গল্প গাছ ৩
দেখা
সুনন্দ মন্ডল
সুনন্দ মন্ডল
আকাশটা তিনদিন ধরে থমথমে হয়ে আছে। মাঝে মাঝে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। তবে খুব জোরে বৃষ্টির দেখা এখনও নেই। আষাঢ় মাস। বর্ষা এল রাজ্যে-- সেখবর টিভিতে শুনেছে যতীন।লকডাউনের পরিবেশে কোনো কিছুই স্বাভাবিক নয় যদিও, যতীন ঘরে বসেই গ্র্যাজুয়েট হবার স্বপ্ন দেখছে। পড়াশোনায় তীক্ষ্ণ মাথা তার। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তার বি.এ পাস করাটা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। লাস্ট ইয়ার, লাস্ট সেমিস্টার, ভয়ের সঞ্চার হয়েছে মনে। সরকার যদিও বলেছে, অনলাইন পরীক্ষার ব্যবস্থা করবে। পড়াশোনার ভবিষ্যৎ আর থাকল না। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল কয়েকদিন পরেই রথযাত্রা।
রথের মেলা সেরকম আর হবে না। এখন যা পরিস্থিতি তাতে প্রশাসন মেলা হতে দেবে না। দূরত্ব বজায় রেখে মেলা হতেও পারে না। তাই এবারে ভক্তহীন জগন্নাথ দেবের যাত্রা। গ্রামের এই অনুষ্ঠান বেশ ভালোই হয় প্রতিবছর। সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো কিন্তু তার পরেই এই রথের জন্য প্রাণে হিল্লোল জাগে। ভিড়ের মধ্যে সকল ধর্মের ও বর্ণের মানুষের আত্মিক মেলবন্ধন ঘটে। কিন্তু এবারে সেই উচ্ছ্বাস কারও নেই।
কলেজ হোস্টেল থেকে বাড়ি আসত গ্রামের জগন্নাথ দেখবে বলে। সে কী আগ্রহ! কিন্তু এবছর সেই তিনমাস হতে চলল ঘরেই আছে যতীন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাও নেই তেমন। দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে সবার সাথেই যেন একটা গভীর দূরত্ব হয়ে গেছে। মহুয়ার সঙ্গে তো কবেই বন্ধন ছিঁড়ে গেছে। হ্যাঁ, ভালোবাসার বন্ধন। কলেজের প্রথম বর্ষে প্রেমে পড়ে যতীন। সহপাঠী মহুয়া দুবছর যতীনের প্রেমে ডুবে ছিল। আজ কে যতীন? চেনেই না। আধুনিকা হতে চেয়ে স্মার্ট ছেলের হাত ধরেছে কিনা জানা নেই যতীনের। কিন্তু যতীন কোনোদিনই স্মার্ট ছিল না। তাই সঙ্গ ত্যাগ করল মহুয়া। যতীনের প্রথম ভালোবাসা, হয়তো মহুয়ারও। যতীন ভুলতে পারেনি এখনও। কিন্তু মহুয়া কী করে ভুলে গেল, সেটাও যতীন জানে না। এসব কথা নিজের সঙ্গে বলতে বলতে খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল যতীন। হঠাৎ চোখটা বন্ধ হয়ে এসেছে, এমন সময় ছোটবেলার বন্ধু নিমাই দেখা করতে এল। সে বাড়ি থেকেই কলেজ করে পাশের শহরে। সেও ভালো ছাত্র। দুজনের বন্ধুত্ব গাছের শিকড় আর মাটির মতো।
--"আয়, আয় নিমাই। বোস, খাটেই উঠে বোস।"
--"কেমন আছিস, বাইরে যাচ্ছিস না! আমিও বাইরে আসি নি। তবে মনটা আজ কেমন হয়ে গেল, তাই তোর বাড়ি এলাম। তোর কাছে। একটু গল্প করে সময়টা কাটাব।" খাটে বসেই এসব বলল নিমাই।
দুজনের গল্প চলতেই থাকে। দুপুর গড়িয়ে যায়। নাওয়া-খাওয়ার সময় হয়। নিমাই বাড়ি চলে গেলে যতীন স্নান সেরে ভাত খেয়ে একটা সুখের ঘুম দিল।
বিকেলে একটু গ্রামের এদিক ওদিক ঘুরতে গেল যতীন। অনেকেরই সাথে দেখা হল। মন না চাইলেও কেন জানি না মহুয়ার বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল। চোখ খুঁজছিল মহুয়াকে। কিন্তু দেখা পেল না। কাউকে জিজ্ঞেসও করল না তার কথা। হঠাৎই পিছন ঘুরতেই মহুয়ার বাবার সাথে দেখা। তিনি যতীনকে বাড়ির ভেতরে যেতে বললে, পরে আসবে বলে চলে যায় সে।
রথের মেলা সেরকম আর হবে না। এখন যা পরিস্থিতি তাতে প্রশাসন মেলা হতে দেবে না। দূরত্ব বজায় রেখে মেলা হতেও পারে না। তাই এবারে ভক্তহীন জগন্নাথ দেবের যাত্রা। গ্রামের এই অনুষ্ঠান বেশ ভালোই হয় প্রতিবছর। সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো কিন্তু তার পরেই এই রথের জন্য প্রাণে হিল্লোল জাগে। ভিড়ের মধ্যে সকল ধর্মের ও বর্ণের মানুষের আত্মিক মেলবন্ধন ঘটে। কিন্তু এবারে সেই উচ্ছ্বাস কারও নেই।
কলেজ হোস্টেল থেকে বাড়ি আসত গ্রামের জগন্নাথ দেখবে বলে। সে কী আগ্রহ! কিন্তু এবছর সেই তিনমাস হতে চলল ঘরেই আছে যতীন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাও নেই তেমন। দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে সবার সাথেই যেন একটা গভীর দূরত্ব হয়ে গেছে। মহুয়ার সঙ্গে তো কবেই বন্ধন ছিঁড়ে গেছে। হ্যাঁ, ভালোবাসার বন্ধন। কলেজের প্রথম বর্ষে প্রেমে পড়ে যতীন। সহপাঠী মহুয়া দুবছর যতীনের প্রেমে ডুবে ছিল। আজ কে যতীন? চেনেই না। আধুনিকা হতে চেয়ে স্মার্ট ছেলের হাত ধরেছে কিনা জানা নেই যতীনের। কিন্তু যতীন কোনোদিনই স্মার্ট ছিল না। তাই সঙ্গ ত্যাগ করল মহুয়া। যতীনের প্রথম ভালোবাসা, হয়তো মহুয়ারও। যতীন ভুলতে পারেনি এখনও। কিন্তু মহুয়া কী করে ভুলে গেল, সেটাও যতীন জানে না। এসব কথা নিজের সঙ্গে বলতে বলতে খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল যতীন। হঠাৎ চোখটা বন্ধ হয়ে এসেছে, এমন সময় ছোটবেলার বন্ধু নিমাই দেখা করতে এল। সে বাড়ি থেকেই কলেজ করে পাশের শহরে। সেও ভালো ছাত্র। দুজনের বন্ধুত্ব গাছের শিকড় আর মাটির মতো।
--"আয়, আয় নিমাই। বোস, খাটেই উঠে বোস।"
--"কেমন আছিস, বাইরে যাচ্ছিস না! আমিও বাইরে আসি নি। তবে মনটা আজ কেমন হয়ে গেল, তাই তোর বাড়ি এলাম। তোর কাছে। একটু গল্প করে সময়টা কাটাব।" খাটে বসেই এসব বলল নিমাই।
দুজনের গল্প চলতেই থাকে। দুপুর গড়িয়ে যায়। নাওয়া-খাওয়ার সময় হয়। নিমাই বাড়ি চলে গেলে যতীন স্নান সেরে ভাত খেয়ে একটা সুখের ঘুম দিল।
বিকেলে একটু গ্রামের এদিক ওদিক ঘুরতে গেল যতীন। অনেকেরই সাথে দেখা হল। মন না চাইলেও কেন জানি না মহুয়ার বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল। চোখ খুঁজছিল মহুয়াকে। কিন্তু দেখা পেল না। কাউকে জিজ্ঞেসও করল না তার কথা। হঠাৎই পিছন ঘুরতেই মহুয়ার বাবার সাথে দেখা। তিনি যতীনকে বাড়ির ভেতরে যেতে বললে, পরে আসবে বলে চলে যায় সে।
আজ রথযাত্রা। মঙ্গলবার। সবকিছু মঙ্গল যেন হয়, এই আশীর্বাদই চেয়ে নেবে যতীন। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে জগন্নাথ দেবের চরণে নিজেকে সঁপে দেবে। মেলা না হলেও বিকেলে একবার রথ দেখতে যাবে ওপাড়া। গ্রামের উৎসব বলে কথা। না গেলে কেমন যেন বেমানান লাগে। বন্ধু নিমাইকে ডেকে একসাথে যাবে। আর কাউকেই সঙ্গে নেবে না। দূরত্ব বজায় রাখতে নিমাই-ই যথেষ্ট।
বিকেল হতেই সারা আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এল। মেঘের দেখা মিলতেই বৃষ্টিও শুরু হল চরম। ঘনঘন বাজের আওয়াজ আর বিদ্যুতের ঝলকানিতে যতীনের মনের আশা ধুয়ে দিচ্ছে যেন। বাড়ি থেকেই বেরোনো যাবে না। ছাতাও টিকবে না। ফাঁপি শুরু হয়েছে। মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল যতীনের।
--"অবশ্য ভালোই হয়েছে, বৃষ্টি কমলেও লোকের ভিড় তেমন হবে না। নিমাই আর আমি সময় বুঝে বেরিয়ে যাব।" একটু হতাশ হয়েই বলল যতীন।
বৃষ্টি থামল। বিকেল সাড়ে পাঁচটা। যতীনের বাড়ি পেরিয়ে যেতে হবে রথ দেখতে। তাই নিমাই চলে এসেছে যতীনের বাড়ি। দুজনে মিলে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে গেল, আবার বৃষ্টি হতে পারে ভেবে। তখনও আকাশ তেমন পরিষ্কার হয়নি। শুধু বৃষ্টি ছেড়েছে।
রাস্তায় বেরোতেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল আবার। ছাতাটা মাথায় ধরতেই হল। পাকা রাস্তা তবুও পিছল। ট্রাক্টরের চাকায় লেগে থাকা কাদা ঝরে ঝরে পড়েছে, তাতেই এই অবস্থা। যাইহোক, গ্রামের বাইরে যে ফাঁকা জায়গায় রথের উৎসব পালিত হয়, সেখানে উপস্থিত হল যতীনেরা। রথযাত্রা শুরু হয়েছে অনেক আগেই। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শ্রীখোল, করতালে নামগান করতে করতে কয়েকজন ভক্ত এগিয়ে চলেছে। যারা ইতিমধ্যে পৌঁছেছে তারা সকলেই রথের কাছে আসছে। দড়িতে হাত লাগাচ্ছে। আর জগন্নাথ দেবকে প্রণাম জানিয়ে আশীর্বাদ চাইছে। আর বলছে, "জয় জগন্নাথের জয়।"
--"কই রে, থেমে গেলি যে! চল, এগিয়ে যায়। রথ অনেকদূর চলে যাচ্ছে। অনেকটা হাঁটতে হবে তখন।" যতীনকে ধাক্কা দিয়ে বলল নিমাই।
--"হ্যাঁ, হ্যাঁ। চল। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম।" মুখে একটু হাসি নিয়ে বলল যতীন।
আজ আর তেমন হাসি নেই যতীনের। গত দুবছর মহুয়ার সাথে হাত ধরে রথের মেলায় ঘুরেছে। দুজনে মিলে কত আনন্দ, কত মজা করেছে। আজ সেই আনন্দও নেই। শুধুই স্মৃতি আঁকড়ে বিষণ্নতা। অনেকটা এগিয়ে গিয়ে পিছনে ঘুরে তাকাতেই নিমাই দেখল যতীন আবার থেমে গেছে।
"কী রে, যতীন? বারবার থেমে যাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে তোর?"--নিমাই জানতে চাইলে, যতীন ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের পরেরটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। নিমাইও দেখে চমকে ওঠে।
নিমাই যদি চমকে ওঠে তাহলে যতীনের কী অবস্থা হয়? হ্যাঁ, যতীন তার প্রাক্তন প্রেমিকা মহুয়াকে দেখেই থেমে গেছে। নিমাই অন্যদিকে চলে যেতে বললে, যতীন থেমেই থাকে। চেয়ে দেখে মহুয়ার হাত ধরে এগিয়ে আসছে ওপাড়ারই মলয়। বাপের বখাটে ছেলে মদ গাঁজা যার সঙ্গী। তারই সাথে মহুয়া! চমকে ওঠাই স্বাভাবিক।
মহুয়া মলয়ের সাথে হাসতে হাসতে যতীনকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। কে বা কারা তাদের দিকে চেয়ে আছে, তা জানার চেষ্টাও করল না মহুয়া। মহুয়ার এই আচরণ যতীন সহ্য করতে পারে না। মনের কষ্ট দ্বিগুন, ত্রিগুন, চতুর্গুন বেড়ে গেল। নিমাই মানিয়ে নিতে বললে যতীন রাগে ছাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। নিমাই সেটা কুড়িয়ে আনতে গেল। কিন্তু যতীনের দূরে যাওয়া প্রেমিকা আজ যেন আবার নতুন করে কাছে এসেও ধরা দিল না। সেকথা মনে মনে ভেবে আহত হল। আবার মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। কাকভেজার মতোই ভিজতে লাগল যতীন। ততক্ষনে মহুয়া আর মলয় দূরে মিলিয়ে গেলেও, কিছুক্ষন আগে দেখা মহুয়ার হাসিটা যতীনকে দগ্ধ করতে থাকল।
বিকেল হতেই সারা আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এল। মেঘের দেখা মিলতেই বৃষ্টিও শুরু হল চরম। ঘনঘন বাজের আওয়াজ আর বিদ্যুতের ঝলকানিতে যতীনের মনের আশা ধুয়ে দিচ্ছে যেন। বাড়ি থেকেই বেরোনো যাবে না। ছাতাও টিকবে না। ফাঁপি শুরু হয়েছে। মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল যতীনের।
--"অবশ্য ভালোই হয়েছে, বৃষ্টি কমলেও লোকের ভিড় তেমন হবে না। নিমাই আর আমি সময় বুঝে বেরিয়ে যাব।" একটু হতাশ হয়েই বলল যতীন।
বৃষ্টি থামল। বিকেল সাড়ে পাঁচটা। যতীনের বাড়ি পেরিয়ে যেতে হবে রথ দেখতে। তাই নিমাই চলে এসেছে যতীনের বাড়ি। দুজনে মিলে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে গেল, আবার বৃষ্টি হতে পারে ভেবে। তখনও আকাশ তেমন পরিষ্কার হয়নি। শুধু বৃষ্টি ছেড়েছে।
রাস্তায় বেরোতেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল আবার। ছাতাটা মাথায় ধরতেই হল। পাকা রাস্তা তবুও পিছল। ট্রাক্টরের চাকায় লেগে থাকা কাদা ঝরে ঝরে পড়েছে, তাতেই এই অবস্থা। যাইহোক, গ্রামের বাইরে যে ফাঁকা জায়গায় রথের উৎসব পালিত হয়, সেখানে উপস্থিত হল যতীনেরা। রথযাত্রা শুরু হয়েছে অনেক আগেই। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শ্রীখোল, করতালে নামগান করতে করতে কয়েকজন ভক্ত এগিয়ে চলেছে। যারা ইতিমধ্যে পৌঁছেছে তারা সকলেই রথের কাছে আসছে। দড়িতে হাত লাগাচ্ছে। আর জগন্নাথ দেবকে প্রণাম জানিয়ে আশীর্বাদ চাইছে। আর বলছে, "জয় জগন্নাথের জয়।"
--"কই রে, থেমে গেলি যে! চল, এগিয়ে যায়। রথ অনেকদূর চলে যাচ্ছে। অনেকটা হাঁটতে হবে তখন।" যতীনকে ধাক্কা দিয়ে বলল নিমাই।
--"হ্যাঁ, হ্যাঁ। চল। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম।" মুখে একটু হাসি নিয়ে বলল যতীন।
আজ আর তেমন হাসি নেই যতীনের। গত দুবছর মহুয়ার সাথে হাত ধরে রথের মেলায় ঘুরেছে। দুজনে মিলে কত আনন্দ, কত মজা করেছে। আজ সেই আনন্দও নেই। শুধুই স্মৃতি আঁকড়ে বিষণ্নতা। অনেকটা এগিয়ে গিয়ে পিছনে ঘুরে তাকাতেই নিমাই দেখল যতীন আবার থেমে গেছে।
"কী রে, যতীন? বারবার থেমে যাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে তোর?"--নিমাই জানতে চাইলে, যতীন ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের পরেরটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। নিমাইও দেখে চমকে ওঠে।
নিমাই যদি চমকে ওঠে তাহলে যতীনের কী অবস্থা হয়? হ্যাঁ, যতীন তার প্রাক্তন প্রেমিকা মহুয়াকে দেখেই থেমে গেছে। নিমাই অন্যদিকে চলে যেতে বললে, যতীন থেমেই থাকে। চেয়ে দেখে মহুয়ার হাত ধরে এগিয়ে আসছে ওপাড়ারই মলয়। বাপের বখাটে ছেলে মদ গাঁজা যার সঙ্গী। তারই সাথে মহুয়া! চমকে ওঠাই স্বাভাবিক।
মহুয়া মলয়ের সাথে হাসতে হাসতে যতীনকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। কে বা কারা তাদের দিকে চেয়ে আছে, তা জানার চেষ্টাও করল না মহুয়া। মহুয়ার এই আচরণ যতীন সহ্য করতে পারে না। মনের কষ্ট দ্বিগুন, ত্রিগুন, চতুর্গুন বেড়ে গেল। নিমাই মানিয়ে নিতে বললে যতীন রাগে ছাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। নিমাই সেটা কুড়িয়ে আনতে গেল। কিন্তু যতীনের দূরে যাওয়া প্রেমিকা আজ যেন আবার নতুন করে কাছে এসেও ধরা দিল না। সেকথা মনে মনে ভেবে আহত হল। আবার মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। কাকভেজার মতোই ভিজতে লাগল যতীন। ততক্ষনে মহুয়া আর মলয় দূরে মিলিয়ে গেলেও, কিছুক্ষন আগে দেখা মহুয়ার হাসিটা যতীনকে দগ্ধ করতে থাকল।
নবজন্ম
মালবিকা গায়েন
- হাই লবণ! কেমন আছো? চিনতে পারছো?
নেট অন করতেই ম্যাসেঞ্জারে আননোন প্রোফাইল থেকে টুক করে একটা মেসেজ ঢুকল। সাধারণত লাবণ্য অপরিচিত কারো মেসেজে'র রিপ্লাই দেয় না এমনকি এত রাতে দেখেও না। কিন্তু "লবণ" নামটা দেখে একটু কৌতূহলী হয়েই মেসেজ টা খুলল। প্রোফাইলে একটা পাহাড়ি ঝর্নার ছবি। নামটা ডঃ অমিত মুখোপাধ্যায়। সারাদিন সংসার বাচ্ছা সামলে এই রাত বারোটা নাগাদ একটু সময় পায় নিজের জন্য । এইসময় একটু সোশাল মিডিয়ায় মেয়ের স্কুলের বন্ধুদের মায়েদের সাথে একটু আড্ডা দিয়ে তারপর ঘুমাতে যায়। বিয়ের পর থেকে রোবটের মত চলা জীবনটায় বছর খানেক হল একটু বদল ঘটেছে এই স্মার্ট ফোনটার দৌলতে। প্রোফাইলে ক্লিক করে দেখে ডঃ অমিত মুখোপাধ্যায়, লাইভস ইন বোস্টন , ফ্রম কলকাতা, সি ডঃ অমিত মুখোপাধ্যায়'স অ্যাবাউট ইনফো ক্লিক করতেই .......
- এই তুমি জেগে আছ? কিছু রিপ্লাই দিচ্ছ না কেন? এই কুহু কিছু বল?
একি লবণ, কুহু এই নামগুলো ওকে বিশেষ কেউ ডাকতো, এতবছর পর তবে কি প্রতীক্ষার অবসান!!
আবার সি ইনফোয় মন দেয়। স্কুল স্কটিশ চার্চ, কলেজ কলকাতা ইউনিভার্সিটি, ম্যারিটাল স্ট্যাটাস ইটস্ কমপ্লিকেটেড ।
- কুহু আগামী কাল তো রবীন্দ্রজয়ন্তী । তুমি এখনো কিছু অনুষ্ঠান কর? তোমার মেয়ে একদম তোমার মত মিষ্টি দেখতে হয়েছে।
বুকের বাঁদিক টা কেমন দুরুদুরু করছে। ফটো তে ক্লিক করে কতগুলো মেডিকেল জার্নাল। বেশ কটা পাহাড় নদীর ছবি।
- তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না ।অমিট্রে কে মনে আছে? এই ছবিটা দেখো কাল রাতের চাঁদ । আজ তো ফুলমুন। তোমার কিছু মনে পড়ছে?
লাবণ্য শোয়া অবস্থায় জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে রুপোর থালার মত চাঁদ উঠেছে ।
সেবার পাড়ার রবীন্দ্র জয়ন্তীতে লাবণ্য নৃত্য পরিবেশন করেছিল "ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে .......কুহু কুহু " তারপর থেকেই পাশের পাড়ার কয়েকজন ছেলের মধ্যে কেউ একজন ওকে দেখলেই কুহু কুহু করে ফাঁকা আওয়াজ দিত। ক্লাস নাইনে ও নীলাদ্রি স্যারের কোচিং জয়েন করে সেখানে দ্বিতীয় দিনেই একই নামে ফাঁকা আওয়াজ পায় ।
- এই লবণ কিছু মনে পড়ল? "দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কি জানি কি মহা লগনে " ।
ওর মনে পড়ল স্যারের কোচিং থেকে বেরিয়ে প্রথম অমিতের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল লেকের ধারে। দুজনেই পরীক্ষার চাপে ছিল একজন মাধ্যমিক আরেকজন উচ্চমাধ্যমিকে বসবে। সেই দিনও পূর্ণিমা ছিল। ওরা লেকের ধারে একটা বড় অমলতাস'র নীচের বেঞ্চে মিনিট পনের বসেছিল ।
- আমি অমিত মুখার্জি । রাইয়ের মুখে শুনলাম তুমি লাবণ্য রায়। বেথুনে পড়। ক্লাসে দশের মধ্যে থাক। তোমার শখ নৃত্য, রবীন্দ্র সংগীত ভালো গাও। বিশ্বাস কর তোমার নাচ দেখার পর থেকেই শয়নে স্বপনে শুধু তোমায় অনুভব করি লবণ। লবণ নামটা শুনেই ভ্রূযুগল কুঁচকে ওর দিকে তাকানো মাত্র অমিত হেসে বলেছিল
- তোমা ছাড়া এ জগতে মোর আর কেহ নাই কিছু নাই গো। লবণ তুমি আমার জীবনের স্বাদ বদলে দিয়েছো। তরকারিতে লবণ ছাড়া যেমন স্বাদ পাওয়া যায় না তেমনি তুমি ছাড়া আমার জীবন বেরঙীন। এতদিন লেখাপড়া নিয়ে ছেলেখেলা করেছি, তোমায় দেখার পর জয়েন্টে বসার তাগিদ অনুভব করলাম । তোমায় সুখী করতে হবে তো।
অমলতাসের ফাঁক দিয়ে জোছনা এসে ওদেরকে ভিজিয়েছিল সেদিন। টলটলে লেকের জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব কি মোহময় লাগছিল । লাবণ্য যেন এইক্ষণ টার জন্যই কত জন্মজন্মান্তর অপেক্ষায় আছে। একে অপরের চোখে ডুব দিয়ে না জানি কোন সমুদ্র তল খুঁজছিল।
- অমিট্রে প্রায় মিনিট পনের হয়ে গেছে । দুজনের সম্বিৎ ফিরে আসে।
- অমিট্রে কে? রিণ্ রিণ্ গলায় এই প্রথম কথা বলল।
- অমিত মুখার্জি'র অমিত আর লাবণ্য রায়ের রায় মিলে ওরা আমাদের জুটিকে অমিট্রে বলে।
- আমি যদি দীঘির জল না হতে পারি কুঁজোর জল হই!
- আমি তোমার দিঘীতেই আজীবন সাঁতার কাটব লবণ।.........
আবার একটা মেসেজ
- লবণ কিছু তো বলো? শুধু মেসেজ পড়েই যাবে! কিছুই বলবে না? কাল এখানে ইন্ডিয়ান ডক্টরস এসোসিয়েশন থেকে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন হবে। আমি শেষের কবিতা আবৃত্তি করব। প্রতিবছর করি আর তোমার মুখটা মনে পড়ে ।
লাবণ্যের মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল । ও ভাবনার সাগরে ডুব দিল। অমিত জয়েন্টে চান্স পেয়ে ডাক্তারি পড়ায় মন দিল। কার্ডিয়াক সার্জন হওয়ার জন্য বিদেশে চলে গেল। লাবণ্য বাংলায় অনার্স গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর মাসটার্স করতে চেয়েছিল যাতে অমিত কে ফিরে আসার সময় দেওয়া যায় । কিন্তু ঠিক এইসময়ে ধীমান সেনগুপ্তর সাথে বিয়ের প্রস্তাব এল বাবা এই সম্বন্ধ কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চাইলেন না। তখন তো আর এখনকার মত নিমেষেই যোগাযোগ করা যেত না। ওরা দুজনেই কেউ তেমনভাবে বাড়ির কাউকে ওদের ভালোবাসার সম্পর্কটা নিয়ে কথা বলতে পারেনি। লাবণ্য তাও ওর পিসতুতো বোন রাইয়ের মারফত খবর দিতে চেয়েছিল কিন্তু কেউই সাহস জোটাতে পারেনি। শুধু অমিত একটা চিঠি পেয়েছিল তাতে লেখছিল "ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখ তোমার মনের মন্দিরে "। বিয়ের পর লাবণ্য বুঝতে পারে তার এই বাড়িতে কখনো কোনো কিছুর অভাব হবেনা । যথেষ্ট বিত্তশালী তার শশুড়বাড়ি । যেটার অভাব তা হল রুচি সংস্কৃতির। লাবণ্য ছোট ছোট ভাল লাগায় খুশি হয়- যেমন পূর্ণিমার চাঁদ দেখা, বৃষ্টিতে ভেজা, একটু সাহিত্য পড়া, বইমেলায় যাওয়া, একটু গান নাচ যা এই বাড়িতে নিষিদ্ধ । কয়েকবার স্বামীর সাথে এই নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিল , ধীমান শুনতে চায়নি উল্টে বলেছিল সংসারে মন দাও। তুমি এখন বাড়ির বউ, সেনগুপ্ত পরিবারের সন্মান। তুমি সকালে উঠে সুর ভাজবে। তা তা থৈ থৈ নাচবে!
- লবণ এখন রাখলাম হসপিটালে পৌঁছে গেছি। তোমাকে আবৃত্তি'র ভিডিও আপলোড করে পাঠাবো। আমি আর আগের মত তালপাতার সেপাই নই। ডবল এক্সেল শার্ট লাগে। তুমি কিন্তু একই রকম আছ ছিপছিপে তন্বী । শুধু কপালে দুটো বলিরেখার ঝলক তোমাকে আর ব্যক্তিত্বময়ী লাগছে । তোমার প্রোগরামের ভিডিও দিও।
লাবণ্য অমিতকে ফিরে পেয়ে এই মুহূর্তে কেমন মনের একটা জোড় পাচ্ছে । ওর শশুড়বাড়ির লোকদের সাথে এমনকি স্বামীর সাথেও যতটা মানসিক দূরত্ব বাড়ছিল ও ততই অমিতের স্মৃতিকে পুঁজি করে নিজের মনের ভালবাসা কে লালিত করছিল। আর তিন্নি কে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছিল । এই মুহূর্তে ওর মনে পড়ছে পাওলো কোয়েলহোর কথা "হোয়েন ইউ ওয়ান্ট সামথিং, অল দা ইউনিভার্স কন্সপায়ার্স ইন হেল্পিং ইউ টু অ্যাচিভ ইট" সত্যিই তো ও অমিতের বিদেশ যাওয়া থেকে এ পর্যন্ত প্রতি মুহুর্তে খুব খুব ভীষণ ভাবে পেতে চেয়েছিল । অসম্ভব জেনেও ওর হৃদয়ে নীরবে তাকে চেয়েগেছে।
- সুতপা দি কাল উদ্বোধন সংগীত আমি গাইবো আর মম চিত্তে নিতি নৃত্যে এই নাচটা পরিবেশন করবো । আর অনুরোধ আমার গান ও নাচের ফেসবুক লাইভ করবে কিন্তু । হোয়াট্সআপে মেসেজ করল। অমিতের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করল। লাইট জ্বালিয়ে আলমারি থেকে ঘুঙুর খুঁজতে শুরু করল। মনে মনে অঙ্গীকার করল রবীন্দ্র জয়ন্তীতেই তাদের শেষের কবিতার নবজন্ম ঘটুক।
নখ
দেবদাস কুণ্ডু
বাইকের ধাক্কায় বুড়ো লোকটি পড়ে গেল রাস্তায়। ছেলেটি বলল--কেন যে বুড়ো গুলি রাস্তায় বের হয়?
লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন---আমি রাস্তায়
বের হবো না?
--একসিডেনট হবে।
--কেন? আমি তো সাইড দিয়ে যাচ্ছিলাম। তুমি হঠাৎ - - - -
---ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নেমেছেন কেন?
--ফুটপাত আছে?
---তাহলে ধাক্কা খেতে হবে।
----কেন তুমি দেখে চালাবে না?
-----দেখে না চালালে এতখনে ভোঁ কাটা
-----বাবার মতো লোকের সংগে এভাবে কেউ কথা বলে?
-------জন্মের পর বাবাকে দেখিনি। আবার বাবার মতো - -
--এই কৃঞ ঐদিকে কি দেখছিস? কাপ গুলো
নিয়ে আয়। রতনদার কথায় কৃঞ কাপ নিয়ে আসে। আমি চা খেয়ে সিগারেট ধরিয়েছি। দৃশ্য টা দেখছি।
----মুখ সামলে কথা বল। আমি পুলিশ ডাকবো।
----পুলিশ? কোন দেশের? টাকা দিলে নো কেস।
সিগনাল উঠছে না। শালা বুড়ো গুলো সব জায়গায় ঝামেলা করে।
---তুমি মুখ সামলে কথা বল। আমার সবজির
দাম দাও।
---রাস্তার সবজী তুলে বাড়ি যা তো। শালা যত ঘাটের মরা। আবার সব্জির দাম চাইছে।
------ঐ নোংরার মধ্যে পড়ে থাকা সবজি নিয়ে যাব?
------হ্যাঁ ।তাই যাবি। কথা বাড়াস না।
----তুমি কি ভেবেছো দাম না দিয়ে চলে যাবে? লোকটি হাত বাড়ায়--দাও, টাকা দাও।
---টাকা? টাকা চাই না--এই নে - - ধাক্কা দিল। বুড়ো পড়ে গেল রাস্তায়। সিগনাল ওপেন হয়েছে। বাইক স্টাট দেয়, তখন হিংস্র বাঘের মতো কৃঞ ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেটার ওপর।
বাইক থেকে পড়ে গেল ছেলেটি। আমি দূর থেকে দেখছি। ধসতা ধসতি চলছে।মনে হচ্ছে উঠে গিয়ে ছেলেটাকে দু ঘা দি।. কিন্তু বসেই
থাকি। রতনদা ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। কৃঞ তখনও ফুসছে।
ছেলেটির জামা ছিঁড়ে গেছে। কৃঞর বড় বড়
নখে ছেলেটির পিঠ চিরে একাধিক ধারায় রক্ত
ঝরছে। পুলিশ এসেছে।
একটা লজ্জা নিয়ে বাড়ি ফিরি। বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে চমকে উঠি, নিজের নখগুলি কেটে কেটে কবেই ভোঁতা করে দিয়েছি।
Comments
Post a Comment