্ধে,
প্রতিপক্ষ আমরা এই রাজনীতির কুরুক্ষেত্রে।
তোমার কথায় তুমি পান্ডব, আমি কৌরব।
আমার গল্পে আমি অর্জুন আর তুমি দুর্যোধন।
যুদ্ধ কীসের? প্রশ্নের সময় বয়ে গেছে কোপাইের স্রোতের সাথে।
যুদ্ধটা আসলে রাজনৈতিক আগ্রাসনের।
যুদ্ধে আমরা সৈনিক, তোমার রাজা বসে আছে ঠান্ডা ঘরে।
আর আমার রাজা বার্ধক্যের বোঝা বয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব জুড়ে।
যুদ্ধ শেষে কত মৃতদেহ কে ঝান্ডা দিয়ে ঢেকেছি তা জানি না।
কত শব জ্বালিয়েছো তার হিসাব আছে কী?
সবশেষে মতবাদ গুলো পাশাপাশি বসেনি।
যুদ্ধ শেষে পৃথিবী দেখে কত ভ্রূণ আত্মহত্যা করেছে, কত সদ্যোজাত শিউড়ে উঠেছে,
কত মানুষ ঘুমোতে পারেনি সাতজন্ম ধরে।
যুদ্ধ শেষে বর্ষার কালো মেঘ দেখে ভয় পেয়েছি।
আর কখনও তারাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি।
মনে হয়েছে আমরা চাঁদের কলঙ্কের মতো আঁকড়ে আছি পৃথিবীটাকে।
প্রশ্ন জেগেছে একটাই,"আর কখনও কেউ বলবে পৃথিবী কী সুন্দর?"
জয়ী
সত্যব্রত ধর
সন্ধ্যার অভিরুচিতে বিবাদী মনস্তত্ত্ব,
কিছু মাত্র আশ্চর্য!
দশটা রাত্রি পেরিয়ে সিঁদুর কুড়িয়ে,
অবশেষে চাঁদ উঠল!
দৃঢ়কন্ঠের অপমান গিলে,
হতবুদ্ধির দুর্বলতা ভঙ্গুর প্রায়।
ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে ওঠা মন,
আজ বিহ্বল!
অপমানের দগদগে ক্ষত থেকে,
রক্ত মোছে নিরাশাগ্রস্থ হৃদয়।
হঠাৎ হাতের চেটো বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে,
ঈষৎ মলিন হাসি!
বিন্দু বিন্দু পাপ জমে সংসারের,
পান্ডুলিপি লেখে এভাবেই রোজ।
পাষাণ ভর্ৎসনা শুনে বড়ো হওয়া,
পরাজয়গুলো সবশেষে জয়ী।
আশা
~ হাওয়াই মিঠাই
বিহঙ্গরাজির কলতানে মুখোরিত গোটা আকাশ ও বাতাস,
সুদিনের আগমন ঘটছে, পাচ্ছি তারই আভাস।
দুঃখের সামিয়ানা ক্রমে গেছে অস্তাচলে,
প্রকৃতিমাতা বেঁধেছে আমায় তার নিজ আঁচলে।
মলিন মুখের ঘটেছে অবসান, শুধুই রয়েছে আনন্দের সমাবেশ,
এ আমার পরম সুখের চিত্তাকর্ষক আবেশ।।
একাকীত্ব
~ কোয়েল খাসনবীশ
আজ একাকীত্বের আসরে বসে আছি আমি।
সবকিছুই আছে, তবুও পরাজিত-নিঃস্ব।
মিলিয়ে ফেলেছি সত্ত্বাকে, ঠিক - ভুলের মাঝে ।
মেরুদন্ড সোজা বলে গর্ব করব?
নাকি সত্যি বলা মানুষের শত্রু বেশি - এটা ভেবে কষ্ট পাবো!
ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।
আজ মনে কোনো প্রতি-উত্তরের সায় নেই । সময়ের চাকা ঘুরছে ,
সব এলোমেলো করে দিয়ে চলে যাচ্ছে ।
ধুলো মাখা মনের আকাশ আজ দগ্ধ ;
জোড়া তালি দেওয়ার মত ইচ্ছে আর ধৈর্য্য সবটাই ইতি-প্রায়।
আশা - ভালোবাসা - বিশ্বাস,
সবকিছু আজ মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ।
বলতে পারো?
ঠিক কতটা ভাঙলে আবার উঠে দাঁড়ানো যায়না??
আর কতবার আয়নার সামনে প্রশ্ন করলে সঠিক উত্তর টা খুঁজে পাওয়া যায়?
আর কতবার হেরে গেলে জেতার সুযোগ আসে?
যদিও জিততে চাইনি, ভালো থাকতে চেয়েছি ;
নিজের ঘুমহীন রাত্রিকে বিলিয়ে দিয়েছি,
নিজেকে অশান্ত করে শান্ত করেছি তাদের ,
অগাধ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে নিঃস্ব করেছি নিজেকে ।
শুধু পরিবর্তে চেয়েছি - একটা ভরসার হাত;
যেই হাত আজ প্রায় অবলুপ্ত- আত্মসিদ্ধির আশায়।।
মেঘলা দিনে
~ বিজন মজুমদার
মেঘলা দিনে উদাস নয়নে
বসে আছো বাতায়নে
না জানি কোন অরূপ ছবি
ভাসছে তোমার মনে ॥
মনযে তোমার চলেছে ভেসে
আকাশের ওই পানে
আলো ঝলমল অমল দেশের
ঠিকানার সন্ধানে ॥
উথলে ওঠা হৃদয়ের ভাষা
ফুটেছে গোলাপ হয়ে
নিশ্চিত আমি খুশির খবর
এনেছ তুমিযে বয়ে ॥
অগোচর
✒️সুবর্ণা বর্মন✒️
রেললাইনে যত বস্তির
ঘর অবাক চাউনি।
ক্লান্ত ভিজে ঘাম
হিমসিম অর্থের যোগান।
টানপোড়নের দায়ে
অভিমানে বুক ফাটে।
সভ্যতার মননে পড়ে কালি,
বিছানার ছেঁড়া চাদর
হয় রাতের আদর।
কাজ করে উপাসনা ভেবে,
ধর্মের দালালে বসে নয়।
কর্ম ভিক্ষের আসনে
বোবা জীবন মুখি ছন্দ।
দৃষ্টির অগোচরে সিংহসম
দেহ পরে সংহার।
তুমি কবি
~ মেহেদী রানা
ইচ্ছে হলেই অনিচ্ছা সত্বেও বলে ফেলছে যা খুশি
বলুক!
তুমি তো জানো মানুষের কাছে
তোমার কি ছবি
ইতিহাস
যারা কবিতা লিখতে পারে না
যারা কবিতা বলতে শেখে নি
যারা সাহিত্য, প্রেম কিচ্ছু বোঝে না
তারা অকর্মণ্য বাক্যবাগীশ
অতি বড় দেশপ্রেমিক!
ধূলো দিতে চাই মানুষের চোখে
ধর্মের আফিম গিলিয়ে
দিন দুপুরে রাতের অন্ধকারে
সেটে বসাতে চাই তোমার পাশে
দেশদ্রোহীর তকমা...
তুমি কবি,
কোনো ছেদো কথায় কর্নপাত না করে
সাহিত্যের বর্নমালার ঠিকঠাক প্রয়োগ করে
বিভেদের 'অপরাজনীতির' পাশ কাটিয়ে
সম্প্রীতির কবিতা লিখে যাও,
সত্যের ছবিটা ফুটিয়ে তোলো
হাজির করো
মানুষের দরবারে....।।
আমি চাই ---
~স্বাগতা
আমি আগুনের মতো ছায়াহীন হতে চাই ,
কারণ সেও যে আপন নয়,
এক গভীর-কালো অন্ধকারে সেও যে সঙ্গ ত্যাগ করে পালিয়ে যায় ।
আমি অগ্নিশিখা হতে চাই ,
নাহ ! সমস্ত কিছু পুড়িয়ে দগ্ধ করার জন্য নাহ !
তার মতো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে চাই আমি।
আমি ইচ্ছেডানা মেলে সুবিশাল-এ গগন জুড়ে উড়তে চাই।
সমস্ত বাঁধন ছিড়ে আমি এগিয়ে যেতে চাই ।
সমস্ত শুষ্কতা দূর করে সতেজ হয়ে উঠতে চাই।
আমি সুবিশাল হিমালয় হয়ে নীল অম্বরকে স্পর্শ করতে চাই ।
আমি সমস্ত জীর্ণতা ধুয়ে ফেলতে চাই ।
এক বৃহৎ সাগর হয়ে আমি দিগন্তকে ছুঁতে চাই।
আমি বৃষ্টি হয়ে ধরিত্রী মায়ের বুকে ঝরে পড়তে চাই।
এক বিশালাকৃতির নক্ষত্র হয়ে আমি সবকিছু আলোকিত করতে চাই ।
আমি পর্বত হয়ে মেঘেদের সান্নিধ্যে আসতে চাই।
আমি উচ্চতার চরম শিখরে পৌঁছোতে চাই।
কবি কথা
আভা চট্টরাজ
অনেক গুলো বর্ণমালা,অনেকগুলো শব্দ দিয়ে কিছু মনের কথা।
ছত্রে ছত্রে লেখে কবি মাধুরী মিশায়ে
তাহাই কবিতা।
প্রকৃতির আলাপণে সংসারের কোনে কোনে লেখার বিষয়।
অথবা উদ্দেশ্য হীন লিখে যায় দিন দিন
বাঁচার আশায়।
হয়তো সবার মতো বোঝে নাকো অতশত
তবু যায় লিখে।
বনফুল মাঠঘাট,কবির সুখের হাট সকলের কাছে কবি শিখে।
আপন খেয়াল মতো মনিমুক্ত কতশত কবি
রাখে সবাকার তরে।
সৌন্দর্য্য ফুরায়ে যায় কর্মফল রয়ে যায় কবি থাকে সবার অন্তরে।
বার্তা দেয় ভালোবাসে,কর্মের অবকাশে
ধরে যে লেখনী।।
লেখার সম্ভারে সাজাইয়ে থরে থরেরেখে
যায় আশ্চর্য্য বিপণী।।
*********
শ্রী কালপুরুষের কবিতাগুচ্ছ
শোন গৌরব
মনে পড়ে গৌরব সেই হারানো দিনের কথা,
তোর জন্য এখনো হয় বুকের একদিকে ব্যাথা।
কেমন আছিস তুই? শুনলান নাকি ব্যবসা খুব তুঙ্গে,
নীলা তো চলে গেল, আমারো রোগ জন্মেছে সব অঙ্গে।
আচ্ছা পাড়ার হেরুদার চায়ের দোকান কি আর আছে?
এখানে কিছুই ভালো লাগে না, কেউ কি আপন আছে?
খুবই ইচ্ছে হয় জানিস! খোকনটাও আর নেই!
সাদা চামড়ার কোন ইংরেজি মেয়ের পাল্লাতেই,
সুখ কি জানিস? আমার জীবন তো সুখহীন গ্রহ
দেশে কাটানো জীবন এবার তো আমার আগ্রহ।
জানিস ভাই, উপকার করবি একটা?
আমাকে নিয়ে যাবি এই জাহান্নাম থেকে?
মৃত্যুটা এখনো আর বেশি দূর নেই, তবুও অদেখা
শেষ দিন কটা ইচ্ছে তোর কাছে থেকে।
টাকা, টাকা করে বাহাত্তর বছরে আর সব হারা,
স্মৃতির জন্য বেঁচে, নাহলে আমিও ছন্নছাড়া।
মনে পড়ে এখনো জুয়েলের সেই মন মাতানো গান,
আর বিকেলের সেই পায়রার ঝাপটা
মনে আছে সেই মাঞ্জা দেওয়ার কথা
ছাদে উঠে সারাদিন চলত ঘুড়ির টান।
কত সুখ ছিল বল, আজ আর নেই!
তুইও কি আগের মতো নাকি রোগাতেই!
বাহাত্তর বছরে ঠকেছি রে, কান্না আসে না আর,
সুখের আশা করি না আমি, ফিরে পাব কি আবার!
সমগ্র পৃথিবী ঘুরলে তবু, ফাঁকা অন্তর খানি,
দেশের মাটি কথা বলে, শুকবো বাংলার মাটির গ্লানি।
বাঁধন- হারা
চলো বাঁধতে চলি সকলে,
এদেশ টাকে অখন্ড রাখতে,
চলো পাড়ি দিয়ে চলি এখানের মহিমায়।
হিন্দু ওরা, মুসলিম ও নয়,
মানুষ হবার চিন্তায় সব
ধর্ম গুলো পুঁতে রাখি,
আপন আপন ঘরে।
এদেশেই ভালোবাসা সৃষ্টির অনুকূল,
হিংসার বাণী ধ্বংস করব আমরা
ওহে বিদ্রোহী কূল।
শান্ত শ্রমিক, পথ ফিরেছি,
দল বেঁ্ধেছে চেতনারা,
দেশটাকে বাঁ্ধব আমরা
এক সুতোতে প্রেমের দ্বারা।
চলো ধুয়ে মুছতে থাকি আজ,
চলো আমরা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি আজ,
এদেশ তোমার আমার,
থাকুক চৈতন্যের নাম,
সুফীবাদের ভালোবাসা,
ভক্তিবাদের নাম।
লালন আমার প্রেমের গুরু,
বুদ্ধ প্রেমের নাম,
গরিবেরই অন্ন দাতা
আজমীরে তার বাসস্থান।
বাঁ্ধব আমরা চৈতন্যকে,
বাঁ্ধব দেশের মালা,
ভালোবাসা বিলিয়ে আমরা
থামাবো জীবন যুদ্ধের খেলা।
তোমরা এখন ভারতবর্ষে সুখের কাঠি পাও,
নিজামউদ্দিন আউলিয়া থাকুক,
মার্কাজ ধ্বংস চাও,
সুফীবাদের ইসলামে তে,
ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকে,
জামাত গুলো বন্ধু হোক
ভারতবর্ষ থাকুক একই থালার পাতে।
বলা হয়নি এখনো
বলা হয়নি এখনো তোমায়,
গল্প গুলো সবই বাকি,
জীবনের ইতিহাসের ফাঁকে
বাস্তবতা কোথায় রাখি!
ইচ্ছে তবু অনেক আছে,
ভালোবাসি এখনো তাই,
বলা হয়নি এখনো
"শুধু তোমাকেই চাই।"
রক্ত এখন গোলাপ ফুলে,
সুখের পথিক আজ,
প্রেমের নামে চাতক আমি
প্রেমিক আমার সাজ।
বলা হয়নি এখনো,
পেরিয়ে এলাম বহুযুগ
মৃত্যু এখন দোরগোড়ায়
বন্ধ চোখে দেখি,তোমার মুখ।
পরিপুষ্ট
হিংসার দুনিয়ায় যদি, প্রেমের যুদ্ধ হয়,
কেমন লাগবে বলোতো?
যদি কামানের বদলে গোলাপ ছোড়া হয়
কেমন হবে বলোতো!
যদি ধ্বংসকারী পরামাণুর বদলে,
রোজ এক গুচ্ছ চকলেট ফেলা হয়
তাহলে কেমন হবে?
তাহলে ভাবতেই থাকো,
হিরোশিমার শিশুরা আজ কতই উজ্জ্বল হত!
তারাও মধুর সুরে গান গাইতে পারত!
কেমন লাগত তাহলে!
ক্ষুদার্ত এই ভারতভূমি যদি চকলেট দিয়ে মোড়া থাকত,
তাহলে কি কাঁদত সে?
সেখানে কি প্রেমের দরকার হয়!
চকলেট কোন প্রেমের ইঙ্গিত হয় না,
চকলেট শুধু ভালোবাসার,
মায়ের বুকের প্রথম দুধ
সেটাও চকলেট
আর ক্ষুদার্ত মানুষটার মুখের অন্যটা
সেটাও চকলেট।
এই পৃথিবী তবুও চকলেট ময়!
কেউ চকলেট খায়,
আর কেউ প্রেমের ধর্ষণে
নিজেকে চকলেটে পরিপুষ্ট হয়।
কি রে মনে পড়ে?
মনে পড়ে বন্ধু,
আমাদের সেই স্কুল দিনের কথা,
চিঠির শুরুতে লুকিয়ে অনেক ভালোবাসার ব্যাথা।
কেমন আছিস বন্ধু! বয়স পেরিয়ে সেই দিনের কথা মনে পড়ে,
একসাথে খেলতাম বল, কত হিসাব এখনো হারিয়ে।
তুমি জানো স্কুলের সেই হেডমাস্টারের কথা!
হ্যাঁ নিরুপায় বাবুর কথা, কত নারত আমাদের,
তিনি আজ নেই, আর পাবেনা তাঁর দেখা।
কত না পালিয়েছি বল, একসাথে, পাঁচিল টপকে,
বর্ষার দিনে আমরা ভিজেছি, এক ছাতায় দুজনেই জাপটে।
সব মনে আছে, বন্ধু? তোর কি কিছু মনে পড়ছে,
গাছে উঠেছি আমি, আমগুলো তখন ঝড়ছে।
কতই সুখ ছিল বল?
কতই সে স্বাধীনতা!
আচ্ছা তোর মনে কি পডে, নেঁড়ুদার দোকান খানি,
স্কুল গেটের বাইরে৷ সে বুড়ে, কতই পাকামি।
আজ সে ক্যান্সারের সাথে লড়ছে,
তাকে দেখে আমার চোখের জলও পড়েছে।
আচ্ছা বল তো, ইচ্ছে করে না তোর, সেই গঙ্গার ধারে যাওয়া,
লুকিয়ে বিড়ি আর সিগারেটের কাউন্টার দেওয়া নেওয়া।
আজও আমার এই টেবিলে কয়েক বাক্স আছে,
তুই নেই, সেই আনন্দ কেমন করেই থাকে।
বলতিস তুই, শেষ টানেতে সুখের দেখা মেলে,
নেশা এখন সুখ খুঁজবে, তোর না কাছে গেলে!
বয়স এখন পার হয়েছে ষাটের উর্ধে হল,
তোর থেকেও বছর খানেক বড়ই থেকেই গেল।
জানিস, হাঁটতে গিয়ে লাঠি লাগে, কষ্টে আছি ভাই
ছোট বেলায় একই সাথে মাঠ পার করা চাই।
মরার সময় কাছেই থাকিস, একলা এখন আমি,
বৃদ্ধাশ্রমে পড়ছে মনে, সময় খুবই দামি।
বয়স এখন বাড়ছে অনেক, হৃদয় এখন তরুণ
বন্ধু তুমি ফিরেই এসো, এখন তো জুন।
মে মাসেতে এসেছি আমি, নব্যঘরেই দ্বারে,
শব আমার উঠবে শুধুই, যাব তোর কাঁ্ধেই করে।
ইতি দিয়ে শেষ করব না, বাকি অনেক কথা,
ভালো থাকিস জীবন ভরে, একবার কি হবে দেখা!
সংকোচ
আঙুল তুলে বলো এবার উলঙ্গ রাজার সম্মুখে,
দলে দলে এগিয়ে এসো সব, কে আর তোদের রুখে।
কলরবে মেতে উঠুক সমগ্র রাজ্য জুড়েই
বিধাতার ঘরও কাঁপবে সেই কলরবেই।
আর চুপ করে থাকার দিন নেই ভাই,
তুলে ধরো যে যার অস্ত্র খানি,
শ্রমিকের দলে মিশে যাও সব
কঠিম অস্ত্র ভুলে যেও না যেন,
বুক পকেটে রাখা কলম খানি।
ভয় পায় রাজা, এই অস্ত্র চালককে,
লিখবে যে ইতিহাস খানি,
উলঙ্গ রাজার কালো কাহিনীর কথা
কে লিখবে? হিম্মত টা কার শুনি!
এদেশে তাহলে মানুষ নেই,
সবই তোমার মতোই মৃতপ্রায়।
অতীত নাকি ভবিষ্যৎ
যখন বাবার চেয়ারে বসে,
তাঁর মতো সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে আকাশের দিকে তাকাবো।
কয়েকজন দল বেঁ্ধে আসবে,
গল্প শুনতে। আমি বলব,
চলো ফিরে যাই অতীতে,
মরেছিল তারা অসহায়
যারা সহ্য করেছিল চুপটি করে।
অত্যাচারের দিনগুলো।
ফিরে দেখা ইতিহাস জ্বলন্ত সিগারেটের চেয়ে
আরো বেশি ক্ষতি করে আমায়!
তবুও এখন বাঁচার ইচ্ছে নিয়ে,
লড়াই তো করতেই হয়!
ভালোবাসা তো নিদারুণ কিছুই
এ পৃথিবীতে অসহায়েরা,
কুকুরের মতো থাকতে বাধ্য হয়।
সন্ত্রাসী
লাঙল টা বিক্রি করে এলাম এক্ষুনি,
গোরু দুটো বেচেছি পশু হাটে,
বিষাক্ত দেহ দুটো এখনো শুয়েই আছে,
দশ হাজার টাকার পিস্তল আমার হাতে।
সন্ত্রাস ঘটাতে তৈরি হয়েছি,
চোখের জল গুলো বুকের কাছে এসে শুকিয়েছে,
বাবা- মা কে খুন করেছিলো মাঠে যারা,
এখনো কি আস্ত মানুষ কেউ কি আছে?
কাল মরব না আর, গর্জন করব এবার,
কৃষকের ব্যাটা লাঙল ছেড়েছে
পিস্তল হাতে প্রতিবাদী আজ,
তোমাদের ভাষায় সন্ত্রাসী এখন,
রক্ত নিয়েই ছাড়ব এবার
আরে, এবার সহ্য করব না অত্যাচার,
মারব গুলি বুকে তোদের
তোরা দেশের নামে রাখিস
দেশ পালনকর্তাদের অনাহারে,
এখন আমি মারব এবার
তোদের রক্তেই তো সুখ আসবে আমার।
কাটা মুন্ডু
মোহনার ধারে যতবার এসেছিলাম,
ঢেউ গুলো হয়ে উঠেছে সব,
এক একটা মানুষের মাথা।
" কাটা মাথা"
ধর নেই তাদের,
হারিয়ে যাচ্ছে অতল গভীর সমুদ্রে।
কে জানে কারা?
হয়ত ভুল দেখছি!
না এটা ভুল হতেই পারে না!
ভালো করে আবার দেখলাম,
" হ্যাঁ ঠিক!'
একটা কাটা মুন্ডু হঠাৎ চোখ টা খুলে দেখলো,
আমি অবাক! বিশ্বাস হচ্ছে না!
এবার চশমা টা খুললাম,
জামায় মুছে নিয়ে দেখলাম
" শেষ"
কিছুই তো নেই,
পলিমাখা ঘোলাজলের ছোট ছোট ঢেউ
কখন এসে আমার পা দুটো ভিজেছে
সেটার টের পাইনি আমি।
গল্প ও অনুগল্প - ২
চারুলতার একদিন
~সুমনা রায়(রুচিরা)
রাত থেকেই বড্ড উদাসীন হয়ে আছে চারুর মনটা। বনেদি বাড়ির মেয়ে হওয়ায় অভ্যাসবশত দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা মেয়েটা এক অজানা আর্তনাদে আজ যেন একটু তাড়াতাড়িই উঠে পড়লো শয্যা ছেড়ে। অভ্যাসটা অবশ্য আর কোনোদিনই পাল্টে ওঠা হয়নি তার, বরং তা পরিণতি পেয়েছে বদভ্যাসে। এই নিয়ে ঠাকুমা ছাড়া বাড়ির প্রায় সবাইই তাকে ছোটো বড়ো কথা শুনিয়েই চলতো। যাই হোক উঠেই পড়েছে যখন, রোজকার মতো তানপুরা হাতে গলা সাধতে বসে পড়ে ঠাকুরবাড়ির দুলালী চারুলতা।
আরেহ! আজ তো ২২ শে শ্রাবণ। কবিগুরুর মৃত্যুদিবস।
সে তো ভুলেই বসেছিলো পুরোপুরি। আর ভুলবেই না বা কেন, ঠাকুমার দেহত্যাগের পর এই দিনটা চারুর কাছে বাকি আর পাঁচটা দিনের মতোই বড্ড সাধারণ।
আচ্ছা, ঠাকুমা কেন তার নামটা অমন প্রিয় কবির উপন্যাসের নায়িকার নামকরণে রাখলো?
সেই যে "নষ্টনীড়" গল্পের "চারুলতা"!
নামের জন্যই কি তার জীবনে এত দুর্যোগের ঘনঘটা? অদৃষ্ট কি সেই "নষ্টনীড়" গল্পের সার্থকতা বিচারের সাথে তাল মিলিয়ে তার জীবনের নীড়ও নষ্ট করে দিয়েছে? সেই নীড় নষ্ট হওয়ার কারণে জর্জরিত সে; সেইজন্যই তো তার প্রিয়, তার গহীন মনের ভালোবাসার মানুষটাও বিবাহের দিন তারে একা প্রাঙ্গণে ফেলে চলে যায়।
হঠাৎ কোথা থেকে এক দক্ষিণী বাতাস পাশের খোলা জানালা দিয়ে চারুর মুক্ত কেশ এলোমেলো করে চলে যায়। চারুর হুঁশ ফেরে, মনটা তার হু হু করে ওঠে। সেই জানালার দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টে শামিয়ানা লক্ষ্যের সাথে সাথে সে আবার নিজ ভাবনায় মত্ত হয়। তার নিজের ভেতর থেকে কেউ যেন তাকে ধিক্কার দেয়,
"আর কি ভাবছিস? 'নষ্টনীড়' নষ্ট হয়েছে বহুদিন, আর কিছুই অবশিষ্ট নেই নষ্ট হওয়ার জন্য। সবটা তোর নিজের হাতেই তো শেষ করলি।"
এই ২২ শে শ্রাবণ বড়োই বেহায়া, কিছু না কিছু মনে করিয়েই যায় প্রতিবার। নয় কবিগুরুর স্মৃতি, নয় নষ্ট হয়ে যাওয়া তার একান্ত প্রিয় নীড় বা শ্বাসরুদ্ধ হওয়া তার পড়ে থাকা জীবন।
আচ্ছা, এত ভাবছে কেন সে? আর কীই বা বাকি শেষ হতে?
বেকারত্ব
সায়ন্তী সামুই
― সৌমকের চাকরি পাওয়ার খবরটা পেয়েই ছুটলেন বন্ধু উপেনের কাছে, উপেনকে দেখে জড়িয়ে ধরে বললেন- ' জানিস উপেন আজ আমার বড় খুশির দিন, আমার ছেলে চাকরি পেয়েছে, নে নে মিষ্টি খা' বলেই ব্যাগ থেকে মিষ্টির প্যাকেট খুলে বড় রাজভোগ মুখে গুজে দিলেন।
― উপেনকে চুপ থাকতে দেখে বললেন – " কিরে তুই খুশি হসনি?
― চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করেছে, উপেনবাবু আধভাঙা গলায় বললেন – ' খুব খুশি রে, পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ে গেলো রে।' পাঁচ বছর আগে আমিও তোর কাছে ছুটে গিয়েছিলাম তোরই মতো 'রিটারমেন্ট' - এর টাকা আর সমীরণের মা-এর গয়না বেচে ডাক্তারি পড়ানো ছেলে যেদিন বেকারত্বের তকমা ছেড়ে চাকরি পেয়েছিল। ঠিক এমনই খুশি হয়েছিলাম। সেদিনের পর নিজের বলতে বাড়িটি ছাড়া আর কিছু ছিল না, বৃদ্ধ বেকার তকমা ছাড়া। তারপর একদিন ছেলে বৌমা মিলে মাথার ছাদটা কেড়ে নিয়ে আজ বৃদ্ধাশ্রমের ঘরটাই বেকার বৃদ্ধের ঠিকানা করে দিয়ে গেছে।'
― ' কি জানিস তো উপেন বয়স বাড়লে বেকার বৃদ্ধগুলোর এখানেই ঠাঁই হয়, বেকার ছেলের ঘরে বেকার বাবা অন্ন ধ্বংস করছে বলে রোজকেরে বৌমা রেখে গেছে এখানে। তবুও সৌমকের চাকরির খবরটা পেয়ে মনে মনে ভেবেছি, ছেলেটা বেকারত্ব জীবন থেকে মুক্তি পেলে, বেকারত্বের যন্ত্রণা আরও যন্ত্রণার। ওর মা থাকলে খুব খুশি হত জানিস, ছেলের কষ্টে কেঁদে কেঁদে মরে গেল অপর্ণা, ছেলেকে শেষ দেখাও দেখতে পেল না।'
― এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন দুই বৃদ্ধ বেকার বাবা।
ধ্রুব
~ বাপ্পা ধর
এই বছরেই ছেলেটা চতুর্থ শ্রেণীতে উঠেছে । ও, ওর ভাই , মা আর বাবা এই নিয়েই ওর জগৎ ।যদিও বা মাঝে মাঝে এমন অনেক কিছু হতো যেটার কারন বোঝার ক্ষমতা এই ছোট্ট ধ্রুবর ছিল না ।খুব চুপ-চাপ, শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল ।সেই দিনে একটু দেরি হয়ে গেছিল বিকেলে খেলার মাঠ থেকে ফিরতে, ঠিক দেরি নয়---শুধুমাত্র অন্ধকার হয়ে এসেছিল ।আসলে সেদিন স্কাউট এর শেষে দাদাদের সঙ্গে ফুটবল খেলেছিল,তাই বুঝতে পারেনি । ঘরের কাছেই খেলার মাঠ ছিল । দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরলো আর ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছিল--- " ঠাকুর বাবা যাতে ঘরে না থাকে "----- সে জানতো মাকে কিছু একটা বলে manage করে নেবে।একটু বকাবকি করবে আর সেটা তো রোজ ই করে-----কখনো তার কারণ টা বুঝতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই কেন যে বকলো তা ' বুঝতে পারতো না ছোট্ট ধ্রুব। দৌড়ে দৌড়ে ফিরে দুর থেকে দেখতে পেল বেশ কয়েক জোড়া অচেনা জুতো রয়েছে ঘরের দরজার সামনে ।ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো সেখানে বাবার জুতো ও রয়েছে ।মনটা এক মুহূর্তের জন্য খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই খুব খুশি হলাম এটা ভেবে যে আজ এত লোকের সামনে মায়ের বকা বা বাবার হাতে মার খেতে খেতে হবে না । খুব বড় ঘর ছিল না ওদের ।একটা শোবার ঘর আর একটা রান্না ঘর---- এই নিয়েই ভাড়া থাকতো ওরা । শুধু যে বকা শুনতে হবে না তাই নয়, ধ্রুবর খুশি হবার আর একটা কারণ ও ছিল------ সেটা হল বাড়িতে লোক এসেছেন মানে----- নিশ্চয়ই ওনারা কিছু খাবার এনেছেন অথবা বাবা নিশ্চয়ই কিছু এনেছেন সবার জন্য----- যাক আজ সন্ধ্যায় ভালো কিছু খাওয়া যাবে ।
ধ্রুব তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়েছিল---- তারপর ঘরে ঢুকতে যাবে, কি মনে করে পর্দাটাকে সরিয়ে একটু দেখল---- কারা এসেছেন , সে চেনে কিনা--- না কেউ- ই চেনা নয়, লাজুক ধ্রুব একটু থমকে দাঁড়াল---- নিজেকে একটু তৈরি করার জন্য---- ভেতরে ঢুকলে কে , কি জিজ্ঞাসা করবেন এবং সে নিজে কি উত্তর দেবে । চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া ছেলের বুদ্ধি খুব একটা খারাপ নয় , বরং খুব ভালোই বলা যায় স্কুলের শিক্ষকরা যেমন ভালো বসাতেন, তেমনি স্কাউটের দাদা ও দিদি রাও খুব ভালো বাসতো, আদর করতো।পর্দার বাইরে দাঁড়িয়ে যখন নিজেকে প্রস্তুত করছিল----- তখন ঘরের ভেতরের সমস্ত কথাই পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিল ।হঠাৎ - ই কোন একজন ভদ্রমহিলা মাকে জিজ্ঞাসা করলেন---- " আপনার কয়জন ছেলে- মেয়ে "? মা কিছু বলার আগেই বাবা ওনাকে ওর ছোট ভাই- কে দেখিয়ে বলল---- " আমাদের এই একটাই ছেলে "।মা ও একটু হাসি দিয়ে সমর্থন জানাল। ধ্রুব থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল চৌকাঠের বাইরে ।কিছু তেই বুঝতে পারছিল না, কেন তার কথা বলা হল না, ঠিক আছে সে দেরি করে ফিরেছে---- কিন্তু তাই বলে এটা বলবে কেন ! ছোট্ট ধ্রুব সেদিন এটা বুঝেছিল যে এখন ঘরে ঢুকে মা বাবা কে অপ্রস্তুতে ফেলা উচিত নয় ।ধ্রুব ফিরে গেল খেলার মাঠে ।অন্ধকারে বসে এক অজানা কারণেই তার খুব কান্না পাচ্ছিল-- তবু নিজেকে বোঝাতে চাইছিল যে, হয়তো ওরা রেগে আছে, তাই শুধু ভাই- এর কথাই বলেছে , তার কথা বলেনি ------ তবু কান্না থামাতে পারছিল না------ দুর থেকে লক্ষ্য করছিল ঘরের দিকে
যখন লোকজন চলে যেতে দেখল,তখন সে ফিরে গেল ঘরে।মা বলল কোথায় ছিলিস এতক্ষণ, না সেদিন বাবা কিছু বলে নি ।মা বলল রান্না ঘরে সিঙাড়া রাখা আছে, খেয়ে নাও।শান্ত স্বভাবের ছেলেটা চুপ করে রান্না ঘর থেকে খাবার নিয়ে খেয়ে নিল।
স্কুল টা খুব কাছে হলে ও ফিরতে ফিরতে চার- টে বেজে যেত ।মা ভাই-কে নিয়ে শুয়ে থাকতো, রান্না ঘরে খাবার ঢাকা দেওয়া থাকতো, ধ্রুব কিছুতেই ছোট ছোট কালো পিঁপড়ে আর কালো জিরের মধ্যে তফাত টা বুঝতে পারতো না ।বেছে বেছে খেতে অনেক সময় লাগতো, তারপর স্কাউটে যেত।প্রতি দিন-ই এক-ই নিয়ম ।তবে মাঝে মাঝে একটু পাল্টাতো, যখন সিনেমা দেখার প্ল্যান হতো, সেদিন গুলো বাবা- মা আর ছোট ভাই সিনেমা দেখতে যেত। আর ঘরে ছোট্ট ধ্রুব একা থাকতো । না বাচ্চাদের সিনেমা দেখতে নেই তাই ধ্রুব ঘরে, আর ওরা-------- ! একা একা ছোট্ট ধ্রুব খুব ভয় পেত, ওই টুকু বয়সেই ধ্রুব ----- " বিষণ্ণতা "---- কথা টা বইয়ের পাতায় সাধারন ভাবে পড়ে থাকলেও, অর্থ টা খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল, ভয়ের চোটে ঘুমাতে ও পারতো না ------ যদি ভুত আসে, ------ যদি তুলে নিয়ে যায়,--------তাই জোর করে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকতো। ফ্যান টা ঘুরছে আর ঘুরছে সেটাই দেখতো, আবার কখনো বা হাতের ছায়া দিয়ে হরিন কংবা শিয়াল বানাতো---- আর অপেক্ষা করতো কখন ওরা ফিরবে----- আর কখন ওর ভয় কাটবে ।
ঠিক যে বয়সে একাকিত্বের অর্থ মানুষ বুঝতে পারে তার বিশ্লেষন আগেই হয়তো বুঝতে পেরে ছিল " ধ্রুব "। তবে ওর খুব কাছের সঙ্গী ছিল ওর ভাই ।ওরা দুজনেই দুজনকে খুব ভালো বাসতো------ একটু একটু হিংসে হতো না তা নয় কিন্তু পরক্ষণেই ভুলে যেত। চতুর্থ শ্রেণীর পরীক্ষা ---- বাবা বলল পরীক্ষার ফল ভালো না হলে অন্য স্কুলে নেবে না। ধ্রুব জানতো এরপর হাই-স্কুল, পরীক্ষা হলো, পাস- ফেল নিয়ে কোন দিন-ই চিন্তা ছিল না, ও ---- " বৃত্তি " পেল , হেড- মাস্টার ওকে নিজের থেকে একটা ডিকশনারি উপহার দিয়েছিল । আজ ও ধ্রুব সেটাকে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। নতুন স্কুলে আলাদা পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হলো ধ্রুব । বাইরের জগত-টা অন্য রকম হলে ও ঘরের জগতটার কোন পরিবর্তন হলো না ।
এরমধ্যে স্কাউট - এর থেকে একদিন সবাই কে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হবে, ধ্রুব কেও যেতে দিল---- সারাদিন হই-হুললোর।খুব মজা হলো ।বিকেলের দিকে কয়েক জন দিদি বলল," এই ধ্রুব শোন এদিকে আয়----" ও গেল--- ওকে ওরা একটু জোর করেই নিয়ে গেল মেয়েদের আলাদা টয়লেটের দিকে------ বাচ্চা ছেলে টা সেদিন বারন বা বাধা দিতে পারেনি।ওরা যে তিনজন ছিল---- কিছুই নয় দিদিরা হয়তো শুধুমাত্র হাতের দ্বারা স্পর্শ করেই স্বর্গ সুখ পেয়েছিল,আর ধ্রুব কিন্তু সেদিন সুখের কিছু অনুভব না করলে ও শরীরের কষ্ট খুব অনুভব করছিল তিন জন জাপটে ধরে, নিজেরা হয়তো মানসিক সুখ পেয়েছিল কিন্তু ধ্রুবর মনে----" মেয়ে দের প্রতি একটা" ভয় "সৃষ্টি করে দিয়ে ছিল । " সেদিন থেকে ধ্রুবর ---- একাকিত্ব আরো বেরে গেছিল ।ওরা বলে দিয়েছিল কাউকে বললে মারবে ,না বললেও 'ও' বুঝেছিল এটা কাউকেই বলা যায় না "। ধ্রুব সেদিন কি বুঝতে পেরে ছিল তা ' জানা নেই , " তবে আজ সে জানে- বোঝে কি ছিল সেদিন এর মানে "। না ফিরে আসার পর আর কোন দিন ধ্রুব স্কাউটে যায় নি। দাদারা খুব করে বলতো যেতে কিন্তু ও যায় নি, বিকেলে অন্যদের সঙ্গে অন্য জায়গায় ফুটবল খেলা করতো ।
এই করেই চলে গেল দুটো বছর ।তারপর-ই এল অন্য বিপত্তি ।হঠাৎ একদিন বাবা আর মা কি যেন কথা বলছিল। কি সেটা না বুঝলে ও, ওকে নিয়েই যে হচ্ছিল সেটা বুঝতে পেরে ছিল ও। তারপর ওকে বলল, " দেখ ---- আমাদের ঘর তো ছোট , এক কাজ কর তুই কদিন আমার একটা বন্ধুর বাড়িতে থাক , ঘর পাল্টালে নিয়ে আসবো----- ধ্রুব জানতো এটা ওর মতামত চাইছে না কেউ--, তাই সব গুটিয়ে বাবার আত্মীয়-র বাড়ি রওনা হলো।ওখানে পৌঁছানোর পরের দিনই তাকে ওখানকার একটা স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো-------- ১৩ বছরের ধ্রুব বুঝতে পেরে ছিল যে নিজের জীবন নিজেকেই তৈরি করতে হবে ।
না আর কিছু দিন বাদেই ওরা ঘর পাল্টে ছিল, অনেকবার " ধ্রুব "--- গেছিল বাবা- মা আর ছোট ভাই এর কাছে কিন্তু থাকা আর হয়নি তার ওদের সঙ্গে ।তবু দুই ভাইয়ের
মধ্যে খুব মিল ছিল, খুব মিস্ করতো ধ্রুব ।১৬ - বছরের ধ্রুব--- মাধ্যমিক দেবে , স্কুলের সবার থেকে খুব ভালোবাসা পেত ওর শান্ত স্বভাবের জন্য। টিচার-রাও খুব সাহায্য করতেন ।খুব ভালো ছাত্রদের মধ্যেই তাকে ধরা হত ।মাধ্যমিক শেষ, বাবা- মায়ের কাছে গেল , সারাক্ষন ভায়ের সঙ্গে সময় কাটতো।ওর থেকে ---- ৪ - বছরের ছোট সে, কিন্তু খুব বন্ধু ছিল দুজনে।
রেজাল্ট বেড়োল---- ১১ ক্লাশে ভর্তি হলো । খুব ভালো ভাবে পাস করার জন্য ভর্তি হতে অসুবিধা হলো না। জীবন- টা অনেক না পাল্টালেও,একটা বড় পরিবর্তন হয়েছিল যে "ধ্রুব " এখন নিজের বাড়িতেই থাকে । সেদিন শীতকাল ছিল, সন্ধ্যার পরেই কোন একটা কারন নিয়ে ঘরে প্রচণ্ড ঝগড়া হচ্ছে, সেই শীতের রাত-টা কোন দিনই ভুলতে পারবে না "ধ্রুব "। ও সেদিন জীবনের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছিল। প্রথমে বিশ্বাস করতে না পারলে ও মেনে নিয়ে ছিল সত্যি টাকে ।সেদিন-ই সে প্রথম জানতে পেরেছিল যাঁদের ও বাবা- মা বলে জানে ,তাঁরা এতদিন তাকে পালন করেছেন। ওঁদের সন্তান না হওয়ায় ওকে নিয়ে এসেছিল কিন্তু পরে ভাই হওয়ায় আর -------- সেদিন ঐ প্রচন্ড শীতের রাতে বারান্দায় যে চেয়ার টা ছিল তাতেই শুয়ে পড়ল।এক সময় যখন প্রচণ্ড শীত করতে লাগল চেয়ারে পাতা বস্তার ভেতরে ঢুকে নিজেকে রক্ষা করলো । সেদিন ভগবানের কাছে বারবার অনুরোধ করেছিল তাকে শক্তি দিতে ,মনের জোর দিতে । মনে মনে কবি গুরুর লেখা দুটো লাইন বির বির করে বলতে লাগল------ " বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়--" প্রতি দিনের মতোই সকাল হলো। ধ্রুব কোন কথা বলেনি , কোন প্রশ্ন ও করেনি সকাল বেলায় খেয়েছে, সব কিছু নর্মাল ভাবে । দুপুরে বাবা কাজে বেড়িয়ে ছিল, মা ঘুমিয়ে ছিল ।ধ্রুব নিজের সার্টিফিকেট গুলো একটা পলিথিনে মুড়ে নিল।মাকে দুর থেকে প্রনাম করল।ভাইটাকে কেবল ফাঁকি দিতে পারল না।ওদের রক্তের সম্পর্ক নাই বা থাকল---- ওরা যে খুব ভালো বুঝতে পারতো একে-অপরকে ।ভাই এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। অনেক কষ্টে ওকে থামালো। বলল চুপ কর নয়তো মা জেগে যাবে ।ব্যাস কিছুক্ষন ভাই কে আদর করার পর বলল-------- মা বাবার খেয়াল রাখিস।এক জামা- কাপড়ে নিজের দরকারি কাগজ কটা প্লাস্টিকে মুড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়ে গেল "ধ্রুব "। অনির্দিষ্টের সন্ধানে । ধ্রুব জানতো এখান থেকে কিছু পাবার নেই ।ভাই কে বলেছিল----- যেদিন নিজে দাঁড়াতে পারবো ফিরে আসবো। মনে রাখিস আমায়----------।
মিনির টিভির নেশা
~ মনসুর আলী গাজী
মিনি এই পাঁচ-ছ’ মাস হচ্ছে পড়াশোনায় একবারেই মন দিচ্ছে না। মিনি পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। ওর সারাটা দিন শুধু টিভির সামনে বসে কেটে যাচ্ছে। এখন করোনা পরিস্থিতি। তাই স্কুল বন্ধ। এই ক’মাস টিভির নেশাটা ওকে দারুণ পেয়ে বসেছে। বই নিয়ে একটুও বসছে না। এমনকি পাঠ্যবইয়ের কবিতা-গল্পগুলোর কবি-লেখকদের নাম পর্যন্ত ওর মা জিজ্ঞেস করলে কোনোমতেই ওর মনে আসছে না। এমন অবস্থা লেখাপড়ার ওর।
এ তো ভালো মুশকিল হলো! এভাবে চলতে থাকলে ওর যে লেখাপড়াই হবে না। পাস করবে কী করে! ওর বাবা-মা ভেবেই পাগল।
কিন্তু ঘটে গেল এক অভাবনীয় কান্ড!
মিনি বই ছেড়ে আর উঠছে না। টিভির ধারেকাছে ঘেঁষছে না আর।
কী ব্যাপার? কী হলো? এমনটা কী করে হলো ওর বাবা-মা কোনোমতেই ভেবে বার করতে পারছেন না।
শেষে ওর বাবা ওর কাছে গিয়ে বললেন, ‘মিনি, তুই তো আগে টিভি দেখেই সারাদিন কাটিয়ে দিতিস। আর এখন টিভি দেখছিস না, সারাদিন বইমুখো হয়ে বসে আছিস। কী করে তোর এত পরিবর্তন হলো রে মা?’
মিনি বলে, ‘বাবা, কাল টিভিতে একটা প্রোগ্রাম দেখছিলাম। সেখানে মাধ্যমিকে যারা খুব ভালো রেজাল্ট করেছে, মানে ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হয়েছে, সেইসব দাদা-দিদিরা কথা বলছিল। তাদের মধ্যে যে দিদিটা সেকেন্ড হয়েছে সে বলছিল, সে নাকি টিভি খুব কম দেখত। আর বেশি টিভি দেখলে নাকি লেখাপড়া ভালো হয় না। দিদিটা বলেছে ও নাকি বড় হয়ে ডাক্তার হবে। বাবা, তুমিও তো বলো, ‘আমাদের মিনি বড় হয়ে ডাক্তার হবে।‘ তাই আমি ভাবলাম, অত টিভি দেখলে তো ভালো রেজাল্ট করতে পারব না। আর ভালো রেজাল্ট করতে না পারলে ডাক্তারও হতে পারব না। তাই এখন থেকে আমি দিনে একবার করে টিভি দেখব।শুধু আধঘন্টা। আর বাকি সময় মন দিয়ে পড়ব।‘
মিনির বাবা বেশ মজা পেলেন। বললেন, ‘ও-ও এই ব্যাপার, তোর তাহলে টিভি দেখেই টিভি দেখা ছাড়ল। বেশ বেশ।‘
সেই থেকে মিনি টিভি কম দেখে। আর মন দিয়ে পড়াশোনা করে।
দালাল
~ স্বপন জায়দার
পার্ক টা আজ বেশ ফাঁকা। কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় এসে ছেলেটাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো মেয়েটা ।
" কেমন আছিস?"
-" ভালো । তুই ? "
" আমি ভালো নেই রে। বলেই চোখের পাতা নামে নিল রিয়া।
-" কেন রে! "
-" আর কি বলবো বল ?"
কিছুক্ষণ নীরব সময় চলে যাবার পর । আক্ষেপ মাখা গলায় বলে ওঠে শুভ ," আমাদের প্রায় আট বছর পর দেখা । তোর মুখে এ কথা শুনবো বলে, আশা করিনি রিয়া। "
"-জানিস তো আমিও একথা বলতে চাইনি। আসলে সত্যিটা বেরিয়ে গেছে ।"
"কেন রে ? শুনেছিলাম ,তুই তো বেশ সুখেই আছিস । সে কিরে তোরা না ভালবেসে বিয়ে করেছিস? একটা মেয়েও আছে। কি ঠিক তো?
"- হ্যাঁ তুই ঠিক ই জানিস। তবে ক' মাস হল ও যেন কেমন…."
" ও মানে দীপেন?"
"- হ্যাঁ রে দীপেন এর কি হয়েছে ? ভালো ডাক্তার ? "-এসব ডাক্তার কিছু করতে পারবে না। এতদিন পরে তোর সাথে দেখা ,কোথায় হাসি মজা করব তা না করে ,কেবল আমার কথাই বলছি। তা, তুই এখন কি করছিস শুভ দা? কবিতা গল্প লিখছিস গ্রুপ থিয়েটার করতিস এখন ও করিস, না ছেড়ে দিয়েছিস ? "
"- ওসব ছেড়ে দিয়েছি।জানিস তো, বাঙালি ছেলে মেয়েদের জীবনে একটা সময় কবিতা গল্প আসে তারপরে হারিয়েও যায় । ধরে রাখা খুব কঠিন, আর পেশা হিসেবে নিলে তো না খেয়ে মরতে হবে । আমার কথা ছাড়। দীপেনের কি হয়েছে বললি না তো ? "
-" হ্যাঁ রে ভালো কথা তুইতো বাইরে ছিলিস না ? ব্যাঙ্গালোরে,তা চলে এলি কেন রে ? "
-" জানিস রিয়া না ব্যাঙ্গালোরে যখন একা একা কোয়ার্টার এর রেলিং এ দাঁড়িয়ে নীল আকাশ দেখতাম আর তোর কথা ভাবতাম। হয়তো তখন তুই দীপেন এর বাইকের পেছনে চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছিস প্রেম করছিস।"
" শুভ দা আমিও কিন্তু তোকে ভীষণ মিস করতাম।"
-" মিথ্যে বলিস না রিয়া, একটা সময় তোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম থেকে আমি, তুই নয় । "
রিয়া প্রসঙ্গ পাল্টা তে চায় বলে ওঠে ,"এখন আমরা কত বদলে গেছি বল?"
শুভ বলে ওঠে," না রে রিয়া ; আসলে আমরা জীবনের অনেকটা সময় পার হয়ে এসেছি আর সেখান থেকে ফেলে আসা দিনের কথা কেবল স্মৃতি হিসেবে রাখা ছাড়া আর অন্যরকম ভাবার উপায় নেরে । "
"- তোর মনে আছে শুভ দা, সেই যে সেবার বন্যা হলো চারিদিকে জল আর জল। গঙ্গার জল আমাদের পাড়ার ভেতরটা চলে এসেছিল । তুই দাদা দীপেন সবাই মিলে কলাগাছ দিয়ে নৌকার ভেলা বানিয়ে ছিলিস। কত মজা করে ঘুরছিলাম সারাদিন ধরে।" শুভ বলে ওঠে-" পুরনো দিনের কথা ছাড় । তুই কি জন্য ফোন করে ডাকলি বল ? "
-" কি করে বলি বলতো ? " রিয়া লজ্জা পায়। তাও বলতে থাকে , -" ভীষণ খারাপ লাগছে। না থাক। তুই কি ভাববি। হয়তো মনে মনে স্বার্থপর,ধান্দাবাজ ভাববি…."
" দেখ রিয়া, প্রয়োজন টা তোর আর সেটা বলার দায়িত্ব ও তোর আর সেটা যদি বলার মত হয় বল?
না হলে থাক আমি চলি…."
"- না ঠিক তা নয়। তবে , আমি একটু ব্যাস্ত আছি রে!"
ব্যস্ততা দেখায় শুভ ।
রিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে ,-" একদিন তোর কত সময় ছিল আমার জন্য। তবে যে কথা বলতে আসা।"
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আশেপাশে দিকে চোখ বুলিয়ে নেয় রিয়া। সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে । উঁচু থেকে উঁকি দেওয়া রাস্তার বাতিস্তম্ভ গুলো আস্তে আস্তে চোখ খুলছে । এমন নিঝুম নিস্তব্ধ পরিবেশে নিঃস্তব্ধতাকে সাক্ষী নিয়ে রিয়া বলে ,"-শুভদা আমাকে একটা যে কোন কাজ আর কিছু টাকা ধার দিতে পারিস ।"
-" কেন রে ? হঠাৎ টাকার দরকার? দীপেন এর ব্যবসা খারাপ চলছে ?"
-" আর ব্যবসা এখন একটা অন্য মেয়ে ছেলে জুটিয়েছে ,মদ খেয়ে ঘরে এসে গালাগালি করে, মারে এমনকি মেয়েটাকে কাছে নেয় না । ….."
-" তোর মেয়ে তো বেশ বড় হল। স্কুলে পড়ছো তো?" রিয়া মাথা নিচু করে ঘাড় নেড়ে উত্তর দেয় মুখে কোন উত্তর দেয় না। বিপরীতমুখী আসা একটা গাড়ির আলোয় দিয়ার মুখটা পরিষ্কার দেখতে পায় শুভ । চোখের কোনে কয়েক ফোঁটা জল। গাড়িটা পাশ দিয়ে দ্রুত গতিতে চলে যায় ।
**************************************************
( ২ )
হঠাৎ পাখির ডাক । মোবাইলের স্কিনে কতগুলো সংখ্যা ফুটে ওঠে।পূজা দৌড়ে যায় বলে ওঠে-" মামনি মামনি তোমার ফোন।" রিয়া পূজার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নেয় । রিয়া উত্তর দেয় " কে ? " অপর প্রান্ত থেকে কোন উত্তর আসে না। রিয়া বলে
-" আমি রিয়া বলছি । আপনি কে ?"
অপরপ্রান্ত থেকে এইবার একটা মহিলা কণ্ঠস্বর
-" আপনার একটা কাজের দরকার?"
রিয়া আনন্দ বলে ওঠে -"হ্যাঁ -হ্যাঁ কিন্তু আপনি ! জানলেন কি করে ? আর আমার নাম্বার নম্বর পেলেন কি করে?"
অপর প্রান্ত থেকে উত্তর ভেসে আসে," সেটা না জানলেও চলবে। যা বলছি মন দিয়ে শুনুন । নেক্সট ফোনে আপনাকে সময় জায়গা জানিয়ে দেওয়া হবে। কোথায় যেতে হবে তাও বলে দেওয়া হবে। তবে আপনাকে প্রথম বেশ কয়েকটি প্রোগ্রাম দিনে অ্যাটেন্ড করতে হবে, পরে রাতে এবং বাইরে যেতে হবে। আপনি রাজি থাকলে বলুন?"
রিয়া আনন্দে কথার উপরে কথা বলতে শুরু করে
-" আমি পারবো, যে কোনো কাজ করতে পারি তবে আমিতো বেশি লেখাপড়া শিখিনি ওই কাজ চালানোর মত।…."
অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর আসে-" ঠিক আছে, আমাদের সাথে কাজ করার দুটো শর্ত প্রথম ক্লায়েন্ট যা বলবে তা পালন করতে হবে এবং তাকে খুশি করতে হবে।
দ্বিতীয় শর্ত আপনার আকর্ষণীয় ক্ষমতা দিয়ে ক্লায়েন্টকে বারবার অংশগ্রহণ করতে সহায়তা করা । প্রোগ্রামের এক ঘণ্টা আগে আপনাকে সময় জায়গা জানিয়ে দেওয়া হবে ভয়ের কোন কারণ নেই প্রোগ্রাম শুরুর আগেই পেমেন্ট করে দেওয়া হবে।"
রিয়া কিছু বলতে চায় তার আগে ফোনটা কেটে যায় ।
***************************************************
( ৩ )
" মা…."
" কে পূজা ?
রিয়া উত্তর দেয়।
" মা কাল আর স্কুলে যাব না ।" পূজা মুখটা কাঁদো কাঁদো মুখে ভাবে বলে ওঠে।
"-কেন রে ? " রিয়া সব জেনেও উত্তর চায় পূজার কাছে।পূজা বলে ওঠে মিস বলেছেন," আমার তিন মাসের ফিজ্ বাকি একমাত্র আমার ই। এবার নাম কেটে দেবে। তার চেয়ে আজ স্কুল যাব না তাহলে তো আর মিস নাম কাটতে পারবে না …" বলেই রিয়ার কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে পূজা।
রিয়া মেয়ে পুজাকে সান্তনা দেয়-" শোনো... শোনো বোকা মেয়ে কালকে, গিয়ে আমার নাম বলবি। জানিস আমি আর তুই তোর ওই জলি মিস একই স্কুলে পড়তাম। বলবি ক'দিন পরে সব টাকা মিটিয়ে দেব। কাঁদতে কাঁদতে পূজা বলে ওঠে " মিস তোমাকে চেনে তাই এতদিন কিছু বলেন নি । না মা , আমি স্কুলে যাব না।" রিয়া পূজার মাথায় হাত বুলাতে থাকে আর সান্ত্বনা দেয় । পূজা আবার প্রশ্ন করে ," আচ্ছা মা , বাবাকে ডাক্তার দেখাও না কেন? রোজ কত রাতে বাড়ি আসে । দাঁড়াতে গেলে পড়ে যায় । আমাকে ভালোবাসে না । চলনা তুমি আর আমি মিলে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। " রিয়া মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে চোখের জল ধরে রাখতে পারে না । নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ওঠে , যাব রে যাব পূজা ; পূজা আবার বলে ওঠে, " বাবা ভালো হয়ে গেলে। তোমাকে অনেক টাকা দেবে , তখন আমি স্কুলে যাব । হঠাৎ রিয়ার মোবাইল টা আবার বেজে ওঠে। এবার একটা পুরুষ কন্ঠ ," হ্যালো রিয়া বলছো?"
রিয়া উত্তর দেয় "হ্যাঁ বলছি, কাল দুপুর দুটো আপনার প্রথম প্রোগ্রাম। আপনি ঠিক সময়ে হোটেল 'ওয়েলকাম ' এর সামনে্য থাকবেন।
আপনাকে প্রথম দিনের প্রোগ্রাম দেওয়া হবে দিনে।পরে রাতে এবং ক্লায়েন্টের সাথে বাইরে যেতে হবে যদি আপনি রাজি থাকেন আশা করি আমাদের শর্ত মনে আছে তবু আবার বলছে ক্লায়েন্টকে খুশি করার কাজ। রিয়া আনন্দ উত্তর দেয় ," হ্যাঁ ঠিক আছে ।'
**************************************************
(৪)
সেদিন রাতে পূজা কে জড়িয়ে ধরে সারারাত রিয়া গুলো কাঁদলো এবং কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরল পরের দিন নতুন জীবিকার সন্ধানে যাবে সে। প্রেম - দীপেন এর ভালোবাসা ,পূজা সব সবকিছুর স্বাদ কেমন যেন বিষাদ হয়ে গেছে। এবার কাটা চামচ ,ফিশ ফ্রাই ,বিয়ার , ব্লু জিন ,অফিসার চয়েস আর টাকার স্বাদ বুঝতে হবে তাকে।
ধুলো বালির দিন
~ ঋভু চট্টোপাধ্যায়
-সদা, এই সদা একট বিড়ি দে না।
-বিড়ি মিয়াই গিছে, মুত লেগি গিছে।
-বিড়িতেই মুতলি নাকি?
-না’রে, এই যে হাগতে গেলম, শালাদের জ্বালায় কি ভালো করে হাগার জোর আছে, বিড়িট ধরাইলাম ওমনি চেল্লাতে আরম্ভ করলেক, জলদি করতে গিয়ে পুরো ঠোঙাটই গেলেগ পড়ে।
-তু বোস, আমি একট বিড়ি লিয়ে আসি।
-একট লয় দু’ট আনবি, গলাট শুকায় গেছে।
মমিণ চলে যেতেই সদা পা’দুটা ছড়িয়ে বলে ওঠে,‘রাধে রাধে।’
এ’নিয়ে তিন বার সদা এই মেলাতে এল।মমিণ অবশ্য এর আগে অনেকবারেই এসেছে, খেয়েছে, আর বাড়ি যাবার সময় বস্তা করে চাল আর পকেটে টাকা ভরে নিয়ে গেছে, তিনবছর আগেই লতিফের চায়ের দোকানে একদিন সকালের চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতেই পাশে মমিণ এসে বসে।সদার চায়ের দামও দিয়ে দেয়, সকালেই একটা গরম চপ খাওয়ায়।সদা একটু হেসেই জিজ্ঞেস করে,‘বারে, গেদে মাল কামাইছিস নাকিরে?’
মমিণ কোন উত্তর না দিয়ে গুন গুন করে গেয়ে ওঠে, সদা অবাক হয়।চোখমুখে একটা চাপা কৌতূহল জেগে ওঠে।মমিণের দিকে তাকিয়ে থাকে কোন প্রশ্ন করতে পারে না।তবুও মমিণকে খুব অচেনা মনে হয়, কোন এক অচেনা অজানা গ্রহ থেকে এসে এখানে সদার কথাবার্তা শুনতে এসেছে।মমিণ সদার দিকে তাকিয়ে বলে,‘সিগারেট ফুঁকবি?’
-সিগারেট!হাসালি, পয়সা কুথায়?শালার কাজেও এক পয়সা নাই, কিভাবে যে হাঁড়ি চড়ছে সেট আমিই জানি।
-আমি দিব।
তারপরেই বেশ ডাঁটের মাথায় লতিফকে বলে,‘দুটো সিগারেট দে তো, ভালো দেখে দিবি।’
চায়ের দোকানের বাকি সবাই মমিণের দিকে অবাক চোখে তাকায়, মমিণ সিগারেট ধরায়, সদাকে দেয়।সদা সিগারেটটা মুখে দেবার আগে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, তারপর মুখে নিয়ে ধোঁযা ছেড়ে মমিণের হাত ধরে দোকান থেকে একটু দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলে,‘তুই কি লুটারি কিনেছিস?’
মমিণ ধোঁয়া ছেড়ে গুন গুন করে গান ধরে,‘রূপ দেখি আপনার কৃষ্ন(কৃষ্ঞ) হয় চমত্কার/ আস্বাদিতে মনে উঠে কাম।’
-বেশি কাঁঠালি করিস না, বল কেনে কি করলি ?
মমিণের চোখ মুখে তৃপ্তির ছাপ।‘তু আসছে বছরকে যাবি?সব বুঝবি মজা লাগবেক, থাকা, খাওয়া, হাগা সব ফিরি, চাল পাবি টাকাও পাবি আমি তো ইবার চার হাজার পেনছি, চালট বিচে আরো শ’তিন।
-কদিন ছিলি ?
-চার দিন।
-বাপরে, চারদিনে এত টাকা!তা আমি কি করব?
-মমিণ সিগারেটটা নিচে ফেলে শেষ ধোঁয়াটা ছেড়ে বলে ওঠে,‘বুলব সব বুলব, তার আগে শহর যাব, টুম্পা মাগিটাকে একবার চটকে আসি।’
সদা মমিণের কথা শোনে আর বাড়িতে টুসির কথা মনে আসে, কবে থেকে একটা ভালো কাপড় খুঁজছে কিন্তু যা হাতের অবস্থা দিতে লাড়ছে।নিজের এক শতকও জমি নাই, মুনিষ খেটে রোজগার হয়, আর ঐ এদিক ওদিক।ছিলাটর লগেও কিছু কিনে নাই।মমিণের কথাতে লেশা লাগে। লিয়ে যাবেক বলিছে, তাও ভয় হয়, কথা কি রাখবেক ?
মমিণ অবশ্য কথা রেখিছে।শীত পড়তেই একদিন সকালেই সদার ঘরে এসে সব কথাবার্তা বলে, চা খেয়ে সদার বউ এর সাথে একটু রঙ্গ রসিকতা করে, ছোট ছেলেটাকে একটু চটকে তার হাতে একটা লেড়ো বিস্কুট দিয়ে ঘর ছাড়ে।যাবার সময় সদাকে সব কিছু বলে যায়।সদা সব মনে রাখে, তারপর মমিণের কথা মতই একটা ঝোলা নিয়ে বাসে চেপে যায়, মমিণও থাকে। বাস থেকে ট্রেন, ট্রেন থেকে নেমে আবার বাস।সব ভাড়া মমিণ দেয়, সদা কিছু টাকা ধার নিয়ে এসেছিল, কিন্তু মমিণ বলে, ‘তুকে এখন দিতে হবেক নাই, পরে দিবি।’
সদা এদিকে আগে আসেনি, তবুও বাস থেকে নেমেই বুঝতে পারে।মমিণের দিকে তাকিয়ে বলে,‘বাবা, তুই ইখানে এলি, ছুটু বেলাকে এসিছিলম।’
-ভালো, শুন, ইবার প্যান্ট জামা খুলি লে।
-মানে ল্যাংটো থাকব ?
-না’রে, আমার ঝোলায় কাপড় রইছে, দুজনাই পড়ব।
সদা একটা বাসের পিছনে গিয়ে তার পরনের জামা কাপড় খুলে ঝোলাতে থাকা একটা গেরুয়া লুঙ্গি আর হাতকাটা ফতুয়া পরে, মমিণ এসে মাথায় একটা পাগড়ি বেঁধে, কপালে একটা তিলক কেটে দিয়ে সামনে দাঁড়ানো একটা ছোট গাড়ির লুকিং গ্লাসের দিকে দেখিয়ে বলে,‘যা দেখগা।’ সদা নিজেই নিজেকে চিনতে পারে না।মমিন বলে ওঠে,‘লে ইবার চ।’ কিছু দূর গিয়ে মমিণ রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে দু’দিকটা একবার ভালো করে দেখে বলে ওঠে,‘লে ইখানে তুই, পাশটতে আমি, বসি যা, নইলে আর লাড়বি।’
-বসি কি করব ?
-কিছু না শুধু মুখে রাধা রাধা বলবি, তাতেই দেখবি সব হইযেছে।
সদা চারদিকটাতে আরেকবার তাকিয়ে নেয়।আরো অনেকেই রাস্তাতে আছে, কেউ একটা ঠাকুর বসাচ্ছে, কেউ তাঁবু বানাচ্ছে, কেউ একটা মাটির শিব বানিয়ে কালো রঙ করছে।মমিন সদার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,‘লে লে বসি যা, কাল থেকে পোঁদ পাততে লাড়বি।’
সদা চোখে সামনে তার বাবা মা কে দেখে।দুজন, ছোট্ট সদাকে ধরে ধরে এই পৌষ সংক্রান্তির ভোরেই নদীতে স্নান করিয়ে রাস্তায় হাঁটবার সময় পাশে বসে থাকা হাজার হাজার মানুষকে চাল ছড়িয়ে দিয়ে যায়।অল্প চাল, কিন্তু লোক তো অনেক, তিনদিন ধরে স্নান, বেশ, মজার ব্যাপার।
-কি’রে বস, আমি একট পেলাস্টিক লিয়ে আসি।
-কি করতে হবেক?
-কি আবার রাধা রাধা বলবি আর যারা স্নান করে যাবে তাদের কাছে হাত পাতবি।
-ভিক্ষা!
-শালা আমি মুছলমান হয়ে রাধা গেয়ে দুনিয়া করছি আর তুই হিঁদুর বেটা হয়ে লাড়বি?শেষের কথাগুলো বলতে বলতেই মমিণ বলে ওঠে,‘ভিক্ষা মেগে খায় সদা হরিনাম জপে/হাসে কাঁদে নাচে গায় শিবের মণ্ডপে।’
-তুই এত সব কুথাকে শিখলি?
মমিণ হেসে ওঠে,‘আমার ইট লিয়ে ছ’বছর হবেক।’ সদা সব দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, তারপর ক্ষীণ শরীরের নদীর জলে স্নান করে নিজের ভিতরের সদাকে বিসর্জন দিয়ে মেলার সদাঠাকুর হিসাবে সেজে নেয়।
সে’বছরেই প্রথম মমিণ আর সদা দুজনা একসাথে প্লাস্টিকের একটা তাঁবুর নিচে দুটো ঠাকুরের ফটো নিয়ে বসে বসে গান আরম্ভ করে।সকালে সন্ধায় আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ স্নান করে দু’পাশে বসে থাকা মানুষদের চাল, টাকা, কেউ ফল দিয়ে যায়। তিনদিনের মেলায় শেষ দিন একজন এসে পুরানো পোশাক দিয়ে যায়।মমিণ আগে এসেছে, সদার প্রথমে বসতে একটু অসুবিধা হয়, কিন্তু কিন্তু লাগে, তারপর আর কোন কষ্ট নাই।কেউ তো আর ভিখারির মুখ দেখে না।তার ওপর সদা গেরুয়া লুঙ্গি ফতুয়ার সাথে মাথাতে একটা পাগড়িও বেঁধে নিয়েছে।মেলার তিন দিন সব ফ্রি, সকালে চা বিস্কুট, বেলাতে খিচুড়ি, দুপুরে কোন দিন ভাত, কোন দিন খিচুড়ি, রাতেও কোন অসুবিধা নাই, মমিণের চেনা আখড়া রইছে।রাতে দিব্যি বাউল গান শুনতে শুনতে ঘুম।হাগা মুতার কষ্ট নাই।সেই বছরই বাড়িতে বেশ কয়েক হাজার টাকা নিয়ে যায়।শেষদিন এক জন এসে সব খুচরো নিয়ে নোট দেয়, চালও কিনে নেয়, তাও ঘরে টাকা, চাল ফল কাপড় বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে।বউ খুশি হয়, জিজ্ঞেস করে, সদা কিছু বলে না, মমিণ বারণ করে দিয়েছে, শুনে কেউ বলতে পারে,‘শেষ কালে মেলাতে গিয়ে ভিক্ষা!’ মমিণকে কথাগুলো বলতেই রেগে যায়।এবছর সদা সব কিছু জেনে নিয়েছে।নদী পোশাক তাঁবু, মূর্তি আর মুখে রাধা রাধা।এবারেও নদীতে প্রচুর লোক, সবাই স্নান করে এবারেও টাকা দিয়েছে, চাল দিয়েছে।বিনা পয়সায় চা বিস্কুট খেয়েছে, খিচুড়ি খেয়েছে, ভাত খেয়েছে, আখড়াতে গান শুনেছে।শুধু মেলাতে ঢোকার পর থেকেই শুনে যাচ্ছে এবার ভিখারিদের থেকেও টাকা নেওয়া হবে।কয়েকজন নাকি দিয়েও এসেছে।সদার তারপাশে বসা একটা নাগার থেকে শোনে, ঐ লোকটাও লেবার খাটে।প্রতিবছর মেলাতে আসে, আর এমনি ভাবে বসে থাকে মমিণও তার মুখ থেকে সব কিছু শুনেছে, তবে গা করেনি।মেলার শেষ দিন সবকিছু গুটিয়ে বাড়ির ফেরার জন্য তৈরী হচ্ছিল, খুচরো পয়সা, চাল সব কিছু নেবার বা পরিবর্তন করবার লোক দেখা করে গেছে।নদীর দুটো দিকে সন্ধা নামছে।মেলার আলোর ব্যবস্থা বন্ধ হয়েছে, মমিণ একটা মোম জ্বালিয়ে তাঁবুর নিচে বসে বসে পয়সা গুনছে, সদা পাশে বসে।এমন সময় মেলা কমিটি থেকে দুজন এসে মমিণের তাঁবুর কাছে দাঁড়িয়ে বলে,‘এই শালা মেলার টাকাটা কে দেবে?’
মমিণ শুনেও না শোনার ভান করে আগের মতই কাজ করে যায়।এবার একজন তাঁবুটা টান মেরে খুলে চিত্কার করে ওঠে, ‘কি রে কথা কানে গেল না?’
-আমরা তো কুনু বছর দি নাই, ইবছর কেনে দিব?
-অতো কেনে বুঝি না, পাঁচকিলো চাল, আর তিনশ টাকা দিবি।
এবার সদা রেগে ওঠে,‘কিছু দিব নাই, এক পয়সা না।’
‘তবে রে... ’ বলেই একজন এগিয়ে এসে সদার পাশে রাখা চালের পোঁটলাতে টান দেয়।পোঁটলার চাল মিশে যায় রাস্তার ধুলোয়।অন্ধকার আস্তে আস্তে আঁকড়ে ধরে আশপাশ।আকস্মিকতায় সদা কিছু বলতে না পেরে পুঁটুলিটা বুকে চেপে ধরতে গেলেও সেই দুই জন পুঁটুলি সরিয়ে নেয়।অন্ধকার রাস্তার বুকে খুচরো পয়সা আছড়ে পড়বার শব্দ শোনা যায়, সদা মমিণ দু’জনেই ধুলোর উপর শুয়ে বুকে পেটে পয়সা চেপে রাখে।অন্ধকার বড় করুণ, বড় অদ্ভুত, ধুলো চাল পয়সায় মাখামাখি হয়ে শুয়ে থাকে দুটো শরীর, তখনই মন্দিরের কাঁসর বেজে ওঠে, খোল কর্তালের ধ্বনিতে চারদিকে একটা অন্য রকেমর ভাব হয়।এদিকে মেলা শেষে সবাই নিজেদের মত ঘরমুখী।মাঝখানের রাস্তাটাও এখন অনেক ফাঁকা।এই ফাঁকা রাস্তাতেই সদা মমিণ দুজন ধুলো মেখে শুয়ে থাকে।কিছু সময় পরেই মমিণ ডাকে,‘সদা, খুব লেগিছে?’
-না, রে সেরকম লয়, টাকাগুলান চলি গেল, চালটও ছিল, ধুলাতে লুটোপুটি খেচে।
-উঠ, ধুলা ঝাড়।
সদা আর ওঠে না।চারদিন ধরে বসে বসেও শরীরে একটা ক্লান্তি গ্রাস করেছে।সন্ধার একটু আগে মনট খুশি হইছিল খুব, বউ’এর লগে, ছিলাটর লগে মনটা আসার দিন থেকেই খারাপ, আর আনন্দ নাই।শুয়ে শুয়েই বলে,‘আর আসব নাই বল?’
-কেনে?
-এইরম যদি সব টাকা কেড়ি লেয়, উদিকটও গেল ইদিকটও।
মমিণ উঠে এসে সদার পিঠে হাত রেখে বলে,‘শুন, উঠ, কপালের ফের কি করবি বল, তবে আমার টাকাট লিতে পারে নাই।উঠ গুইনতে হবেক,উটোই না হয় ভাগ করি লিব।’ তারপরেই সদা মমিণ দুজনেই অন্ধকার সন্ধের বুকে টাকা ভাগ করতে বসে, মন্দিরে আরতির বাজনা বাজে, ঘরমুখী নদীর স্রোতে যেন নতুন প্রাণ লেগেছে।
এই বছরেই ছেলেটা চতুর্থ শ্রেণীতে উঠেছে । ও, ওর ভাই , মা আর বাবা এই নিয়েই ওর জগৎ ।যদিও বা মাঝে মাঝে এমন অনেক কিছু হতো যেটার কারন বোঝার ক্ষমতা এই ছোট্ট ধ্রুবর ছিল না ।খুব চুপ-চাপ, শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল ।সেই দিনে একটু দেরি হয়ে গেছিল বিকেলে খেলার মাঠ থেকে ফিরতে, ঠিক দেরি নয়---শুধুমাত্র অন্ধকার হয়ে এসেছিল ।আসলে সেদিন স্কাউট এর শেষে দাদাদের সঙ্গে ফুটবল খেলেছিল,তাই বুঝতে পারেনি । ঘরের কাছেই খেলার মাঠ ছিল । দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরলো আর ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছিল--- " ঠাকুর বাবা যাতে ঘরে না থাকে "----- সে জানতো মাকে কিছু একটা বলে manage করে নেবে।একটু বকাবকি করবে আর সেটা তো রোজ ই করে-----কখনো তার কারণ টা বুঝতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই কেন যে বকলো তা ' বুঝতে পারতো না ছোট্ট ধ্রুব। দৌড়ে দৌড়ে ফিরে দুর থেকে দেখতে পেল বেশ কয়েক জোড়া অচেনা জুতো রয়েছে ঘরের দরজার সামনে ।ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো সেখানে বাবার জুতো ও রয়েছে ।মনটা এক মুহূর্তের জন্য খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই খুব খুশি হলাম এটা ভেবে যে আজ এত লোকের সামনে মায়ের বকা বা বাবার হাতে মার খেতে খেতে হবে না । খুব বড় ঘর ছিল না ওদের ।একটা শোবার ঘর আর একটা রান্না ঘর---- এই নিয়েই ভাড়া থাকতো ওরা । শুধু যে বকা শুনতে হবে না তাই নয়, ধ্রুবর খুশি হবার আর একটা কারণ ও ছিল------ সেটা হল বাড়িতে লোক এসেছেন মানে----- নিশ্চয়ই ওনারা কিছু খাবার এনেছেন অথবা বাবা নিশ্চয়ই কিছু এনেছেন সবার জন্য----- যাক আজ সন্ধ্যায় ভালো কিছু খাওয়া যাবে ।
ধ্রুব তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়েছিল---- তারপর ঘরে ঢুকতে যাবে, কি মনে করে পর্দাটাকে সরিয়ে একটু দেখল---- কারা এসেছেন , সে চেনে কিনা--- না কেউ- ই চেনা নয়, লাজুক ধ্রুব একটু থমকে দাঁড়াল---- নিজেকে একটু তৈরি করার জন্য---- ভেতরে ঢুকলে কে , কি জিজ্ঞাসা করবেন এবং সে নিজে কি উত্তর দেবে । চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া ছেলের বুদ্ধি খুব একটা খারাপ নয় , বরং খুব ভালোই বলা যায় স্কুলের শিক্ষকরা যেমন ভালো বসাতেন, তেমনি স্কাউটের দাদা ও দিদি রাও খুব ভালো বাসতো, আদর করতো।পর্দার বাইরে দাঁড়িয়ে যখন নিজেকে প্রস্তুত করছিল----- তখন ঘরের ভেতরের সমস্ত কথাই পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিল ।হঠাৎ - ই কোন একজন ভদ্রমহিলা মাকে জিজ্ঞাসা করলেন---- " আপনার কয়জন ছেলে- মেয়ে "? মা কিছু বলার আগেই বাবা ওনাকে ওর ছোট ভাই- কে দেখিয়ে বলল---- " আমাদের এই একটাই ছেলে "।মা ও একটু হাসি দিয়ে সমর্থন জানাল। ধ্রুব থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল চৌকাঠের বাইরে ।কিছু তেই বুঝতে পারছিল না, কেন তার কথা বলা হল না, ঠিক আছে সে দেরি করে ফিরেছে---- কিন্তু তাই বলে এটা বলবে কেন ! ছোট্ট ধ্রুব সেদিন এটা বুঝেছিল যে এখন ঘরে ঢুকে মা বাবা কে অপ্রস্তুতে ফেলা উচিত নয় ।ধ্রুব ফিরে গেল খেলার মাঠে ।অন্ধকারে বসে এক অজানা কারণেই তার খুব কান্না পাচ্ছিল-- তবু নিজেকে বোঝাতে চাইছিল যে, হয়তো ওরা রেগে আছে, তাই শুধু ভাই- এর কথাই বলেছে , তার কথা বলেনি ------ তবু কান্না থামাতে পারছিল না------ দুর থেকে লক্ষ্য করছিল ঘরের দিকে
যখন লোকজন চলে যেতে দেখল,তখন সে ফিরে গেল ঘরে।মা বলল কোথায় ছিলিস এতক্ষণ, না সেদিন বাবা কিছু বলে নি ।মা বলল রান্না ঘরে সিঙাড়া রাখা আছে, খেয়ে নাও।শান্ত স্বভাবের ছেলেটা চুপ করে রান্না ঘর থেকে খাবার নিয়ে খেয়ে নিল।
স্কুল টা খুব কাছে হলে ও ফিরতে ফিরতে চার- টে বেজে যেত ।মা ভাই-কে নিয়ে শুয়ে থাকতো, রান্না ঘরে খাবার ঢাকা দেওয়া থাকতো, ধ্রুব কিছুতেই ছোট ছোট কালো পিঁপড়ে আর কালো জিরের মধ্যে তফাত টা বুঝতে পারতো না ।বেছে বেছে খেতে অনেক সময় লাগতো, তারপর স্কাউটে যেত।প্রতি দিন-ই এক-ই নিয়ম ।তবে মাঝে মাঝে একটু পাল্টাতো, যখন সিনেমা দেখার প্ল্যান হতো, সেদিন গুলো বাবা- মা আর ছোট ভাই সিনেমা দেখতে যেত। আর ঘরে ছোট্ট ধ্রুব একা থাকতো । না বাচ্চাদের সিনেমা দেখতে নেই তাই ধ্রুব ঘরে, আর ওরা-------- ! একা একা ছোট্ট ধ্রুব খুব ভয় পেত, ওই টুকু বয়সেই ধ্রুব ----- " বিষণ্ণতা "---- কথা টা বইয়ের পাতায় সাধারন ভাবে পড়ে থাকলেও, অর্থ টা খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিল, ভয়ের চোটে ঘুমাতে ও পারতো না ------ যদি ভুত আসে, ------ যদি তুলে নিয়ে যায়,--------তাই জোর করে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকতো। ফ্যান টা ঘুরছে আর ঘুরছে সেটাই দেখতো, আবার কখনো বা হাতের ছায়া দিয়ে হরিন কংবা শিয়াল বানাতো---- আর অপেক্ষা করতো কখন ওরা ফিরবে----- আর কখন ওর ভয় কাটবে ।
ঠিক যে বয়সে একাকিত্বের অর্থ মানুষ বুঝতে পারে তার বিশ্লেষন আগেই হয়তো বুঝতে পেরে ছিল " ধ্রুব "। তবে ওর খুব কাছের সঙ্গী ছিল ওর ভাই ।ওরা দুজনেই দুজনকে খুব ভালো বাসতো------ একটু একটু হিংসে হতো না তা নয় কিন্তু পরক্ষণেই ভুলে যেত। চতুর্থ শ্রেণীর পরীক্ষা ---- বাবা বলল পরীক্ষার ফল ভালো না হলে অন্য স্কুলে নেবে না। ধ্রুব জানতো এরপর হাই-স্কুল, পরীক্ষা হলো, পাস- ফেল নিয়ে কোন দিন-ই চিন্তা ছিল না, ও ---- " বৃত্তি " পেল , হেড- মাস্টার ওকে নিজের থেকে একটা ডিকশনারি উপহার দিয়েছিল । আজ ও ধ্রুব সেটাকে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। নতুন স্কুলে আলাদা পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হলো ধ্রুব । বাইরের জগত-টা অন্য রকম হলে ও ঘরের জগতটার কোন পরিবর্তন হলো না ।
এরমধ্যে স্কাউট - এর থেকে একদিন সবাই কে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হবে, ধ্রুব কেও যেতে দিল---- সারাদিন হই-হুললোর।খুব মজা হলো ।বিকেলের দিকে কয়েক জন দিদি বলল," এই ধ্রুব শোন এদিকে আয়----" ও গেল--- ওকে ওরা একটু জোর করেই নিয়ে গেল মেয়েদের আলাদা টয়লেটের দিকে------ বাচ্চা ছেলে টা সেদিন বারন বা বাধা দিতে পারেনি।ওরা যে তিনজন ছিল---- কিছুই নয় দিদিরা হয়তো শুধুমাত্র হাতের দ্বারা স্পর্শ করেই স্বর্গ সুখ পেয়েছিল,আর ধ্রুব কিন্তু সেদিন সুখের কিছু অনুভব না করলে ও শরীরের কষ্ট খুব অনুভব করছিল তিন জন জাপটে ধরে, নিজেরা হয়তো মানসিক সুখ পেয়েছিল কিন্তু ধ্রুবর মনে----" মেয়ে দের প্রতি একটা" ভয় "সৃষ্টি করে দিয়ে ছিল । " সেদিন থেকে ধ্রুবর ---- একাকিত্ব আরো বেরে গেছিল ।ওরা বলে দিয়েছিল কাউকে বললে মারবে ,না বললেও 'ও' বুঝেছিল এটা কাউকেই বলা যায় না "। ধ্রুব সেদিন কি বুঝতে পেরে ছিল তা ' জানা নেই , " তবে আজ সে জানে- বোঝে কি ছিল সেদিন এর মানে "। না ফিরে আসার পর আর কোন দিন ধ্রুব স্কাউটে যায় নি। দাদারা খুব করে বলতো যেতে কিন্তু ও যায় নি, বিকেলে অন্যদের সঙ্গে অন্য জায়গায় ফুটবল খেলা করতো ।
এই করেই চলে গেল দুটো বছর ।তারপর-ই এল অন্য বিপত্তি ।হঠাৎ একদিন বাবা আর মা কি যেন কথা বলছিল। কি সেটা না বুঝলে ও, ওকে নিয়েই যে হচ্ছিল সেটা বুঝতে পেরে ছিল ও। তারপর ওকে বলল, " দেখ ---- আমাদের ঘর তো ছোট , এক কাজ কর তুই কদিন আমার একটা বন্ধুর বাড়িতে থাক , ঘর পাল্টালে নিয়ে আসবো----- ধ্রুব জানতো এটা ওর মতামত চাইছে না কেউ--, তাই সব গুটিয়ে বাবার আত্মীয়-র বাড়ি রওনা হলো।ওখানে পৌঁছানোর পরের দিনই তাকে ওখানকার একটা স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো-------- ১৩ বছরের ধ্রুব বুঝতে পেরে ছিল যে নিজের জীবন নিজেকেই তৈরি করতে হবে ।
না আর কিছু দিন বাদেই ওরা ঘর পাল্টে ছিল, অনেকবার " ধ্রুব "--- গেছিল বাবা- মা আর ছোট ভাই এর কাছে কিন্তু থাকা আর হয়নি তার ওদের সঙ্গে ।তবু দুই ভাইয়ের
মধ্যে খুব মিল ছিল, খুব মিস্ করতো ধ্রুব ।১৬ - বছরের ধ্রুব--- মাধ্যমিক দেবে , স্কুলের সবার থেকে খুব ভালোবাসা পেত ওর শান্ত স্বভাবের জন্য। টিচার-রাও খুব সাহায্য করতেন ।খুব ভালো ছাত্রদের মধ্যেই তাকে ধরা হত ।মাধ্যমিক শেষ, বাবা- মায়ের কাছে গেল , সারাক্ষন ভায়ের সঙ্গে সময় কাটতো।ওর থেকে ---- ৪ - বছরের ছোট সে, কিন্তু খুব বন্ধু ছিল দুজনে।
রেজাল্ট বেড়োল---- ১১ ক্লাশে ভর্তি হলো । খুব ভালো ভাবে পাস করার জন্য ভর্তি হতে অসুবিধা হলো না। জীবন- টা অনেক না পাল্টালেও,একটা বড় পরিবর্তন হয়েছিল যে "ধ্রুব " এখন নিজের বাড়িতেই থাকে । সেদিন শীতকাল ছিল, সন্ধ্যার পরেই কোন একটা কারন নিয়ে ঘরে প্রচণ্ড ঝগড়া হচ্ছে, সেই শীতের রাত-টা কোন দিনই ভুলতে পারবে না "ধ্রুব "। ও সেদিন জীবনের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছিল। প্রথমে বিশ্বাস করতে না পারলে ও মেনে নিয়ে ছিল সত্যি টাকে ।সেদিন-ই সে প্রথম জানতে পেরেছিল যাঁদের ও বাবা- মা বলে জানে ,তাঁরা এতদিন তাকে পালন করেছেন। ওঁদের সন্তান না হওয়ায় ওকে নিয়ে এসেছিল কিন্তু পরে ভাই হওয়ায় আর -------- সেদিন ঐ প্রচন্ড শীতের রাতে বারান্দায় যে চেয়ার টা ছিল তাতেই শুয়ে পড়ল।এক সময় যখন প্রচণ্ড শীত করতে লাগল চেয়ারে পাতা বস্তার ভেতরে ঢুকে নিজেকে রক্ষা করলো । সেদিন ভগবানের কাছে বারবার অনুরোধ করেছিল তাকে শক্তি দিতে ,মনের জোর দিতে । মনে মনে কবি গুরুর লেখা দুটো লাইন বির বির করে বলতে লাগল------ " বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়--" প্রতি দিনের মতোই সকাল হলো। ধ্রুব কোন কথা বলেনি , কোন প্রশ্ন ও করেনি সকাল বেলায় খেয়েছে, সব কিছু নর্মাল ভাবে । দুপুরে বাবা কাজে বেড়িয়ে ছিল, মা ঘুমিয়ে ছিল ।ধ্রুব নিজের সার্টিফিকেট গুলো একটা পলিথিনে মুড়ে নিল।মাকে দুর থেকে প্রনাম করল।ভাইটাকে কেবল ফাঁকি দিতে পারল না।ওদের রক্তের সম্পর্ক নাই বা থাকল---- ওরা যে খুব ভালো বুঝতে পারতো একে-অপরকে ।ভাই এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। অনেক কষ্টে ওকে থামালো। বলল চুপ কর নয়তো মা জেগে যাবে ।ব্যাস কিছুক্ষন ভাই কে আদর করার পর বলল-------- মা বাবার খেয়াল রাখিস।এক জামা- কাপড়ে নিজের দরকারি কাগজ কটা প্লাস্টিকে মুড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়ে গেল "ধ্রুব "। অনির্দিষ্টের সন্ধানে । ধ্রুব জানতো এখান থেকে কিছু পাবার নেই ।ভাই কে বলেছিল----- যেদিন নিজে দাঁড়াতে পারবো ফিরে আসবো। মনে রাখিস আমায়----------।
কবিতা- ৩
চাঁদ
~ অঙ্কুরিতা দে
চাঁদের পেট কেটে বেরিয়ে যাই আমি, পিচ্ছিল জ্যোৎস্না মাখা পথে, পা চেপে চেপে চলি।
ঘূর্ণি হয়ে দাপিয়ে বেড়াই।
চাঁদের কাঁধে চড়ে রামধনু দেখি।রং লাগে চোখে।
আমি একটা একটা করে খুঁটি পুতি।
একদিন ছাদ দেই।আড়াল হয়ে যাই, সেই চাঁদের থেকেই।
কোনোদিন চাঁদকে কৌটোয় পুড়ে রেখে দেই, ঠাকুরের আসনে থাকা লক্ষীর ভাঁড়ে।অসময়ে কাজে দেবে।
আমি তারা ভালোবাসি এখন,রঙিন বিজলি বাতি ভালোবাসি।
চাঁদকে আর মনেও পড়েনা।
হঠাৎ চরাচর আঁধারে ডুবলে, ভয় পাই আমি।জোনাকিরা মনে করায় যে-আমারো একটা চাঁদ ছিল মাথার ওপরে।
কৌটো থেকে বের করতে গিয়ে দেখি, চাঁদ সেখানে কবে শুকিয়ে ভুত।
শেষবারের মতো ডাকি-“মা!”
----------
অসুখ
~ উত্তম মণ্ডল
কেউ ভালো নেই
বিষ নামছে শরীর বেয়ে
থেরাপি ঔষধ
প্রস্রাবে চিনি
প্রৌঢ়ত্ব মাখামাখি করে আছে অসুখ
মধুর সম্পর্ক শারীরিক ইতিহাস
ঝুপ করে গিলে নেয় আলো
জীবন যেন শীতের বিকেল
রোদ থেকে হলুদ তুলে নিলে
ওইটুকুই জীবন
বাকিটুকু মোহ
গুরুদেব
শান্তা কর রায়
তাঁকে নিয়ে বলার ছিলো অনেককিছু
অনেকটা পথ চলতে গিয়ে দুই তালুতে গীতবিতান
ঘরের তিনি সেবক মনে আগলে রাখেন কথাকলি
কখন আবার শীতশীত ভাব নেই তুলনা মাত্রিকতায়
নতুন নতুন ছবি আঁকি,
প্রেমিক কবি শিক্ষাবৃত্তে গ্রন্থিত হন
চোখের থেকেও মনের কথন যাঁরা বোঝেন
ধারাবাহিক নির্মাণ এক সিলেবাসের ভাষার আদল
সংকটে মেঘ সরিয়ে তিনি বিপ্রতীপে তত্ত্ব ছড়ান
দর্শাবে সেই কল্পনা রঙ ঔপনিবেশিক শাসনকালে
সবাই বোঝেন বেড়া টানেন তাঁর গানে এই সৃষ্টি কথা
তাঁর মননে যুক্তি অনড় বৈদিক সেই তুলির আঁচড়
সংগত সেই আখ্যানে আজ নাইবা খুঁজি স্তরের বুনোট
ভাষার বয়ান মিথ হয়ে থাক সুপ্রয়োগে
পাঠক্রিয়ায় এক হয়ে যাক সম্পর্ক ও সত্ত্বার মেঘ
ব্যক্তি আসুক খন্ডীকরণ বিদ্যা শিখে
যেখানে সে অভিজ্ঞেয়, স্তরেস্তরে সাজিয়ে রাখেন উপনিষদ
স্বরূপ যে তার মনোবিজ্ঞান কুশলতা
নান্দনিকতায় স্রোতকে বলেন বাঁক নিতে হয়
রক্তমাংসের মানুষ তিনি বিষয় খুঁজুক সেই পরিচয় ।
দেশমাতা
--- ----পার্থ চক্রবর্ওী
দেশমাতৃকা, তোমাকে হারিয়েছিলাম পলাশীর প্রান্তরে
আমি ফিরে আসবই, আসবই আবার ফিরে
এবার অন্ধকারে নয়, ফিরব প্রখর সূর্যের আলোকে
গনগনে আঁচে চোয়াল শক্ত করে হাতুড়ির আঘাতে
খুঁজে নেব তোমায় ধানের শীষে কৃষকের কাস্তেতে
ফিরে আসতেই হবে আমাকে
যে হিসাব মেলাতে পারিনি আমি পলাশীতে
সেটাই গোজামিলে মিলেছে লালকেল্লাতে
চেনা মালিকের গোলামি করে যাচ্ছে ঘটি বাটি হারিয়ে
স্বাধীনতা পড়েছে ঘুমিয়ে পরাধীনতার চাদর মুড়িয়ে
এই ঘুম ভাঙাতেই হবে আমাকে
তোমরা আজ নিঃস্ব সন্তানকে শিক্ষা আর স্বাস্থ্য দিতে
শুধু অস্ত্রে শান দিতে অর্থের অপচয় হচ্ছে কত
পলাশীর অস্ত্র রেখেছে এখনো মীরজাফরের মত
ভেবেছে বোকা প্রজারা বুঝবে কি করে কত ধানে কত চাল হত
এই হিসাব শেখাতেই হবে আমাকে
সন্তানহারা মায়ের জ্বালা কি করে তোমরা বুজবে
ক্ষমতার সওদা করছ দেশপ্রেমের টুপি পরে
দাওনি ফিরতে আমাকে, এবার খুঁজে নেব ঠিক তোমাকে।
ধারাবহ
রেল কলোনির আড্ডা
---- সন্দীপ দাস
( তথ্য আরো অনেক কথা বলতে পারে , কিন্তু এই লেখাটি আমার দেখা ও বাবা জ্যঠাদের মুখ থেকে শোনা অভিজ্ঞতা )
গ্রাম্য পরিস্থিতির মধ্যেই বড় হয়েছি । গ্রাম চিরকাল তাই আমার মনের মধ্যেই রয়ে গেছে একটা ছাপ হয়ে । সত্যি বলতে গ্রাম নিজের বাহ্যিক দিক থেকে শহর থেকে অনেক পিছিয়ে । অনেক গ্রাম এখনো অন্ধকারে ডুবে আছে । এখনো বহু গ্রাম অনেক পিছিয়ে । তবে গ্রামের আভ্যন্তরীণ রূপটা সত্যিই মনহারি । সেই ভাগা , কুসবেদিয়ার আতিথেয়তা আমাকে খুব টেনে নিয়ে যেত । আর যেটা আরো বেশি আকৃষ্ট করতো তা হল তাদের সরলতা । ওই সরল আদিবাসীদের মুখ চেয়ে মনে হতো না কোনদিন ওরা কাউকে ঠকাতে পারে কখনো । বাবার মুখে এই সাঁওতাল গ্রাম ও আদিবাসীদের নিয়ে অনেক সত্যি ঘটনা শুনেছিলাম । যত শুনতাম ততই এই মন পালাই পালাই করে উঠতো । বেশ অনেকবারই গেছিলাম সেই গ্রামে । মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম ওই মাটির ওপরে বসে । সেই অভিজ্ঞতা আজ না বললে খুব অন্যায় হবে । তবে তার আগে বাবার মুখ থেকে শোনা একটা গল্প বলি ।
চিত্তরঞ্জন শহরে একবার বাঘ বেড়িয়েছিল । সারা গ্রাম রাত জেগে কাটিয়েছিলাম বেশ কয়েক রাত । বন দপ্তরকে খবর দেওয়া হল , কিন্তু বন দপ্তর বাঘটিকে খুঁজে বের করতে না পেরে ফিরে গেল । তারা ধরে নিয়েছিল অজয় নদ পার করে বাঘটি তৎকালীন বিহারে ঢুকে পড়েছে । কিন্তু তাদের অনুমান সম্পূর্ণ ভুল ছিল । দুদিন এর মধ্যেই বাঘের গর্জনে সারা শহর জেগে উঠল । আদিবাসীরা মাদলের শব্দে ঢেকে ফেললো গোটা এলাকা । মশাল হাতে সারা রাত জুড়ে চললো খানা তল্লাশি । অবশেষে , ভোর বেলায় বাঘটিকে শিকার করা হল , সৌজন্যে সাঁওতাল আর আদিবাসী শ্রেণী । সত্যি অদ্ভুত সেই আদিবাসী ভাবনা , অদ্ভুত তাদের ভালোবাসা মানুষের জন্য , অদ্ভুত তাদের ভালোবাসা আমার শহর চিত্তরঞ্জনের প্রতি ।
চিত্তরঞ্জন শহরে কাটানো দশ বছরে দশ হাজার জীবনের আনন্দ আমি উপভোগ করেছি । উপভোগ করেছি এর ইতিহাস , এই শহরের গরম , এই শহরের শীতের কুয়াশা , আদিবাসী প্রতিবেশী গ্রামের আপনতা , সূর্যোদয়ের ও সূর্যাস্তের সৌন্দর্য্য , গাছপালায় ঘিরে থাকা একটা নাম : শহর থেকে দূরে একটা শহর : চিত্তরঞ্জন । অনেকেই এই শহরটাকে কাড়া নগরী নাম দিয়ে থাকলেও , এই শহর কোনদিন কাউকে নিজে থেকে বেঁধে ফেলেনি , বরং এই শহরে যে বা যারা এসেছে , তারাই বাঁধা পড়ে গেছে এর মায়ায় । বহু দিনের চেষ্টার মধ্য দিয়ে আমার প্রাণের শহরটাকে সকলের প্রাণে মিলিয়ে দেওয়ার এক ছোট্ট প্রচেষ্টা এই লেখা । শুরুটা তার হোক আমার এলাকা এরিয়া ২ অথবা সুন্দর পাহাড়ি নর্থ থেকে , যেখানে কাটানো দশ বছরে দশ কোটি ঘটনা একটু একটু করে ফুটিয়ে তুলবো আর তার মধ্যে দিয়ে সবাই দেখতে পাবেন একটা ভারতবর্ষের ছবি ; যার বৈচিত্রের মধ্যেও কত ঐক্য । তাহলে ক্যামেরা ঘোরানো যাক আর অফিসার কলোনি ধরে সটান ঢুকে পড়া যাক ৭০ নম্বর রাস্তার এক প্রান্তে যার কোয়ার্টার নম্বর শেষ হয়েছে ৭৬/বি - তে । এর পড়েই একটি চার মাথার মোড় পার করলেই ঢুকে পড়া যায় অফিসার কলোনির বাংলোর দরজায় । এই পিচ রাস্তার দুদিকে সারিবদ্ধ ভাবে বাংলো দাঁড়িয়ে আছে আর পথটি শেষ হয়েছে মিহিজাম সংলগ্ন ১ নম্বর গেটের কাছে । পথটি স্থানীয়ভাবে সানসেট এভিনিউ নামে পরিচিত । রাস্তার প্রায় শেষের দিকে অবস্থিত জি এম বাংলো আর ঠিক তার উল্টোদিকে রয়েছে একটি বন সৃজন প্রকল্প আর একটি গল্ফ কোর্স । এই স্থান থেকে সূর্যাস্ত দেখার মজা সত্যিই অপরূপ ও মনহরিনী ।
চিত্তরঞ্জন রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে যে রাস্তাটা বেরিয়ে আসছে তার বাইরে রয়েছে মিহিজাম । রেলস্টেশন এর প্ল্যাটফর্মটি বাঙলায় থাকলেও , স্টেশনের বাইরের এই মিহিজাম শহরটি কিন্তু বিহার ( বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের ) অন্তর্ভুক্ত । স্টেশনের পাশ থেকেই দুমকা , রাঁচি , দেওঘর প্রভৃতি ঝাড়খণ্ডের বাস ছাড়ে । বাস স্ট্যান্ডের সামনে রিকশা স্ট্যান্ড এবং সেই রিকশা স্ট্যান্ড পার করে হাটতে থাকলে দুপাশে তরি তরকারি বাজার । এরই মধ্যে দিয়ে রাস্তাটি অটো স্ট্যান্ড পার করে হাজির হয় একটি গেটের সামনে । গেটের দুপাশে বাংলা ও বিহারের ( বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের) সীমানা নির্ধারক প্রাচীর পূর্ব পশ্চিম দিক বরাবর দাঁড়িয়ে । এই গেটটি ১ নম্বর গেট নামে পরিচিত । ১ নম্বর গেট পার করেই চিত্তরঞ্জন শহরটির মূল ভূখণ্ড শুরু হয় ।
এই ১ নম্বর গেটের পাশেই ( চিত্তরঞ্জনের দিকে ) কলকাতা , আসানসোল , বর্ধমান , মালদা প্রভৃতি জায়গায় যাওয়ার বাস ছাড়ে । এখান থেকে চিত্তরঞ্জন হলদিয়া ভায়া কলকাতা যাবার এস বি এস টি সি বাস পরিষেবা পাওয়া যায় । এছাড়াও অসংখ্য মিনি ও লোকাল বড় ও এক্সপ্রেস বাসও এখান থেকে পাওয়া যায় ।
চিত্তরঞ্জন শহরটি তৈরি হয় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে । তার আগে অবধি জায়গাটি সাঁওতালদের বাসস্থান ছিল এবং এর পর রেল কোম্পানি এই জায়গাটি কারখানা নির্মাণ করতে এগিয়ে এলে সাঁওতালদের থেকে প্রচন্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয় । অনেক লড়াই এর ইতিহাস লেখা হয়েছিল একটি আধুনিক রেলশহর নির্মাণের পিছনে । এই লড়াইয়ের ইতিহাস আজও লিপিবদ্ধ আছে ডিভি বয়েজ স্কুলের পাশে গণপতি হাটের ভেতরে । অবশেষে ১৯৫০ সালে কারখানায় উৎপাদন শুরু হয় এবং ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এখানে কয়লায় টানা ইঞ্জিন ও ডিজেল ইঞ্জিন তৈরি করা হতো । তবে পরবর্তীতে এই কারখানায় ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন নির্মাণ শুরু হয় ।
চিত্তরঞ্জন শহরটির নাম রাখা হয় দেশবন্ধুর নাম অনুসারে এবং এখানে একটি অডিটোরিয়ামের নাম বাসন্তী দেবীর নামানুসারে করা হয় । অন্যটি নামকরণ করা হয় শ্রীলতার নামানুসারে । বাসন্তীর ঠিক পিছনে শহরের একটি সিনেমাগৃহ রঞ্জন সিনেমা অবস্থিত ।
বর্তমানে রেলের উদ্যোগে রঞ্জন সিনেমাটির আধুনিকীকরণ করা হলেও এই শহরের দ্বিতীয় সিনেমা শ্রীলতা হলটি আর জীবিত নেই । শ্রীলতার ঠিক সামনে রবিন্দ্রমঞ্চ তৈরি করা হয়েছে । এই রবিন্দ্রমঞ্চে শহরের বিভিন্ন জলসা ও অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে । এই হল খুবই সংক্ষিপ্তভাবে চিত্তরঞ্জন শহরটির একটি নকশা , যার কেন্দ্রে রয়েছে রেলইঞ্জিন কারখানা এবং তাকে ঘিরে বিভিন্ন আয়োজন । এছাড়াও শহরটির নানা দর্শনীয় জায়গা আছে যা আগামীতে বলবো । তার সাথে এও বলবো যে রেল এই অঞ্চলটিকে কেন বেছে নিয়েছিল কারখানা নির্মাণের জন্য ।
সত্তরের যে কোয়ার্টার এ আমার জীবনের মূল্যবান সময় কেটেছে আজ সেই পথ ধরে বেড়িয়ে পড়বো একটু আশে পাশের সফরে । মূল বাস রাস্তা বা চ্যানাচুর মোড় থেকে বেশ কয়েকটা মোড় পেড়িয়ে সত্তরের মোড় । এই চ্যানাচুর মোড় থেকে ডানদিকে তাকালে দেখতে পাবেন দেশবন্ধু বয়েজ ও দেশবন্ধু গার্লস স্কুল । দেশবন্ধু বয়েজ এর সামনে অবস্থিত গণপতি হাট , যা চিত্তরঞ্জনের প্রথম এডমিনিষ্ট্র্যাটিভ বিল্ডিং ছিল । বর্তমানে এই ডিভি বয়েজ স্কুলের পাশে যে ফাঁকা জায়গা ছিল সেখানে তৈরি হয়েছে ইন্ডোর স্টেডিয়াম । সারা ভারতের নানা প্রতিযোগিতা এই ইন্ডোর স্টেডিয়ামে হয় আর এটা সত্যিই এক গর্বের বিষয় । গণপতি হাট নিয়ে পড়ে একসময় বলবো , তবে আজ তার পাশ দিয়ে রাস্তা ধরে এগিয়ে যাই আরো খানিকটা । সামনেই একটি মোড় যেখানে বর্তমানে তৈরি হয়েছে চিত্তরঞ্জনের ৫০ বছর পূর্তিতে একটি হাত । এই রাস্তা শীত , গ্রীষ্ম , বর্ষা সমস্ত ঋতুতে কত সাইকেল , স্কুটারের ছাপ বয়ে বেড়িয়েছে তা একজন চিত্তরঞ্জন বাসী খুব ভালোভাবে জানে । তবে চিত্তরঞ্জন কোনদিন এর জন্য কোন অভিযোগ করে নি । বরং গণপতি এভিনিউর এই পথ চিরটাকাল কলকাতার পথ ঘাটকে অনায়াসে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে বারবার । কোন ফাটল নেই , বর্ষার জল জমে না কোনদিন । এই হল আমার শহর । তবে , এই শহরের আর একটি দিক আছে যার সাথে স্মৃতি আকড়ে পড়ে থাকে । সেটা হল ওভাল মাঠ আর তার সংলগ্ন অঞ্চল । পথ চলতে চলতে সেটাও জানাবো একদিন না হয় ।
সত্তর থেকে শুরু করে একটা চক্র শেষ করে ফিরলাম ঠিকই , তবে অনেক পথ ঘুরে আসা এখনো বাকি থেকে গেছে । বাকি থেকে ওভালের লাল মাটি অথবা কুয়াশা ভেজা ঘাসের মধ্যে আড়চোখে দেখে নেওয়া নিজেদের প্রেমিক অথবা প্রেমিকার মুখখানা , দেখে নেওয়া বন্ধুত্বের প্রাপ্তিগুলো , স্যারদের সাথে মেতে ওঠে প্রাপ্ত অপ্রাপ্তবয়স্ক উল্লাসে , জনগণমন র গানে মধ্যে জেগে ওঠা দেশ প্রেম -- এ সবই তো একটা চ্যাপ্টারে বলে দিতে পারবো না । কারন চিত্তরঞ্জন এক চ্যাপ্টারের গল্প নয় । এই শহর কিছু নেই এর মধ্যেও অনেক কিছু আছের কথা । এই শহর স্কুল বাঙ্ক করার মধ্যেও স্কুলে ফিরে আসার শহর , এই শহর একটা মিলন ক্ষেত্র - গ্রাম ও শহরের , আদিবাসী ও শহরের , আদিম ও প্রাচীনের । আগেই বলেছিলাম না , এই শহর একটা গোটা ভারতবর্ষ : বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য । আজ যাত্রা আবার শুরু করবো , ভাগ করে নেবো কিছু অভিজ্ঞতা তবে ওভালের দিকে নয় । আজ ৭১ ও ৭৩ পার করে নেমে যাবো নীচে , সাঁওতাল পরগনার মধ্যে ; যেখানে প্রায় যেতাম আমার ছেলেবেলায় । একবার ঘুরে আসবো সেই শান্তির আশ্রয়স্থল শিব মন্দিরে । তাহলে চলো বেড়িয়ে পড়ি । শুভস্য শিঘ্রম ।
( ক্রমশঃ)
ENGLISH SECTION
Life
- Moutrisha Pyne
We keep reinforcing our barriers;
Making the walls stronger, checking the concrete.
We keep closing the gates every time a whip strikes our hearts'.
We keep checking on the locks, assuring a mere lifeless block.
Happily every after? Or never after!
Or just a nightmare in the sleep?
No one knew.
No one could predict.
We keep fighting our demons, locking them in,
While staging smiles, heartaches and happiness, blending them like play.
A needle pricked iris, decapitated by lies.
Our minds trapped in virtual projection,
of how others think it should function.
Ears receiving self-loathing-
'You're not good enough !'
What is even good enough?
Echoes, cut us deeper in our graves.
We keep polishing our swords,
building our armor,
As we keep digging through the stones,
untill we hit rock bottom!
Manifesting courage in a decayed society.
Our silver leathered gloves, ready to take the stain of our sins.
Ready to walk over any weaker soul. Well ! Weaker than us.
Life.
As it is truthfull like holding a wrinkled hand,
Along with its fingers hanging like stubs of cigarettes,
is feeble.
That life is this heart- language
Dr.Mahitosh Gayen
What do you need
Going to a different life!
That was pretty good, tireless walking,
Backpacks,college hoaxes,
hidden noon-pictures,
Eating cigarettes and puffs,on the way back
Looking for Trinayani Bhramar here and there.
What do you need
Going to another life!
In other life there is sorrow,
there is suffering, there is happiness,
There is responsibility, there is politics and there is society,change of daysThere is violence,there is love, there is love, there is deception, there is murder, there is suffering.
That life was good,there was peace, there was happiness,There was a touch of sunny in the evening coaching class, with open hair on the back,the smell of woodpeckers.
The language of the eyes,
in the land of poetry and sleep,
At the end of the night,
looking for heart-palash, bakulmala ...
That's pretty good,generous heart-language.
FOR HER
~ PARAMARTHA BANERJEE
When you will be back tonight,
You will be tired.
You have worked hard,
And haven’t think of her,
That’s the story,
Going for a while.
She has even worked harder,
But expecting every night
When opens the door for you,
That you will say something special.
What you have forgotten
And taking her for granted.
Keep aside the flaw,
Buy a rose for her,
And when she would open the door tonight,
Go for the magic.
Hug her tightly,
Kiss her eyes quietly with your eyes,
Touch her lips gently with your rose,
She will reply,
Keep (treasure it) that close at your heart.
The light will lit, would burn the fatigue in relationship, you have embraced.
You have just met the most beautiful lady in the world.
Love is raining now to bridge the gap.
You’re cooling at her lap.
The dream is back,
You’re not worrying, not afraid of anything.
Celebrate life,
Laughing and playing.
অপরাজিতা অনলাইন ব্লকজিন খুব ভালো লাগলো। অনেক লেখা হাতের কাছে পেলাম। সংখ্যাটিও মার্জিত রুচিপূর্ণ। আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
ReplyDeleteঅপরাজিতা অনলাইন ব্লকজিন খুব ভালো লাগলো। অনেক লেখা হাতের কাছে পেলাম। সংখ্যাটিও মার্জিত রুচিপূর্ণ। আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
ReplyDelete