সম্পাদকীয় ৩
বিরাট একটা মাঠ, তার বাঁদিকে একটা বন্ধ কারখানা ডানদিকে একটা অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর আটকে পড়া রথ।মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে কারখানার সব শ্রমিক তাদের পরিবার ও কারখানার সাথে যুক্ত বাকি সব বিভিন্ন জীবিকার মানুষ, আর ডানদিকে রথের মেলার সাথে যুক্ত লোকজন। কারোর মুখে হাতে পায়ে কোন শো’কল্ড প্রোটেকশন নেই। অথচ দূরে আরো কিছু সরকারি লোক এই সব প্রটেকশন নিয়ে গাড়িতে চেপে বাকি সব দাঁড়ানো বা বসা লোকজনকে বাঁচতে শেখানোর চেষ্টা করছে।এটা আমার একটা দুঃস্বপ্ন থাকলেও ঘুম ভেঙে গেছিল।আসলে খুব ছোট থেকে রথের সাথে এমন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি যে টানলেও খোলা যাবে না।আমার চোখের সামনে না বললেও রথ নিজের থেকে চলতে আরম্ভ করে, মিষ্টির দোকানের বাইরে বালুসাই, জিলাপি তৈরী হতে আরম্ভ হতে করে।প্রতিদিনের হাঁটা চলার মধ্যেই সবাই বাঁচার চেষ্টা করে। রসে হাত ভিজিয়ে আর দাঁতের ফাঁকে জিলিপির টুকরো নিয়ে তো এটাই তো বেঁচে থাকা।
আসলে আমরা সবাই একটা এই রকম নির্মাণের মধ্যেই বাঁচতে চেষ্টা করি।একটা সরে থাকা অবশ্যই একটা বিনির্মাণ হয়ে যায়।এই যে সবার থেকে একটা দূরে থাকা, একটা সন্দেহের চোখে দেখা, বাড়ির বাইরে হাত পা ধুয়ে ( মনটাকে আরো নষ্ট করে) অফিস আদালতে বিনির্মাণকে নির্মাণ করবার একটা চেষ্টার মধ্যেই কিন্তু আস্তে আস্তে আমরা একে অন্যের থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি।একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে সব জায়গায় একটা দূরত্ব বজায় রাখবার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে থাকছে না, সেখানে আমরা করে নিচ্ছি।অর্থাৎ ‘আমরা প্রত্যেকে সবার থেকে দূরে।’ আয় তবে সরে সরে থাকি। আসলে একটা জিনিস ভুললে চলবে, ভিড় ও রথ প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে।আমার পিতৃভূমিতে একটা অদ্ভুত রীতি ছিল।সেখানে রথের দিন বড়োরা ছোটদের হাতে পয়সা দিত।পয়সা দিতে হত কাজের লোক ও জলতোলার লোককেও( কুয়ো থেকে জল তোলার জন্য লোক রাখা হত)। সেরকম একদিন জলতোলার মমতা পিসিকে রথের মেলা দেখতে যাবার কথা বললে উত্তর দেয়, ‘দাঁড়া আগে রথ দেখার টাকা পাই।’ এই হাতে টাকা থাকা যে’কোন মেলাতেই খুব দরকার, এটাই সব হিসাবকে এলোমেলো করে দেয়। মেলা না বলে বলা ভালো যে’কোন বেঁচে থাকাতেই টাকার দরকার, না হলে সব অঙ্ক ভুল হয়ে যায়।কোন জীবনেই আর প্রাণ আসবে না।
চারদিকে এই ভয়ানক অবস্থাতে বন্ধ হয়ে থাকা রথের চাকা এক রকমের এই ভয়াবহতাকেই নির্দেশ করে।কলকারাখানা বন্ধ, রেলের লাইনে ছড়িয়ে আছে মানুষের মাংস, রাস্তায় অভুক্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে বা জন্ম নিচ্ছে আগামীর ভারতবর্ষ, এ’যেন এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।
রথ আবার পিষে ফেলার রথ।ধরা যাক অভুক্ত, অর্ধভুক্ত উলঙ্গ মানুষের বুকের উপর দিয়ে চলে গেল সভ্যতার রথ, উন্নয়নের রথ।যারা মারা গেল রাতারাতি তাদের পুড়িয়ে বা কবর দিয়ে সেই জায়গায় একটা ছোট্ট সেতু তৈরী করে দিতেই বা কে আটকাচ্ছে।অথবা এক একটা লাশকে কুকুর বিড়ালের মত শিকে করে টেনে নামিয়ে টেনে তুললেও কে আটকাচ্ছে। তারপর গন কবর বা গন চিতা।আসলে রথ আমাদের কাছে থাকুক বা না থাকুক আমাদের সবার মনের মধ্যে রথে চেপে বসার শখ থাকে। সুযোগ পেলেই তাই নামি পত্রিকা লেখকদের ছেড়ে সদ্য পাশ করা ম্যানেজম্যান্টের লোকেদের হাতে তুলে দেয় কবিতা বা গল্প নির্বাচনের দায়িত্ব।তারাও রথে চেপে পিষে মেরে দিতে চায় হাজার হাজার কলম, কাগজ অথবা প্রজাপতি।মনে আছে যুগোস্লাভিয়ার মারিনা আব্রামোভিচকে যাকে ‘গ্র্যান্ডমাদার অফ পারফরম্যান্স আর্ট’ নামে ডাকা হয়।তিনি তাঁর সেই মহামূল্যবান ছয় ঘন্টা দিয়ে এই বিশ্ব সংসারকে বুঝিয়ে দিয়েছেন আমরা সবাই ধর্ষকামী, শুধু সুযোগের অপেক্ষা করে থাকি, পেলেই রথে চেপে পড়তে পারি। পিষে মেরে ফেলাও তো একরকমের ধর্ষকাম। বানার্ড শ র বিখ্যাত মেজর বারবার নাটকে একটি ডায়ালগ আছে, ‘one man’s meat another man’s poison.’এটি ভাবলে অবশ্য সবাই তার নিজের জায়গায় ঠিকই আছেন।সে খুনি থেকে ডাকাত বা আজকের তাদের থেকে জন্মানো মোহিনী রূপের রাজনৈতিক নেতা সবাই তো নিজের জায়গায় ঠিক।সেই সূত্রে আমরাও ঠিক।কারণ স্ট্রাকচারিলিজম তো বলতে সবই আপাত।একজনের সাপেক্ষে আরেক জন।তাই আমাদেরই জন্য রথ।আবার আমরা রথকে আমাদের মত করেই তৈরী করছি।কখনও চেপে বসি, কখন নিচের লোককে পিষে মেরে দিতে চেষ্টা করি।অন্তর্যামি এখন ভাবা বন্ধ করে দিয়েছেন, আমাদের কাছেও আসছেন না।আসলে সামাজিক দূরত্ব নামের একটা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তো।তাই বাইরের দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে দেখাতে লোকসমাগমের পর কানে একটু গরম ঘি মিশিয়ে ঢেলে দেওয়া,‘দেশের জন্য ঘরে থাকুন।’ আর ভার্চুয়াল রথে চেপে যান এগিয়ে যান।কে আটকাচ্ছে এখন?
ঋভু চট্টোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment