সম্পাদকীয় ৫
কখনও কত সরল সৌন্দর্য অনায়াস শিল্প হয়ে ওঠে। অনায়াস কত ঢেকে যায় কুয়াশায়।
কুয়াশা ছিঁড়ে আমি বুঝি ছুটে ছুটে আসছি, বারবার, খড়খড়ি তুলে দেখছি জানলার বাইরে ঝমঝমে বৃষ্টি আর হাওয়ার তুমুল সাঁতার।চোখের তারায় থমকে অপার বিস্ময়ের পৃথিবী । কয়েক ফালি স্বপ্নের উপকরণ দমকে দমকে ভিজিয়ে যাচ্ছে তার গূঢ়-গোপন-তত্ত্ব দিয়ে। আমার অন্তস্থলের গোপনকক্ষে অবাধ প্রবেশ তার, যেখানে সব দেখা - সব ভাবনারাই কখন প্রজাপতি হয়ে যায়।
বৃষ্টিতে আলো নিভে গেছে অনেকক্ষণ, দেওয়ালে লম্বা দুটো বিশালকায় ছায়া ক্রমশ লম্বা , আমি মায়ের আঙুল ধরে আছি । সেই আজও।
ছায়াটা আজ হাত ছাড়িয়েছে , অপেক্ষারা চরিত্র বদলে দৃষ্টি ভিজিয়ে রূপ নিয়েছে বর্ষাৠতুর-- ঝাপসা করে দেওয়া দিকবিদিগ, লুপ্ত চাঁদ, আকাশ ধোয়া প্রাণ।
পাতা ওল্টাতেই বর্ষা নেমে এল।
মেঘেদের ভীর শরীর জুড়ে, স্বপ্নেরা কাগুজে পাতায়, আঙুলের চারপাশে।
ৠতুচক্রের ব্যাকরণে চিরায়ত ধারায় আষাঢ় বর্ষার প্রারম্ভ কাল। কিন্তু দীর্ঘ সময় মানবকুলের সঙ্গী হওয়ার সৌজন্যে দেখেছি ঋতুদের মধ্যেও অবাধ্যতার সংক্রমণ হয়েছে বেশ খানিক।
আষাঢ় আসে। একাই। বর্ষা আসে না। আবহাওয়া-বিদদের কথার মান রেখে সে বঙ্গের মোড়ে তো এসে দাঁড়ায়, বাকী পথটুকু তার গড়িমসি করে চলে-- আর শহর-পথঘাট-নদীনালা-গাছগাছালি আমারই মতো হাপিত্যেশ করে বসে থাকে।
মাঝে মধ্যে মনে হয় অমন ঠাট্টা বুঝি বর্ষাবেগমেরই সাজে, কেই-ই বা অমন করে নিমজ্জিত সম্পর্কের বন্ধনে আপামর প্রকৃতি ও শ্রী জীবকুলকে সম-মান দেয় ?
নাগরদোলায় দোল খেতে খেতে আষাঢ় যখন মেঘলা মেখলায় সুর ঝরায় , জগন্নাথদেব তখন রথে চেপে বাৎসরিক দেশ ভ্রমণে বের হন।
আশ্চর্য এক সম-সামাজিক বিশ্বাস' 'রথ'।
রথের সঙ্গে প্রথম পরিচয় বাড়ীতেই ঘটেছিল আমার। কাঠের খেলনাগাড়ী। যার মাথার ওপর এক তিনকোণা কাপড়ের টুকরো একটি ছোট্ট কাটির গায়ে লাগানো-- পতাকা। মনে পড়ে বাবা নিজে হাতে তৈরী করে দিয়েছিল রথ। বিস্ময়ের অন্ত ছিল না সেদিন । অবাক হয়ে দেখতাম ঐ রথ তৈরী। একটু একটু করে কখন ঐ দারুশিল্প, মহাপ্রভু জগন্নাথ দেবের ব্যাক্তিগত যান হয়ে উঠেছিল ।
এ ধরাতলে এক মহাকারুকার রূপকার হয়ে পরম যত্নে কখন রচে ছিলেন সে মহাযান
আর তাই চেপে বুঝি জগতের নাথ দেবালয় ছেড়ে জগৎবাসীর দুঃখ-দুর্দশা পরিদর্শনে বেরিয়ে পড়লেন । এ যেন নয় ভ্রমণ, বিশ্বের সমগ্র আর্ত অন্তঃকরণ কে এক সুতোয় গ্রথিত করার নির্মল প্রয়াস।
পরম প্রভুর সে খেলনা গাড়ী টি উদগ্রীব হয়ে আষাঢ়ের অপেক্ষা করত, না-- কি আমি' বর্ষার ধুম্র মেঘরাজের সাঁজোয়া বাহিনীর প্যারেড দেখব বলে অমোঘ দৃষ্টিকে অস্থির করে তুলতাম, সে যেন আজও ধুয়ো কথা।
জ্যৈষ্ঠের দাহে পুড়তে পুড়তে নেহাতই আমার অকিঞ্চন দুটি চোখের দিঘী , আষাঢ় না শ্রাবণের ছবি আঁকত তাও সঠিক বলতে পারব না আজ -- মোটের ওপর এটাই , বৃষ্টি ঝড়া মাটির সোঁদা গন্ধ আর মেঘাড়ম্বরে উপচে পড়া জলকণার নিনাদ-- দৃষ্টি ছড়াত এই দুই সমন্বিত প্রকৃতির ভরপুর লাবণ্যে।
আজও কি কচি কচি নরম লাউয়ের ডগার মতো কচি-কাচাদের সমুদয় হাত মহা সম্ভ্রমে কাঁসর বাজিয়ে রথের রশি' তে টান দিয়ে পাড়া জাগায়?
আর সেই তখন : পাড়ার যাতায়াতি মানুষেরা রথে ঝেঁকে বিশ্বনাথ দর্শন করে কেউ কেউ খুচরো পয়সা প্রণামীও রাখতেন। সে দাক্ষিন্যটুকুও যে আজ স্মৃতি সংরক্ষণ। সেও যেন আর-এক বিস্ময়মুদ্রা।
কেমন করে একটি কাঠের চলমান আসন মানুষের ভক্তি-নিষ্ঠা-বিশ্বাস-সরলতা, চার অন্তঃকরণের নির্যাসে পূজিত হয়ে আসছে যুগ-যুগ ধরে ।আর রশিতে টান দিয়ে অন্দরে অন্তরে উপবিষ্ট মহাপ্রভুর আশীর্বাদী প্রসাদ কুড়োচ্ছে আপামর।
আমি কোনো কলম কুড়িয়ে পাই নি , আমার সব দে'খা, ভাবনা ভালবাসার লেপ পেয়ে কবিতা হয়ে যায় । অন্ধকারে, আমাকে ভোলাতে মা কবিতা শোনাতে আসে না আর , মা ছেড়ে গেছে যেখানে সেখান থেকেই আমার শুরু। আজও খড়খড়ির ভেতর থেকে বর্ষা ঐ চেনা ভঙ্গিমায় ধরা দেয় কবিতার মতো।
যা দেখেছি তাই'ই লিখেছি, আর যা লেখা হয় নি তা বুঝি এক অস্বচ্ছ ছায়া আক্ষেপ নিয়ে কুয়াশা ঢেকে দাঁড়িয়ে। হয়ত আমার পরে কেও আসবে সে আবরণ কেটে বিমূর্তকে মূর্ত করবে ।আক্ষেপ এটা নয় আমার লেখা অপূর্ণ রয়ে গেল, বরং দীর্ঘশ্বাস এই ভেবে, আমার এ ক্ষণিক জন্মে আর সবার মতো নিত্য নতুন দেখা (আবিষ্কার) অধরাই রয়ে যায়।
নব আনন্দে জাগো তুমি ..... (হে বিশ্ব)
:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
মৌসুমী মুখোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment