গল্প চিঠির গাছ ১

রঙিন পথ*
*********************
*বিশ্বদীপ মুখার্জী*

'হামার উখানে বিবি আর দুঠো বাচ্চা আছে সাহেব। দুটোই ছেলে আছে। বড় ছেলের উম্র দশ আর ছোট ছেলের চার বছর আছে সাহেব। দুটোই খুব শয়তান। দিনভর মাকে পারেশান করে দেয়।' 
আরও কত কথা। বিরজু কাজ মন দিয়ে করলেও কথা বলতো বড্ড বেশি। বিহারের কোন অজপাড়া গাঁয়ে তার বাড়ি। পেটের জ্বালায় এতদূর ভোপালে এসে রাজমিস্ত্রির কাজ করছে সে। নিজের গাঁয়ের যা যা গল্প বিরজু বলেছে আমায়, তাতে মোটামুটি তার গাঁয়ের একটা ছবি ফুটে উঠেছে আমার সামনে। গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটা স্কুল। তার বড় ছেলে সেই স্কুলেই পড়ে। একটা খাল পেরিয়ে যেতে হয় স্কুলে। বাঁশের পুল, খুবই অপলকা। ছেলের চিন্তা লেগেই থাকে বিরজুর। গ্রামের পরিবেশের বিষয় অনেকের মুখে শুনেছি, বইয়ে পড়েছি। বহুদিনের ইচ্ছে একবার কোনও গ্রামে যাওয়ার। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই ইচ্ছেটা পূরণ হয়নি। তাই আমার কাছে গ্রামের বিষয় যে যা গল্প বলে, আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনি। ভালো লাগে শুনতে। বিরজু যদি নিজের গ্রামের গল্প আমাকে না শোনাতো তাহলে হয়তো তার অত্যাধিক বকবক আমার ভালো লাগতো না। বিরজু জানে যে আমিও এখানে প্রবাসী। আমি পশ্চিমবঙ্গের লোক। কাজের সূত্রেই এই দূর অঞ্চলে আসা। ভোপালে যে সরকারী বিল্ডিংটা তৈরি হচ্ছে সেটার ইঞ্জিনিয়ার আমি। কন্ট্রাক্টর যে লেবার গুলোকে নিয়ে এসেছে, তাদেরই মধ্যে একজন বিরজু। বিরজু আমায় একদিন বলল - 'জানেন সাহেব, হামি এক সময় কালকাত্তাতেই ছিলাম। উখানেও ঠিকেতে কাজ করতাম। কত জায়গা ঘোরা হয়ে গেছে আমার। কালকাত্তা থেকেই তো বঙ্গালী শিখেছি।'
চেহারা ছোটখাটো হলে কী হবে, বিরজু পরিশ্রম করতে পারতো খুব। অফুরন্ত কথার মাঝেই করে যেত নিজের কাজ। বলাই বাহুল্য সে কাজ করতো খুব নিখুঁত। 

বেশ কিছুদিন হয়ে গেল বিরজুর সাথে দেখা নেই। কাজ বন্ধ, বলতে গেলে দশ বাই দশের একটা ঘরে বন্ধ আমি। দু - তিনদিনের তফাতে সকালে একবার বাজার যাই, তারপর সারা দিন গৃহবন্দী। একা মানুষ, কথা বলার কেউ নেই। মাঝে - মাঝে বিরক্ত লাগে, কিন্তু করার কিছুই নেই। বাড়ি থেকে বেরোনো বারণ, সরকারের কড়া নির্দেশ। এক অদৃশ্য শত্রু সমস্ত দেশকে নিজের কাবুতে করে রেখেছে। চাণক্যর একটা কথা মনে পড়ে। তিনি কোথাও একটা লিখেছিলেন - 'যখন শত্রু অদৃশ্য হয় তখন গৃহবন্দী থাকাই বাঞ্চনীয়।' এক অজানা ভাইরাস সমগ্র প্রথিবীকে তোলপাড় করে তুলেছে। যখনই খবর দেখি, দেখতে পাই মৃত্যু মিছিল। আমাদের দেশের অবস্থাও যে খুব ভালো তা নয়। মানুষের বাইরে বেরোনো বন্ধ, বন্ধ দোকানপাট। যাতায়াতের প্রত্যেকটি সাধন বন্ধ। ট্রেন যদি চলতো, তাহলে বলাই বাহুল্য আমি এমন কঠিন পরিস্থিতিতে বাড়ির বাইরে পড়ে থাকতাম না। বাড়িতে রোজ কথা হয় ঠিকই, কিন্তু মনের ভিতর এক অজানা ভয় অচিরেই নিজের বাসা বেঁধেই নিয়েছে। বাড়ি যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করে, কিন্তু কোনও উপায় নেই। 
সকালে বাজারে গিয়ে হঠাৎ বিরজুর সাথে দেখা। দেখাটা বেশ অনেক দিন পরেই হলো। প্রায় পনেরো দিনের উপর তো হবেই। কিছু এদিক ওদিক কথার পর বিরজু বলল - 'আর কী বলবো সাহেব, হাম লোগো কা অবস্থা কে বুঝবে? সরকার যদি হাম লোগো কা অবস্থা বুঝতো, তো ইতনা সমস্যা হতো না। হামার বাড়ি বিহারে। এই খরাব সময়ে হামি নিজের বাড়ি থেকে ইতনা দূর পড়ে আছি। কার ভালো লাগে বলুন।'
'ঠিকই বলেছ বিরজু। ভালো তো লাগেই না। আমারও তো সেই একই অবস্থা। বাড়ি যেতে পারছি না, মনটা ছটফট করছে।' আমি বললাম। 
খানিক চুপ থেকে বিরজু বলল - 'হামরা বহু লোগ আছি সাহেব। প্রায় পুরা বস্তি। হার কোই বিহারের আদমি আছে। হাম লোগ ঠিক করেছি এখানে থাকবো না। বাড়ি চলে যাবে।'
কথাটা শুনে আশ্চর্য হলাম আমি। কী বলে বিরজু? বাড়ি যাবে? তাও আবার এমন পরিস্থিতিতে? কী করে সম্ভব সেটা? জিজ্ঞাসা করা তে বিরজু যা উত্তর দিলো সেটা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম আমি। মনে মনে ভাবলাম, এটাও কি সম্ভব? এরা আদৌ বাড়ি পৌঁছতে পারবে তো? এটা কোনও প্রহসন নয় তো? যদি প্রহসন হয়, তাহলে কার সাথে? বিরজুর সাথে আমার ইয়ার্কির সম্পর্ক নয়। তাহলে প্রহসন কি নিজের ভাগ্যের সাথে? কিছু দিন আগেই খবর পেলাম যে সরকার নাকি বিদেশ থেকে বেশ কিছু ভারতীয়কে প্লেনে করে দেশে ফিরিয়ে এনেছে? তাহলে এরা কী দোষ করলো? এদের কি নিজের বাড়ি ফেরাবার কোনও ব্যবস্থা করা যায় না? 
বিরজু আমার আরও একটু কাছে এসে বলল - 'সাহেব, আমরা পৈদল যাবো।'
'মানে?' আমি চমকে উঠলাম। 
'আর কুছ উপায় নেই সাহেব। এমন করেই যেতে হবে হাম লোগো কো।' মুখে একরাশ বিষাদের ছায়া নিয়ে বিরজু বলল আমায়।
'তুমি জানো এখান থেকে পায়ে হেঁটে বিহার গেলে ক'দিন লাগবে পৌঁছতে?'
বিরজু আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল - 'জানি না সাহেব। কিতনা দূর যেতে পারবো সেটাও জানি না। রাস্তা মে কী হবে সেটা ভগবান জানে। হামি তো এটাই জানি যে হামার দুটো বাচ্চা হামার ইন্তজার করছে। হামার বিবির সাথে কালকেই কথা হলো ফোন মে। কন্না কাটি করছে সে। হামি এখানে থাকতে পারছি না সাহেব। উন সাবকো ইস অবস্থা মে ছেড়ে হামি এখানে থাকতে পারছি না।'
দেখলাম বিরজুর দু চোখ ছলছল করে উঠলো। সত্যি, আজকের এই স্বার্থপর জগতে এদের মনের ব্যথা বোঝার কেউ নেই। 
খানিক চুপ থেকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম - 'কবে বেরোবে?'
'দুয়েক দিনেই বেরোবে সাহেব। রেল লাইন ধরে যাবো। বাকি ভগবান মালিক।'

বাড়ি ফেরার ইচ্ছে তো আমারও। কিন্তু কোনও উপায় নেই, তাই হাত পা গুটিয়ে বসে আছি। কিন্তু এদের সাহস দেখে এদেরকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। পরিবারের টান, পরিবারের মায়া যে কী হয়, সেটা এদের দেখে অনুমান লাগানো যেতেই পারে। হঠাৎ করেই মনে একটা প্রশ্ন এলো। 
'এরা যদি পারে, তাহলে আমি পারবো না কেন?' 
প্রশ্নটা কি ইয়ার্কির ছলেই এলো নাকি এর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল আমার বাড়ি ফেরার সুপ্ত ইচ্ছে.... ঠিক বুঝতে পারলাম না। ঘরে ফিরে আসার পর কিছুতেই মনটা শান্ত করতে পারছিলাম না। বাড়ির লোকেরা জানতে পারুক সেটাও আমি চাই না। কিন্তু তারা জানতে পারবেই বা কী করে? কে বলবে ওদের? বিরজুর কথাগুলো শুনে বাড়ি ফেরার ইচ্ছেটা আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল। সারা রাত ঘুমোতে পারলাম না। দেখাই যাক না ওদের সাথে কিছুটা এগিয়ে। কিছু না কিছু ব্যবস্থা একটা হয়েই যাবে ঠিকই। মালবাহী ট্রাক তো এদিক ওদিক যাচ্ছে। কোনও একটা ট্রাকওয়ালাকে কিছুটা টাকা দিয়ে দিলেই অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে। মনের ভিতর ভয়ানক তোলপাড়ের পর একটা সিদ্ধান্তে আমি এলাম। কিন্তু পরের দিন যে বিরজুর সাথে দেখা হওয়াটা দরকার। যেতে তো হবে ওদের সাথেই। পরের দিন সকালেই বাজারের দিকে বেরিয়ে গেলাম। এই সময়টা বাজারে বেশ ভিড় থাকে। সকাল দশটা বাজতে না বাজতেই সম্পূর্ণ শহর যেন শ্মশানে বদলে যায়। শুধু ভোপাল না, বলতে গেলে পুরো দেশের একই অবস্থা। ভিড়ের মধ্যে বিরজুকে খুঁজতে থাকলাম আমি। আজকাল মানুষ দু তিনদিনের বাজার একসাথেই করে নেয়। যাতে প্রতিদিন বাজারে না আসতে হয় তাদের। বিরজুও হয়তো গতকাল তাই করেছে। তারপর সে তো চলে যাচ্ছে। আজ বাজারে আসার কোনও প্রয়োজন নেই তার। প্রায় এক ঘন্টা আমি তাকে খুঁজে বেড়ালাম। শেষে হতাশ হয়ে যখন ঘরে ফেরার জন্য পা বাড়াই তখন সামনে থেকে আসতে দেখি বিরজুকে। বিরজুকে এর আগেও অনেকবার দেখেছি, কিন্তু এত খুশি মনে কোনও দিন হয়নি যত খুশি তাকে দেখে আজ হলো। আমি দৌড়ে গেলাম তার কাছে। বললাম - 'এই যে বিরজু, তোমাকেই খুঁজছিলাম। ভাবলাম হয়তো তুমি আজ আসবে না বাজারে।'
'বিড়ি শেষ হয়ে গেছে সাহেব। তাই দেখতে এসেছি যদি....'
বিরজুর কথা মাঝ পথে থামিয়ে আমি বললাম - 'আচ্ছা শোনো না, তোমরা কবে বেরোবার ঠিক করলে?'
'কাল সাহেব। হামরা কাল বেরোবো।'
'তোমার কাছে পুরোনো, ছেঁড়া জামা প্যান্ট হবে এক জোড়া?'
বিরজু আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। 
'আরে, তোমাদের মত দেখতে লাগলে সেই ভিড়ের মধ্যে আমিও মিশে যেতে পারবো।'
*****************************************

এক অদ্ভুত অভিজ্ঞাতার সম্মুখীন হওয়ার লোভটাও সামলাতে পারলাম না সেটা বলাই বাহুল্য। বেশ বহু বছর ধরেই আমি লেখালিখি করি। নিজের জীবনের বেশ কিছু অভিজ্ঞাতা নিয়ে লিখেছি। কিন্তু এমন অদ্ভুত ও মারাত্মক অভিজ্ঞাতার বিষয় কোনও দিন লিখে উঠতে পারিনি। বাড়ি ও অভিজ্ঞাতা অর্জনের টানে বেরিয়ে গেলাম পরের দিন ভোরে। সাথে প্রায় পাঁচশোজন পরিযায়ী শ্রমিক। অধিকাংশ বিহারের। বেশ কিছু শ্রমিক পশ্চিমবঙ্গ যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল। আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরেছিলাম যে এখানে দিনের হিসেব না রাখাই ভালো। যেখানে লক্ষ্য, ইচ্ছে আর পরিশ্রমের মেলবন্ধন ঘটে সেখানে দিনের হিসেবের মূল্যই বা কী রয়ে যায়? যেহেতু হাঁটা পথের যাত্রা, তাই বেশি লাগেজ নিলাম না সাথে। পিঠে একটা ব্যাগ। কিছু জামা কাপড়ের সাথে ব্যাগে ছিল একটা ক্যামেরা। মাঝে মাঝে ক্যামেরা অন করে পরিযায়ী শ্রমিকদের ছবি তুলে নিচ্ছিলাম। চেষ্টা করছিলাম যেন ফ্রেমবন্দী করতে পারি তাদের দুঃখ, কষ্ট, আর্তনাদ ও ভিটের টান। যাত্রা পথে বেশ কিছু শ্রমিকদের কিছু কথাও আমার ক্যামেরাবন্দী হয়ে গেল। তাদের মধ্যে ছিল বিরজুও কিছু কথা। নিজের ব্যাগ থেকে বের করে নিজের স্ত্রী ও দুই ছেলের ছবিও আমায় দেখালো বিরজু। 
এক দিন, দু দিন, তিন দিন.... না, এখানে দিনের হিসেব রাখা তো ঠিক নয়। কিন্তু শরীরের ক্ষমতা তো সীমিত। আমাদের মধ্যে কারোরই দৈব শক্তি নেই। সাথে আছে ক্ষিদে, সাথে আছে তৃষ্ণা। গরম রোদ্দুরে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, বাচ্চাদের ক্ষিদে, তৃষ্ণায় গলা ফাটানো চিৎকার, মায়েদের কান্না.... সাথে পায়ে পড়ে যাওয়া ফোস্কা। সবকিছু মিলিয়ে বাড়ি ফেরার উৎসাহ যেন ক্রমে মলিন হয়ে যাচ্ছিল। এবার তো বেঁচে থাকার তাগিদ। এই চার পাঁচদিনে বেশ কিছু লোককে চোখের সামনে শেষ হতে দেখলাম। আশেপাশের পুলিশ এসে তাদের মৃতদেহ নিয়ে চলে যাচ্ছে। মৃতদেহের পিছু নিচ্ছে তাদের বাড়ির লোকেরাও। মাঝে মাঝে মিডিয়ার লোক এসে হাতে ক্যামেরা ও মাইক নিয়ে কিছু প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনও লাভ হচ্ছে না। 
জব্বলপুর যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হাঁটার ক্ষমতা আমারও নেই আর। আমাদের সংখ্যা এই ক'দিনে পাঁচশো থেকে কমে প্রায় সাড়ে চারশো হয়ে গেছে। আর যে ক'দিন লাগবে, সেটাও কেউ জানে না। যদি কেউ জানে তো সে হলো একমাত্র ঈশ্বর। তাই এখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আমার কাছে যা রসদ ছিল সেটা প্রায় শেষের দিকে। আমি বিরজুকে বললাম - 'আজ রাতে আর এগিয়ে লাভ নেই বিরজু। আমরা এখন জব্বলপুরে আছি। রাতটা এখানেই কোথাও থেকে যাই। কাল সকালে বাজার খুলবে নিশ্চই। রাস্তার জন্য কিছু রসদ কিনে আবার এগিয়ে যাবো।'
বিরজু রাজি হলো আমার কথায়। কিন্তু রাতে থাকবো কোথায়? রেল লাইনের দু ধারে খোলা মাঠ। সেখানেই না হয় বিশ্রাম নিয়ে নেওয়া যাক। যার কাছে যা ছিল সেটা বিছিয়েই খোলা মাঠে উন্মুক্ত আকাশের নিচে নিজেদের শরীর এলিয়ে দিলো। বেশ কিছুটা দূরে একটা স্টেশন দেখা যাচ্ছিল। নরসিংহপুর স্টেশন। জব্বলপুর আর নরসিংহপুর স্টেশন পাশাপাশি। আমার জলের বোতলে বিন্দুমাত্র জল নেই। একই অবস্থা বিরজুর এবং তার সাথে অনেকের। স্টেশনে হয়তো জল পাওয়া যাবে এই আশায় বিরজু আমাকে বলল - 'সাহেব, পানি কা বোতল দেন। ওই স্টেশন সে পানি নিয়ে আসি।'
আমি নিজের জলের বোতলটা বিরজুকে দিলাম। আরও কিছু লোকের থেকে খালি জলের বোতল নিজের ব্যাগে ভরে বিরজু এগিয়ে গেলো স্টেশনের দিকে। আমার সমস্ত শরীরে নেমে এসেছিল ক্লান্তি। আকাশের দিকে তাকিয়ে কখন যে চোখ লেগে গেল সেটা বুঝতে পারিনি। এক প্রচন্ড আওয়াজে চোখটা খুললো। এই আওয়াজ আমি চিনি। দুরন্ত গতিতে কোনও ট্রেনের ছুটে যাওয়ার আওয়াজ এটা। কিন্তু এখন ট্রেন কোথায়? পুরো দেশে তো ট্রেন চলাচল বন্ধ। হ্যাঁ, কিছু মালগাড়ি অবশ্যই চলছে। দেশ জুড়ে পণ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে মালগাড়ি। আওয়াজটা আরও ভালো করে শুনলাম। হ্যাঁ, এটা মালগাড়িই আওয়াজ। সাথে আরও কিছু আওয়াজ কানে এলো। আওয়াজ শুনে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। এ আওয়াজ আমি স্পষ্ট ভাবে কোনও দিন কানে শুনিনি। কিন্তু তবুও আওয়াজটা যেন খুবই চেনা লাগলো আমার কাছে। এত....এত মানুষের চিৎকারের আওয়াজ! ধড়ফড় করে উঠলাম আমি। মাঠে যারা শুয়েছিল তারাও আমার সাথে উঠলো। এক লাফে ছুটে গেলাম রেল লাইনের ধারে। মালগাড়ি ততক্ষণে চলে গেছে। রেল লাইনে পড়ে আছে রক্তাক্ত কিছু মৃত ও অর্ধমৃতদেহ। এই ভয়াবহ দৃশ্যটা দেখে গা গুলিয়ে উঠলো আমার। এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার লোভে এমন বীভৎস দৃশ্য দেখতে হবে, সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি আমি। কিন্তু বিরজু কোথায়? তার জল আনতে যাওয়ার তো অনেকক্ষণ হয়ে গেল। আশেপাশের লোকেদের ঠেলে আমি বিরজুর নাম নিয়ে এগিয়ে গেলাম নরসিংহপুর স্টেশনের দিকে। আর্তনাদ ক্রমে বেড়ে চলেছে। মৃতদেহের উপর আছড়ে পড়ছে কিছু মানুষ। বুক চাপড়ে প্রকাশ করছে নিজেদের আর্তনাদ। অর্ধমৃতদের বাড়ির লোকেরা "ডাক্তার-ডাক্তার" বলে চিৎকার করে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ নেই যারা এদের চিৎকার শুনতে পারবে। আমিও কেমন যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছি। প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে ক্রমাগত বিরজুর নাম নিয়ে রেল লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। হঠাৎ কিছু একটাতে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম আমি। বলাই বাহুল্য হাতে পায়ে বেশ ভালোই আঘাত লাগলো। কিন্তু হোঁচটটা খেলাম কীসে? তাকিয়ে যা দেখলাম, সেটার বর্ণনা করার ক্ষমতা হয়তো আমার মধ্যে নেই। একটা রক্তাক্ত কাটা মৃতদেহের পাশে পড়ে আছে একটা ব্যাগ। ব্যাগ থেকে গড়িয়ে পড়ছে বেশ কিছু ভর্তি জলের বোতল। সেই বোতলের ভিড়ে চিনতে পারলাম নিজের বোতলটা। 
*****************************************

পূর্ণিমার রাতে স্পষ্ট চাঁদের আলোতে দেখা সেই দৃশ্য দেখে এখনও আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি। মনচিকিৎসককে দিয়ে চিকিৎসা চলছে আমার। এক অদ্ভুত ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমি। অনেকটাই সুস্থ হয়েছি, তাই কলম হাতে নিয়ে লিখতে পারছি সেই মর্মান্তিক ঘটনাটা। চারিদিকে শোনা যায় বহু তর্ক - বিতর্ক। কেউ বলে শ্রমিকদের দোষ, তো কেউ বলে সরকারের। রেল লাইন মানুষের বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা নয়। এই যুক্তিতে অনেকেই তর্ক - বিতর্কের যুদ্ধে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করেছে। অনেকে আমার থেকে সেই রাতের বিস্তৃত বর্ণনা চেয়েছে। কিন্তু আমি দিতে পারিনি। আমার সহযাত্রীদের বেদনাকে প্রকাশ্যে এনে আমি কারোর অর্থ উপার্জনে সাহায্য করতে পারবো না। ঘটনাটা লিখে রাখছি নিজের ডায়রিতে। লেখাটা মুদ্রিত আকারে দেখার আমারও কোনও ইচ্ছে নেই। নিয়তি তাদের ফেরার পথ যে লাল রঙে রাঙিয়ে দেবে, সেটা এখনও মেনে নিতে পারছি না। পাঁচশো জনের মধ্যে আদৌ ক'জন বাড়ি ফিরতে পারতো সেটা নিয়ে একটা সন্দেহ জন্মে গিয়েছিল। তাবলে তাদের এমন মর্মান্তিক শেষ হবে? কে দোষী যদি সেটা বিচার করতে যাই, তাহলে আমার নজরে দোষী পরিস্থিতি। পরিস্থিতির সাথে মিশে নিয়তির এই নির্মম খেলা আমি হয়তো আর কোনও দিন ভুলতে পারবো না। আর হয়তো কোনও দিন ফিরতে পারবো না নিজের স্বাভাবিক জীবনে। 
সেই রাতের শেষ দৃশ্যটা মনে পড়ে। জলের বোতলের ভিড়ে দেখতে পেয়েছিলাম রক্তাক্ত একটা ছবি। ছবিতে রয়েছে একজন মহিলা ও দুটো বাচ্চা। 
জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। যখন চোখ খুলল নিজেকে পেলাম একটা হাসপাতালে। বাঁ পায়ের হাঁটুতে চোট লেগেছিল। ব্যান্ডেজ বাঁধাছিল সেখানে। আশেপাশের কিছু লোকেদের থেকে শুনতে পেলাম যে সরকার নাকি দেশের বেশ কিছু রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার জন্য বিশেষ ট্রেন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিমেষে চোখের সামনে ভেসে উঠলো বিরজুর মুখ ও রক্তে ভেজা একটা ছবি। 

*সমাপ্ত।* 



রাজকুমারীর গল্প

কলমে - মহুয়া মিত্র 

ফুলকুসুমপুর রাজ্যের রাজবাড়ির যে বাগান, তা যেন এক আশ্চর্য জগত । কত ফুল, কত ফল , কত পাখি, রঙিন প্রজাপতি, বাহারি ফোয়ারা - সব মিলিয়ে মন ভালো করা এক রঙবাহারি দুনিয়া । আর রোজ সকালে যখন সেই বাগানে খেলে বেড়ায় ঐ রাজ্যের রাজকুমারী নীলাম্বরী, তখন যেন সেই বাগানে প্রাণের সঞ্চার হয় । তবে রাজকুমারী হলে কি হবে, তার বেশভূষা একেবারে সাদামাটা । দশ বছরের রাজবালিকা এলো চুলে বাগান থেকে ফুল কুড়িয়ে গোঁজে , পরনে রেশমী শাড়ি ।ব্যাস, না আছে রূপটান আর না আছে অলংকারের বাহুল্য । তবুও রোজ সকালে সে যখন পাখিদের সাথে গান গায় বা সরোবরের মাছের সঙ্গে সাঁতার কাটে তখন তাকে দেখে মনে হয় বুঝি কোন দেবকন্যা পথ ভুলে মর্ত্যে চলে এসেছে । এমন তার রূপের চমক ।

আজও সে উদ্যানের হরিণ ছানাদের নরম কচি ঘাস খাওয়াচ্ছিল আর আপন মনে ওদের সাথে কথা বলছিল । গতকাল সে নতুন এক সঙ্গীতের রাগ গুরুদেবের কাছে শিখেছে, সেই রাগ হল ভোরবেলার রাগ । বড্ড মনে ধরেছে সেই রাগ নীলাম্বরীর । সেই সব কথাই হচ্ছিল । বেশ বেলা হয়ে গেছে, সূর্য মাথার উপর উঠে গেছে । এমন সময়ে নীলাম্বরীর ধাইমা এসে ওকে ডেকে নিয়ে গেল, এখন যে ওর অস্ত্র শিক্ষার সময় । নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজকুমারী গেল কারণ পিতার আদেশ অমান্য করা ওর স্বভাব বিরোধী ।

অস্ত্র শিক্ষা শেষ হলে নীলাম্বরী মায়ের কাছে বসে জলখাবার খেতে খেতে বলল , - " মা, তুমি পিতাকে বলো না যে  অস্ত্র শিক্ষা আমার পছন্দ নয়!  "
রাণী বললেন, - " এ কেমন কথা নীলা, এত বড়ো রাজ্যের রাজকুমারী তুমি,  তুমি তোমার পিতার জ্যেষ্ঠা কন্যা, তোমার দুই ভাইই খুব ছোট, আর কয়েকটা বছর পর পিতার সঙ্গে তোমাকেই তো রাজ্যের হাল ধরতে হবে, অস্ত্র শিক্ষা না করলে যে হবে না । "

এরপর নীলাম্বরী পাকশালের প্রধান পাচকের কাছে গিয়ে চাটনি রান্নার প্যাঁচপয়জার শিখতে লাগলো, কারণ পিতার যে প্রবল ইচ্ছে তার কন্যা যে রাজ্যের যুবরাণী হয়ে যাবে সেই রাজ্য যেন সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তার কন্যার স্পর্শে ।

এর কয়েক দিন বাদে মহারাজ, মহারাণীকে বললেন, - " রাণী, তুমি নীলাকে বলে দিও যে এবার থেকে ও যেন আমার সঙ্গে রাজসভায় বসে কারণ এবার সময় হয়েছে রাজনীতির খুঁটিনাটি বিষয়ে ওর জানবার । আর আমি ওর উপযুক্ত স্বামীর সন্ধান করছি, রাজনীতির পাশাপাশি তুমি ওকে ঘরকন্নার কাজেও পারদর্শী করে তোলো । ও যেন এখন থেকে আর ভোরবেলা বাগানে না যায়, সেই সময়টা পারলে একটু পুঁথি পাঠ করে । "

রাজকুমারী নীলাম্বরী আর বাগানে যায় না । সে এখন ঘরের মধ্যে এস্রাজ বাজিয়ে গান করে তবে সে গানে সুর নেই । তার নির্ধারিত কক্ষে সাঁতার কাটে , সেখানে মাছও নেই, পদ্ম ফুলের শোভাও নেই । ওদিকে বাগানও কেমন মনমরা । ফুল হয়তো ফোটে কিন্তু পাখি গান করে না, প্রজাপতি নাচ  করে না । কত দিন হল হরিণ ছানারা রাজকুমারীর বকবক শোনে নি ।

রাজকুমারী এখন সবসময়ই সুসজ্জিতা হয়ে থাকে । তাকে যে পিতার, এই রাজ্যের উপযুক্ত হতে হবে । ছেলেমানুষি তাকে মানায় না । সেদিন বিকেলে ঘরের এক কোণে চুপ করে বসে ছিল নীলাম্বরী । দু চোখে জল টলটল করছ। দম আটকে আসে এই যান্ত্রিক জীবনে । কিন্তু নিরুপায় । হঠাৎই কিসের শব্দে তাকিয়ে দেখে জানলার ধারে এসে বসেছে একটা ছোট্ট হলুদ পাখি । পাখি রাজকুমারীকে বলল, - " ও রাজকুমারী, তুমি বাগানে আসছো না কেন? আমরা কি কোন দোষ করেছি? "
চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলাম্বরী বলল, - " না পাখি, তোমাদের কোন দোষ নেই, সব দোষ আমার কপালের ।"
বলে রাজকুমারী সব কথা খুলে বলল পাখিকে । পাখি সমস্ত শুনে উড়ে গেল । সেদিন সারা রাত ধরে পাখি ফুল প্রজাপতি চাঁদ তারার কি সব যেন ষড়যন্ত্র চলল ।

পরদিন সকালে যথা সময়ে রাজার ঘুম তো ভাঙল , কিন্তু এ  কি ? এখনো সূর্য ওঠে নি, পাখি ডাকছে না, সরোবরের মাছেরা নির্জীব হয়ে ভাসছে । এক অজানা আশঙ্কায় মহারাণীর বুক কেঁপে উঠল । রাজ্যবাসী ছুটে এল রাজার কাছে, তারাও ভীত । মহারাজের মনে ভয় জাগলেও মুখে কিছু বললেন না । রাজপুরোহিত রাজার কাছে এসে বললেন, - " মহারাজ, শ্রী হরির কৃপায় আমি কিছু বিশেষ গুণের অধিকারী এবং সেই একই গুণ আপনার কন্যার মধ্যেও বিরাজমান । সে পরিবেশের সকলের ভাষা বুঝতে পারে , তাই তো তার ফুল পাখি চাঁদ তারার সাথে এত ভাব । কিন্তু ইদানীং আপনি তাকে বাইরের জগতের থেকে পুরোপুরি আলাদা করে রেখেছেন বলে তার মন ভার । ওদিকে ওর ভালবাসার বস্তুগুলিও ওকে পাচ্ছে না বলে ম্রিয়মাণ । আপনি এখনি রাজকুমারীকে খোলা আকাশের নিচে যেতে অনুমতি দিন , না হলে সব শেষ হয়ে যাবে । "

রাজা স্বয়ং বাগানে এলেন । আসতেই মন ভালো হয়ে গেল । কত দিন হল বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করেন নি, ফুলের গন্ধ নেন নি । খালি কাজ আর রাজ্য শাসন । অন্ধকারে খোলা আকাশের নিচে বুক ভরে শ্বাস নিতে বড্ড আরাম পেলেন । তারপর জোরে জোরে ডাকলেন, - " নীলাম্বরী, নীলা মা , আয় তো এখানে! "
পিতার ডাকে নীলাম্বরী ছুটে বাগানে এল । আর সাথে সাথে সূর্য উঠল , পাখিরা গাইল, সরোবরের মাছেরা লাফিয়ে উঠলো, গাছের পাতা দুলে উঠল । চারিদিকে যেন উৎসবের আবহ । রাজা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, - " যা মা , তোর ছুটি, যা মন চায় কর্ , তোর বন্ধুদের তোকে খুব দরকার । ওদের কাছে থাকলে তুই ভালো থাকবি আর তুই ভালো থাকলে আমরা এই রাজ্যের সবাই ভালো থাকবো, আনন্দে থাকবো । "

এরপর থেকে আবার সেই আগের মতোই হয়ে গেল ফুলকুসুমপুর রাজ্য । আর নীলাম্বরী? সে এখন আর সাজগোজ করে না, খালি গান করে আর নাচ করে । ওর কান্ড দেখে ফুলেরা মাথা দুলিয়ে হেসে ওঠে ।



এহেন স্বপ্ন দেখে যে মেয়ে

আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

       
প্রতিদিন বিকেলে ঘাটের ধারে মন্দিরের পিছনে কয়েকজন ছেলে বসে।তরুণ ছেলে।সেখানে তারা আড্ডা দেয়।চায়ের দোকানের বেঞ্চে বা মাচানে বসে গুণ্ডা মার্কা লোকেরা যে ধরনের আড্ডা দেয় সেরকম আড্ডা নয়।সাহিত্য আড্ডা।এখানে রোজ একজন করে তরুণ স্বরচিত কবিতা ও গল্প পাঠ করে শোনায়।অর্থাৎ যার যেদিন পালা পড়ে।আর অন‍্যরা তা শুনে মতামত দেয়।শুনে যাকে যেমন লাগে সে তেমনটিই জানায়।সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সাহিত্য আড্ডা যদিও এখন আর এভাবে বসে হয় না বললেই চলে।কিন্তু এখানে হয় দেখে ভালো লাগল।যাইহোক,আজ অমরেন্দ্রর পালা।অর্থাৎ অমরেন্দ্র আজ তার স্বরচিত লেখা পাঠ করে শোনাবে।অমরেন্দ্র আড্ডায় এসে বসতেই অন‍্যরা তাই বলতে লাগল,"অমরেন্দ্র দা,আজ কিন্তু আপনার পালা।মনে আছে তো?"
"থাকবেনা আবার?"
"প্রস্তুত তাহলে হয়েই এসেছেন?"
"এসেছি তো।"
"কি পাঠ করবেন ভাবছেন গল্প?না কবিতা?"
অমরেন্দ্র গল্প-কবিতা দু'রকমই লেখে।সে বলল,"আগের দিন তো একটা কবিতা পাঠ করেছি। ভাবছি,আজ একটা গল্প পাঠ করবো।হবেনা?"
"কেন হবেনা?খুব হবে।"সবাই খুশি হয়ে বলল,"আজ আপনি একটা গল্প পাঠই করুন।তার কারণ আপনার গল্প পাঠ শুনতে আমাদের সবার ভালো লাগে।খুব খুব ভালো লাগে।"
অমরেন্দ্র স্মিত হাসলো শুনে,"তাই?"
কমল নামে একজন তখন বলল,"হ‍্যাঁ দাদা,রিয়েলি বলছি।আপনার গল্পের মাধুর্যই আলাদা।তাই আপনার গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে।আপনি যে আজ গল্প পাঠ করবেন এটা আপনি না বললেও আমরা কিন্তু আপনাকে আজ একটা গল্প পাঠ করতেই বলতাম।আপনি আসার আগে আমাদের এ বিষয়ে কথাও হয়েছে যে,আপনাকে আমরা আজ কবিতা নয়,একটা গল্প পাঠ করতে বলবো। আমার কথা বিশ্বাস না হয় এখানে আরো যারা আছে তাদের জিজ্ঞেস করুন!"
অমরেন্দ্র সবার মুখের দিকে তাকালো,"কি,তাই?"
"হ‍্যাঁ,দাদা।"সবাই বলল।

দুই

এখানে যারা বসে অমরেন্দ্রর চাইতে তারা বয়সে সবাই ছোট।যেকারণে অমরেন্দ্রকে সবাই শ্রদ্ধা করে।আর সবাই 'দাদা' বলে।
অমরেন্দ্র বলল,"বেশ।সবার যখন ইচ্ছা তখন একটা গল্পই পাঠ করছি।"বলে সে যখন একটা গল্প পাঠ শুরু করতে যাবে তার মোবাইলে একটা ফোন এল।মোবাইলটা তখন বাজতে শুরু করল,"তেরি মেরি কাহানি..."
অমরেন্দ্র "এক মিনিট"বলে ফোনটা ধরলো,"হ‍্যালো!"
"কে,অমরেন্দ্র দা বলছেন?"
"বলছি।"
"আমি সবিতা বলছি।"
এই সবিতা মেয়েটা হল অমরেন্দ্রর বোনের বান্ধবী। অমরেন্দ্রর বোন কঙ্কনা কিছুদিন আগে তাকে একবার তাদের বাড়িতে বেড়াতে এনেছিল।তখনই সবিতার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল।অমরেন্দ্র তাদের বাড়িতে তাকে প্রথম দেখে কঙ্কনাকে জিজ্ঞেস করেছিল,"এটা কে রে,কঙ্কনা?চিনতে পারলাম না।"
কঙ্কনা বলেছিল,"আমার বান্ধবী।"
"ও,আচ্ছা।"তারপর তাকে জিজ্ঞেস করেছিল,"কলেজ থেকে কখন ফিরলি?"
"অনেকক্ষণ হল।এসে তো তোকে বাড়িতে দেখতেই পাচ্ছি না।কোথায় ছিলি?"
"একটু মোড়ের দিকে ছিলাম।মোবাইলে নেট শেষ হয়ে গেছে।নেট মারতে গিয়েছিলাম।"
"নেট মারতে এতক্ষণ লাগল?"
"বন্ধুদের সঙ্গে একটু বসে গল্পও করছিলাম।"
"তাই বল।"
এরপর অমরেন্দ্র কঙ্কনাকে তার বান্ধবীর নাম জিজ্ঞেস করেছিল,"তোর বান্ধবীর নাম কি?"
"সবিতা।"কঙ্কনা নাম বলেছিল।
অমরেন্দ্র অমনি কঙ্কনাকে ধরেছিল,"সবিতা মানে কি বল?"
কঙ্কনা বলেছিল,"কি করে বলবো?"
অমরেন্দ্র বলেছিল,"সে কি রে!কলেজে পড়িস আর সবিতা মানে জানিস না?"
"না,জানিনা।"
"লজ্জা!লজ্জা!"
"ঠিক আছে।তুই বল।"
অমরেন্দ্র তখন বলেছিল যে,'সবিতা' মানে এক রকম মানে হয় না।অনেক রকম মানে হয়।যেমন একটা,সূর্য।অর্থাৎ সূর্যকে সবিতা বলে।ঈশ্বরকেও সবিতা বলে।প্রসবকারী।জনয়িতা।আর হল স্রষ্টা। এদের সবাইকে সবিতা বলে।
মানে জানা হলে পরে কঙ্কনা এবার অমরেন্দ্রর সঙ্গে সবিতার আলাপ করে দিয়েছিল,"সবিতা,এটা আমার দাদা।নাম অমরেন্দ্র সরকার।খুব ভালো লেখে।দাদার লেখা পড়লে তুই মুগ্ধ হয়ে যাবি।এত ভালো লেখে।"
সবিতা এবার তার নীরবতা ভেঙেছিল,"তাই নাকি,দাদা?"তারপর জিজ্ঞেস করেছিল,"আপনি কি লেখেন,দাদা?"
অমরেন্দ্র নীরব ছিল।তার নীরব থাকা দেখে কঙ্কনা বলেছিল,"দাদা বলবেনা।আমি বলছি।"সে বলেছিল,"দাদা গল্প,কবিতা,উপন্যাস সবই লেখে।খুব ভালো লেখে।"
অমরেন্দ্র তখন কঙ্কনাকে বলেছিল,"সেই তখন থেকে তো খুব ভালো লেখে ভালো লেখে করছিস,তোকে কে বলেছে আমি খুব ভালো লিখি শুনি!"
"কে বলবে?আমি বলছি।"কঙ্কনা বলেছিল।
অমরেন্দ্র তার উত্তরে তাকে তখন বলেছিল যে,সে সাহিত্যের কিছু বোঝে?প্রশ্ন সূচক বাক‍্যে বলেছিল।
কঙ্কনা বলেছিল,"বুঝি না তো এমনি বলছি?"
অমরেন্দ্র তখন যা বলেছিল তাকে তা হল,"যে মেয়ে 'সবিতা' মানে বলতে পারেনা সে যে সাহিত্য কতই বোঝে সেটা আমার জানা হয়ে গেছে।"
উত্তরে তার কঙ্কনা তখন যা বলেছিল তা হল,"না রে দাদা,তুই বিকালে যখন বাড়িতে থাকিস না। সাহিত্য আড্ডায় বেরিয়ে যাস।আমি তখন তোর লেখা গুলো বসে বসে মন দিয়ে পড়ি!কি সুন্দর লাগে পড়তে!তোর লেখা পড়ে কতদিন আমার কি মনে হয়েছে জানিস?তুই আমার নিজের দাদা না হয়ে যদি সবিতার দাদা হতিস বা রক্তের সম্পর্ক ছাড়া পাড়ার কেউ হতিস তো আমি নির্ঘাত তোর প্রেমে পড়ে যেতাম।"
অমরেন্দ্র অমনি চমকে উঠেছিল,"কি বললি!"
"হ‍্যাঁ রে দাদা,তুই বিশ্বাস কর।"
সবিতা তখন চুপ করে বসে তাদের দুই দাদা বোনের কথা শুনছিল।কঙ্কনা আর অমরেন্দ্রর। আর মাঝে মাঝে অমরেন্দ্রকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।সবিতাকে অমরেন্দ্র তখন বলেছিল,"তুমি কঙ্কনার কথা একদম বিশ্বাস করবেনা,সবিতা।ও কি বলতে কি যে কখন বলে ফেলে ও নিজেই জানেনা।আমি মোটেও ভালো লিখতে পারিনা।মনের খোরাক মেটানোর জন্য মনে যা আসে তাই লিখি মাত্র।সেগুলো মোটেও ভালো লেখার মধ্যে পড়ে না।তবে আমাদের একটা সাহিত্য আড্ডা হয়।সেই আড্ডায় অনেকেই  ভালো লেখে।খুব ভালো লেখে।"
সবিতা তার উত্তরে তখন বলেছিল,"আমি কঙ্কনার কথাই বিশ্বাস করবো।আপনার কথা বিশ্বাস করবো না।"
অমরেন্দ্র বলেছিল,"তা তো করবেই।কারণ কঙ্কনা তোমার বান্ধবী যে।তোমরা দু-জন এক যে।আর আমি তো কেউ না।"
অমরেন্দ্রর এই কথা শুনে সবিতা ভীষণ মজা পেয়েছিল।তার পাতলা ঠোঁটের মিষ্টি হাসি দেখে অমরেন্দ্র সেটা বুঝতে পেরেছিল।আজ সবিতার ফোন পেয়ে অমরেন্দ্রর সেসব কথা মনে পড়ে গেল।সে বলল,"বলো।"
সবিতা বলল,"ভালো আছেন?"
অমরেন্দ্র বলল,"আছি।তুমি ভালো আছো?"
"আছি।"সবিতা বলল।
অমরেন্দ্র তখন বলল,"অনেক দিন বাদে ফোন করলে!"
"হ‍্যাঁ।"
"এতদিন ফোন করোনি কেন?"
"আপনার নাম্বারটা আমার মোবাইল থেকে ডিলিট হয়ে গেছে।"
"আজ কোথায় পেলে?"
"ফোন করে কঙ্কনার কাছে নিলাম।"
"আগেও তো নিতে পারতে।যাক,কি জন্য ফোন করেছ,বলো।"
সবিতা বলল,"দাদা,আজ আমি ভেরি ইন্টারেস্টিং একটা স্বপ্ন দেখেছি।রাতে।সেটা আপনাকে বলবো বলে ফোন করেছি।সকালে ব‍্যস্ত ছিলাম বলে ফোন করা হয়নি।এখন করলাম।"
"কি স্বপ্ন দেখেছ,বলো।"
সবিতা বলল,"আমি শিয়ালদহ স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি।"
"স্টেশনের ভেতরে?না বাইরে?"
"স্টেশনের বাইরে।মানে স্টেশন চত্বরে।"
"বেশ,দাঁড়িয়ে কি দেখলে বলো।"
"আমার কাছে একটা লোক এসে দাঁড়ালো। লোকটা দেখতে ছিপছিপে গড়ন।মাথায় বেশ লম্বা।গায়ের রং কৃষ্ণ বর্ণ।মুখে কয়েকদিন না কাটা কাঁচা পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি।গায়ে ফুল শার্ট। সাদার উপর কালো দাগ টানা।আর পরনে নীল জিনস প‍্যান্ট।পা দুটো জড়ানো।সে আমাকে বলল,"দারুণ খবর!দারুণ খবর!"
আমি জানতে চাইলাম,"কি দারুণ খবর?"
সে তার ব‍্যাগ থেকে এবার একটা ম‍্যাগাজিন বের করে আমাকে দেখাল,"এটা কি বলুন তো!"
আমি বললাম,"ওটা একটা ম‍্যাগাজিন।"
"হ‍্যাঁ,ঠিকই বলেছেন।এই ম‍্যাগাজিনে একটা উপন্যাস বেরিয়েছে।তরুণ লেখকের উপন্যাস। বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে পাঠক মহলে ভীষণ সাড়া পড়ে গেছে।গত পঞ্চাশ বছরে নাকি কোনো কবি সাহিত্যিক এরকম উপন্যাস লিখতে পারেননি।তাই এটাই হল দারুণ খবর।"
"আচ্ছা!"
"কি,বলুন!"
"কি উপন্যাস?"
"আলো-অন্ধকার।"
"ম‍্যাগাজিনটা হাতে নিয়ে একটু দেখি!"
"দেখা যাবেনা।"
"দেখা যাবেনা কেন?"
"নোংরা হয়ে যাবে।দেখলেন না,আপনাকে দেখিয়ে তক্ষুনি আবার ব‍্যাগের ভেতর ভরে ফেললাম।"
"বুঝলাম।কিন্তু দেখতে না দিলে আপনার ম‍্যাগাজিন যে বিক্রি হবেনা।মানুষ কিনবে না।"
"কিনবে কিনবে।"
"কিনবে তো একজনও কিনছে না!"
"ঠিক কিনবে।"
"ঠিক আছে।লেখকের কি নাম বলুন!"
"অমরেন্দ্র সরকার।"
"কি নাম বললেন!"
"অমরেন্দ্র সরকার।"
"লেখকের কোনো ফটো আছে?আপনার কাছে?"
"থাকবেনা কেন?আছে।দেখবেন নাকি?"
"একটু দেখান দেখি!"
ম‍্যাগাজিনটা না দেখালেও ফটোটা সে ঠিকই দেখাল,"এই দেখুন!"
ফটোটা দেখে আমি তো অবাক,এ যে আপনার ফটো।কি সুন্দর আপনি ফটোতে হাসছেন। আপনার দাঁত গুলো কি সুন্দর ঝকঝক করছে। আর আপনার গালের তিলটাও স্পষ্ট।
শুনে তো অমরেন্দ্র অবাক,"সত্যি!"
"সত্যি।"
"আচ্ছা,তারপর?"
"তারপর লোকটা আমার কাছ থেকে ফটোটা চেয়ে নিয়ে বলল,"ভদ্রলোক দেখতে দারুণ হ‍্যান্ডসাম বলুন!"
আমি বললাম,"উনি আমার আগে থেকেই পরিচিত।"
"পরিচিত!আপনার?হা-হা-হা---"আমার কথা শুনে লোকটা হাসলো।মানে আমাকে উপহাস করল।
"হ‍্যাঁ দাদা,উনি আমার সত্যি পরিচিত।আমার বান্ধবীর দাদা।"আমি লোকটাকে বললাম।
লোকটা তখন আমাকে বলল,"কি যা তা বলছেন!ইনি আপনার বান্ধবীর দাদা হতে যাবেন কেন?ইনি হলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক অমরেন্দ্র সরকার।"
"আমার বান্ধবীর দাদাও অমরেন্দ্র সরকার।"
"উনি আপনার বান্ধবীর দাদা অমরেন্দ্র সরকার।আর ইনি হলেন সাহিত্যিক অমরেন্দ্র সরকার।"
"কিন্তু ফটোতে দেখে যে আমি স্পষ্ট চিনতে পারলাম।আমার বান্ধবীর দাদা অমরেন্দ্র সরকার।"
লোকটা এবার কষে ধমক মারলো একটা আমাকে,"থামুন তো!যত্তসব!"
আর অমরেন্দ্র অমনি শব্দ করে জোরে জোরে হাসতে লাগল,"হা-হা-হা।সত্যি তো ভেরি ইন্টারেস্টিং স্বপ্ন।"তারপর জিজ্ঞেস করল,"তুমি তখন কি করলে?"
"লোকটার কাছে আমি একটা ম‍্যাগাজিন কিনবো বলে দাম জিজ্ঞেস করলাম,"আপনার ম‍্যাগাজিনের দাম কত?"
"ক'টা নেবেন?"লোকটা শুধাল।
আমি "একটা নেবো।" বললাম।
লোকটা তখন"দু-হাজার টাকা লাগবে।" বলল।
"কি!"আমি দাম শুনে চমকে উঠলাম।
লোকটা তখন আবার বলল,"দু-হাজার টাকা লাগবে।"
"একটা ম‍্যাগাজিনের দাম দু-হাজার টাকা লাগবে!কি যা তা বলছেন!"
"যা তা নয় ম‍্যাডাম,ঠিকই বলছি।"
"না,ঠিক বলছেন না।"
"আমি ঠিকই বলছি।আপনার মনে ধরলে নেবেন। মনে না ধরলে নেবেন না।"
"একটা ম‍্যাগাজিনের দাম কখনো দু-হাজার টাকা হয়?"
"হয় ম‍্যাডাম,হয়।"লোকটা বলল।
আমি বললাম,"না,তা হয় না।"তারপর বললাম,"দু'হাজার টাকা দিয়ে কেউ ম‍্যাগাজিন কিনে?"
"কতজনই কিনে।কিনে না তো ম‍্যাগাজিন গুলো সব যাচ্ছে কোথায়?আমরা তো আর সেদ্ধ করে খাচ্ছি না!না খাচ্ছি?"
"খাচ্ছেন কি খাচ্ছেন না সেটা আপনারাই জানেন। আমি কি করে জানব?"
"বুঝেছি ম‍্যাডাম,আপনি ম‍্যাগাজিন কিনবেন না। আপনার সঙ্গে শুধু আমার ফালতু ফালতু বকা হল।"
"কিনবো তো কিনবো কি করে?দু-হাজার টাকা তো আর কম টাকা নয়।একটা ছোট ফ‍্যামিলির একমাস চলে যাবে।অতটাকা কাছে এখন আছে নাকি?"এরপর লোকটা ভিড়ে কোথায় যে হারিয়ে গেল আর দেখতে পেলাম না।পেলাম না তো পেলামই না।তারপর আমার ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নটা সত্যি দারুণ বলুন!"
"শুধু দারুণ নয় গো,দারুণেরও দারুণ!"অমরেন্দ্র বলল।
শুনে হাসলো সবিতা।হাসলে প‍রে অমরেন্দ্র বলল,"তোমার এই হাসি নিয়ে একটা গল্প লিখবো। একটা গল্প লিখবো।"
সবিতা বলল,"লিখুন!লিখে আমার প্রিয় সাহিত্যিক হয়ে উঠুন।"
"আমি সাহিত্যিক হলে তুমি খুশি হবে তো?"
"খুব খুব খুশি হবো।আমার মতো পৃথিবীতে কেউ খুশি হবেনা।"
"সত‍্যি?"
"সত্যি।"
"সত্যি?"
"সত্যি।"দু'জনে একসঙ্গে হাসলো।অমরেন্দ্রর মুখ থেকে তখন বেরিয়ে গেল,"সবিতা?"
"বলুন!"
"আই লাইক ইউ।"
"আই লাইক ইউ টু।"সবিতাও বলল।
অমরেন্দ্র বলল,"রাত্রি ন'টার পরে ফোন করবো। কথা আছে।ফোনে তখন পাবো তো?"
সবিতা বলল,"পাবেন।"
"ওকে।"

তিন

ফোনে অনেকটা সময় চলে গেল বলে অমরেন্দ্র আজ আর গল্প পাঠ করল না।সবিতার স্বপ্নটা নিয়ে শুধু আলোচনা করল।আলোচনা শুনে অন্যরা বলল,"দাদা,মেয়েটা আপনার কে হয়?"
"আমার কেউ হয়না।আমার বোনের বান্ধবী হয়।"
"মেয়েটা দেখতে?"
"ভালো।হঠাৎ দেখলে মোনালিসা ছাড়া কেউ বলবে না।"
"মেয়েটা আইবড় তো?"
"আইবড়।"
"তাহলে এক কাজ করুন দাদা,মেয়েটাকে আপনি ধরে বেঁধে ফেলুন!শক্ত করে ধরে বেঁধে ফেলুন!"
অমরেন্দ্র হাসলো শুনে।এইজন্যই তো সে রাত্রি ন'টার পরে ফোন করবে বলল।এহেন স্বপ্ন দেখে যে মেয়ে তাকে যে শক্ত করে ধরে বেঁধে ফেলতেই হবে।ধরে বেঁধে ফেলতেই হবে।


চিঠি


শ্রাবন কয়াল




কল্যাণীয়াষু!
                  নীলাঞ্জনা তোমার প্রথম পত্র পেয়েছিলাম  সেই নব যৌবন প্রারম্ভে।তুমি তোমার নরম হাতে উষ্ণ মনের মাধুরী মিশিয়ে  আমাকে একখানি পত্র পেরণ করেছিলে।সেই পত্রতে তুমি জানতে চেয়েছিলে---"প্রিয়তমা এ নব যৌবনা তোমার যৌবন অরণ্যে মন হারিয়েছে।এ যৌবনা তোমার যৌবন সরোবরে পদ্ম হয়ে বিকশিত হতে চাই।আমার মনতরী তোমার যৌবন সরোবরে সাঁতার দিতে চাই।তুমি কি আমার সে অধিকার টুকু দিবে?"তোমার সেদিনের সে পত্রখানি আমার মনে মণি কোঠায় জায়গা করে নিতে পারেনি।তুমি নবযৌবনা, অল্প বয়সী বলে হয়ত আমি তোমার পত্রের ও পবিত্র মনের মূল্য দিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম।নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম যন্ত্রনা সরোবরে।তুমিও রেখেছিলে।প্রতিরাতে যন্ত্রনায় বিদ্ধ হয়েছে আমার মন।তুমি মনহরিণী হয়ে বিচরণ করেছে আমার যৌবন অরণ্যে।প্রতিনিয়ত তোমাকে ধরার চেষ্টা করেছি।কিন্তু শিকারীর শিকারের ভয়ে ভীত হয়ে আমাকে অন্ধগুহায় লুকিয়ে থাকতে হয়েছে।শিকারিরা চায়না যে আমি তোমার  সঙ্গম লাভ করি।যদি বিশ্বাস করো তাহলে বলতে পারি যে তাদেরই ভয়ে তোমার পবিত্র ভালোবাসার মূল্য দিতে ব্যর্থ হয়েছি।যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে বলতে পারো আমার ভীরু মনের ব্যর্থতা।তোমার হয়ত এখনো মনে পড়ে সেদিনের সেই নবযৌবনা যুবক-যুবতীর ক্ষনিক মুহূর্ত।তুমি অশ্রুসজল চোখে জিঘাংসা করেছিলে,"তুমি আমায় ভালোবাসা?"সেদিনও নিরুত্তর ছিলাম। তাই তীব্রকন্ঠে ব্যঙ্গবান বিদ্ধ করে বলেছিলে "সৌন্দর্যের অহং তাই না?"তুমি তীব্র ভাষায় আঘাত করে শুধু নিজের যন্ত্রণা বুঝিয়ে দিয়েছিলে।কিন্তু সেদিন একটিবারও কি তোমার নয়ন দেখেছিল আমার অশ্রুরঝরা নয়নকে!সেদিন আমি কি যন্ত্রনাই না পেয়েছি।তোমাকে বোঝানোর সে ভাষা আমার নেই।ভেবেছিলে তুমি একাই শুধু ভালোবেসেছিলে তাই না!কিন্তু না এ ভীরু মনও তোমায় ভালোবেসেছিল।তফাৎ শুধু একটাই তুমি বলেছিলে আর আমি ব্যর্থ হয়েছি।কিন্তু তুমি একবারও আমার ব্যর্থ হওয়ার কারণ অনুসন্ধ্যান করলে না,দেখেছ শুধু আমার ব্যর্থতা।আজ পনেরো বছর পর তোমার পত্রের উত্তর দিতে উদ্যোগী হয়েছি।কেননা আজ আমার কোনো কিছুতেই ভয় নেই ,হারানোরও কিছু নেই।আজ আমি সব হারিয়ে নিঃস্ব আর তুমি পরিপূর্না।তুমি স্বামী ,সন্তান নিয়ে সুখের সাগরে ভেসে চলেছো।আমি দুঃখ সাগরের বুকে অন্তত কাল হেঁটে চলেছি।যদিও এর আগেও একবার তোমায় পত্রের উত্তর দেওয়ার প্রয়াস করেছি।জানি তুমি সেটা চোখেও দেখনি।যদি দেখতে তাহলে আমার সব হারানো বেদনার বেদনাটুকু থাকত না।যাই হোক পুরোনো বেদনাস্মৃতির ডালি দিয়ে তোমায় নতুন করে আঘাত করতে চাইনা।আমি চাই তুমি সুখী হও জন্ম জন্মান্তরে পতিব্রতা স্ত্রীর সৌভাগ্য অর্জন করো।তুমি আমায় ভালোবেসে ছিলে ,তাই পিতার দেখা রাজপুত্রের গলায় সহজে বরমাল্য পড়াতে পেরেছ।আমি বলতে ব্যর্থ হয়েছি তাই তোমার স্মৃতি আঁকড়ে আছি।আমি পারতাম কোনো রাজকুমারীর গলায় মাল্য দিতে।কিন্তু আমার বিবেগ আমাকে সে পাপ কাজ হতে বিরত রেখেছে।আজ তোমার পত্রের উত্তর দিয়ে তোমাকে জানাতে চাইছি আমি তোমায় ভালোবাসি,আর নবযৌবনেও বাসতাম,বাধ্যকেও বাসবো।শুধু প্রশ্ন তুমি কি আমায় সত্যি ভালোবাসেছিলে?যদি বাসতে তাহলে কি অন্যের গলে বরমাল্য দিতে পারতে?আজ তোমাকে ফিরে আসাতে বলব না।আজ পত্র পেরণ করলাম শুধু এই কথাটা বলতে "ভালোবাসিছো যারে ,প্রেমেরও বাঁধনে অনন্তকাল রেখো তারে।নাইবা সে বাসলোভালো, তুমি তো তারে বেসেছো ভালো ।তাই মৃত্যুর অন্তিম ক্ষনমুহূর্ত অপেক্ষায় থেকো যদি সে আসে ফিরে..."
                                                             ইতি
                                                    নিত্য শুভার্থী___
                                                                          শ্রাবন



দুঃস্বপ্ন

লেখক   •••  শংকর ব্রহ্ম

°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°



"   ভালবেসে যদি তুমি কষ্ট নাহি পাও

তবে সেটা ভালবাসা কিনা,

                      মনে আগে জেনে নাও। "                                                  



রাত বারটার পর শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা, নিয়েই ফেলল অধ্যাপক বিনোদ মজুমদার। 

না আর নয়।  অনেক হয়েছে। অণিমা রায় তার মেয়ের মত | তবু তাকে ছাড়া বাঁচবে না সে |

বিচার বুদ্ধি হারিয়ে, এতটা ভালবেসে ফেলেছে সে তার ছাত্রীকে ।

          রাত এখন গভীর। কুকুরগুলো ডাকতে ডাকতে ঝিমিয়ে পড়েছে। হয়তো ঘুমিয়েও পড়ছে। জেগে নেই কেউ। 

                ফ্যান থেকে ফাঁসটা ঝুলিয়ে গলায় পরানোই আছে। শুধু টুলটা একটু পা দিয়ে ঠেলে দিলেই হল। এত ভালবেসেছে অণুকে এখন তার মরণ ছাড়া আর কোন গতি নেই। 

          কৃষ্ণও তো রাধাকে ভালবেসে ছিল।রাধা সম্পর্কে কৃষ্ণের মামী হত। আর বয়সের ব্যবধানও তাদের মধ্যে খুব একটা কম ছিল না।  তাদের প্রেম নিয়ে কত অমর কাব্য লেখা হয়েছে যুগে যুগে। তাদেরটা ছিল লীলা।  আর আমি মেয়ের বয়সী কারও সাথে প্রেম করলে সেটা 

হয়ে যায় বিলা। মনে মনে ভাবল সে। কি বিচার এই পঙ্গু সমাজ ব্যবস্থার।

টুলটা পায়ের ধাক্কায় ঠেলে দেবে এমন সময় আচমকা ঘরে ঢুকল কে যেন। চমকে উঠল সে। 

_  কে ?

_  আমি তোমার বিবেক 

_  কি চাই তোমার ?  কেন  এসেছো এখানে?

_  তোমাকে সাহায্য করতে

_  কি ভাবে ?

_   টুলটা আমি সরিয়ে নিচ্ছি, তোমার আর কষ্ট করে টুলটা সরাতে হবে না।

_  না   না   না  

     চেচিয়ে  উঠল বিনোদ। 

  অণু আমাকে এবারের মত বাঁচাও |  

  বাঁচাও প্লীজ  •••

_   কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। 

 অণিমা এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কাল সকালে উঠে খবরটা শুনবে।  

কিম্বা খবরের কাগজের হেড লাইনে দেখবে

--একটি আত্মহত্যা আর অনেক জল্পনা--     

আঁতকে উঠল সে | হঠাৎ তার ঘুমটা ভেঙে

 গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ। সারা শরীর ঘামে ভিজে,চপচপ করছে। বিছানা ছেড়ে উঠে এসে,এক বোতল জল ঢকঢক করে খেল সে।

জীবনে বাঁচার যে এত স্বাদ, এত আনন্দ বিনোদ আগে আর কখনো টের পায়নি। সারারাত সে আর ঘুমতে পারল না।





Comments

Popular posts from this blog

অপরাজিত -৯

অপরাজিত ১০

অপরাজিত ৮