গল্পের গাছ
মন পলাশী
সুনন্দ মন্ডল
মদন তার মায়ের একমাত্র অবলম্বন। বাবা অনেক কাল আগেই গত হয়েছেন। মায়া দেবীর একান্ত ইচ্ছা ছিল ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। লেখাপড়া শিখিয়ে দশজনের একজন করে তুলবেন। তার জন্য সম্পত্তির একাংশ হাতছাড়া করতেও রাজি তিনি। বিশাল সম্পত্তির ভাগীদার কেবল মদন। কিন্তু পড়াশোনায় তার মন একেবারেই নেই। বছর বছর ফেল করতো সে। অন্য বন্ধুদের থেকে পিছিয়ে গেল। মাধ্যমিকটা কোনরকমে পাস করেই ইতি টানলো পড়ায়।
এখন মদন সম্পত্তি দেখাশোনা করে। যে পরিমান জমি আছে তার চাষবাস থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ করতে শুরু করল। নিজেও মাঠে গিয়ে কতদিন কৃষকের সাথে হাতে হাতে কাজ করেছে। এতে তার বিন্দুমাত্র কষ্ট নেই। যত কষ্ট পড়ায়। তাই বেখেয়ালি জীবনে বাড়ির কাজই বেছে নিয়েছে মদন।
মদন যখন ২৬ এ পা দিলো মায়ের চিন্তা বেড়ে গেল। একমাত্র ছেলে, ভেবেছিল শিক্ষিত বউ ঘরে নিয়ে আসবে। কিন্তু অশিক্ষিত ছেলেকে কে বিয়ে করবে? তবু বিয়ে তো দিতেই হবে! তাই শুরু হলো পাত্রী খোঁজা। মনের মতো পাত্রী চায় মায়া দেবীর। ঘটকের হাত ধরে মিলেও গেল তেমন একখানা মেয়ে। দেখতে বেশ ফর্সা। তবে শরীরটা রোগাটে। যাইহোক চলবে এমন বউ। বাড়িতে মানাবে। ছেলের পছন্দ হলে হয় এখন।
ছেলে দেখতে গেল মেয়েকে। দেখেই পছন্দ হলো। অপছন্দ হবে তেমন মেয়ে রিতা ছিলো না। তবে রিতার পছন্দ কি না কেউ তেমন জানতে চাইল না! উভয়পক্ষের অভিভাবকদের আলোচনায় ও লেনদেন প্রথায় বিয়ে ঠিক হলো। পনপ্রথা যে উঠে গেছে একেবারেই তা নয়। তাই মেয়ের বাবা যৎসামান্য সাধ্য মতো কিছু দিলেন-থুলেন। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল মদন ও রিতার।
ছেলে বউ নিয়ে ঘরের চৌকাঠে পা রেখেছে। মায়া দেবী বরণ করে নিলেন বৌমাকে। ঘৃহের বাকি লৌকিক আচার সম্পন্ন করে নিজের ঘর বলতে স্বামীর ঘরে ঢুকল রিতা। যথারীতি কালরাত্রি পালন করা হলো। এগিয়ে এলো ফুলশয্যা। সমস্ত ঘরে ফুলের গন্ধে ভরিয়ে দেওয়া হলো। নতুন বউ হয়তো অপেক্ষায় স্বামীর। লালচেলি, বেনারসি, গয়না পড়ে চুপচাপ বসে বাবা-মায়ের কথাও ভাবছে। চোখে জল সবকিছু ছেড়ে আসতে হয়েছে তাই। মদন ঘরে ঢুকল। দরজা বন্ধ করতেই চমকে উঠলো রিতা।
মদন রিতার পাশে বসল। রিতাকে দেখে আসার পর একেবারে বিয়ে। তেমন কিছু ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি নিজেদের। তাই মদন জিজ্ঞেস করল,"আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?" রিতা একটু চুপ থেকে সরাসরি উত্তর দিলো,"না!" মদন কথাটা শুনেই চমকে গেল। সে মনে মনে ভাবল, "কেই বা পছন্দ করবে আমাকে। অশিক্ষিত, মোটা, কালো চামড়ার মূর্খ কে!"
কেউ আর কোনো কথা বলল না। দুজনেই উল্টোমুখ করে বসে সারারাত কাটিয়ে দিল। সকাল হলো। পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করেছে। জানালায় রোদ এসে পড়েছে। মদন শেষবারের মতো জানতে চাইল,"রিতা, তুমি আমার সাথে ঘর করতে চাও?" রিতা মদনের দিকে লজ্জিত ভাবে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। শেষে উত্তর দিলো,"আমি আপনার সাথে থাকতে চাই না। বাবা-মা জোর করে আমার বিয়ে দিয়েছেন।" ঠিক আছে তাহলে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে লাভ নেই বলে মদন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। রিতা কাঁদতে লাগল বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে।
মদন কোথা থেকে এসে রিতাকে তৈরি হতে বলল। বাপের বাড়িতে রেখে আর নিয়ে ফিরবে না প্রতিশ্রুতি দিলো। কথামতো রিতা চৌকাঠ পেরিয়ে বাপের ঘরে গেল। একদিন কাটিয়ে মদন নিজের ঘরে ফিরল। মাকে সব ঘটনা জানালো। মায়াদেবী তো অবাক হয়ে গেলেন ছেলের কথা শুনে। কিন্তু চুপ থাকলেন না। কথা বললেন মেয়ের বাড়ির লোকের সাথে। আলাদা করে মেয়ের সাথেও কথা বলে জানলেন, মদনকে কোনদিক দিয়েই পছন্দ নয় তার।
মায়াদেবী হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। ছেলের দিকেও তাকানো যায় না। এ ঘটনা অত্যন্ত বিরল। বেছে বেছে মদনের ভাগ্যেই এই ঘটল! আক্ষেপ করলেন মায়াদেবী। মদন মাকে সান্ত্বনা দিলেন জীবনে যা হবার তা হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না। জীবনে যা লেখা আছে হবে। তবুও মা মায়াদেবী মানতে নারাজ। তিনি আবার গেলেন রিতাদের বাড়ি। অপমানিত হয়ে ফিরলেন।
মদন এবার চাকরির চেষ্টা করতে লাগল। যতইহোক মাধ্যমিক পাস করেছে। সেই যোগ্যতায় কোনো না কোনো কাজ মিলবেই। যথারীতি পড়াশোনা শুরু হলো। নানারকম পরীক্ষায় বসতে লাগল মদন। প্রথম প্রথম পাস করতে পারত না। একবার পাস করল কিন্তু ইন্টারভিউয়ে বাদ। এভাবেই পরীক্ষা দিয়েই যায় আর ইন্টারভিউয়ে বাদ পরে।
একদিন বিয়ের জন্য যোগাযোগ এলো পাশের গ্রাম থেকেই। মেয়ে খুব ফর্সা নয়। তবে গৃহিণী হিসাবে মানাবে। মায়াদেবী বললেন, "ঘটক মশাই, এই ছবিটা দেখাবেন ওদের। যদি আমার ছেলেকে পছন্দ হয় তবেই সম্বন্ধ করতে বলবেন।" সেইমতো কাজ করল ঘটক। পছন্দ হলো মদনের ছবি। সম্বন্ধ হলো, লেনদেন ঠিক হলো। বিয়েও হলো। ঘরে এলো নতুন বউ নন্দিতা।
আবার ফুলশয্যা মদনের জীবনে। কিন্তু নন্দিতা জানে না আগের ঘটনা। তাই মদন নন্দিতাকে সব বলল। এমনকি পছন্দ কিনা জানতে চাইলে নন্দিতা চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকল। মদন ভেবে নিলো মৌনতায় সম্মতির লক্ষণ। দুজনেই নতুন জীবনে পা রাখল।
মদন আর নন্দিতা যেন একে অপরের সৃষ্টি। এদের আগেই কেন বিয়ে হলো না! তাহলে রিতার দীর্ঘশ্বাস গায়ের উপর নিতে হতো না মদনকে। এতদিনে মদন মন-পলাশীর সন্ধান পেল। নন্দিতাও আসল গৃহিণী হয়ে উঠল। মদনকে সে খুব ভালোবাসে। মায়াদেবীর যত্ন করে। ঘরের কাজ সামলাতে শেখে। বাকি যে সময়টুকু থাকে সে সময়ে টিউশন পড়ায়। ছোট ছোট বাচ্চারা পড়তে আসতো।
মদনও গ্রামেই সাম্প্রতিক গজে ওঠা একটা বেসরকারি স্কুলে যোগ দিল। নিয়মিত সেই স্কুলে শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক ও চর্চায় নিজেকে ঘষে মেজে প্রস্তুত করল। সরকারি চাকরীর চেষ্টা তো আছেই। একদিন খবর এলো চাকরির সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। মাধ্যমিক স্কুলের গ্রুপ ডি পোস্ট। যাইহোক চাকরি তো! নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতায় কিছু একটা পেয়ে দেখালো মদন।
সকলেই খুশি। মায়াদেবী প্রসন্ন চিত্তে ছেলেকে মিষ্টি খাওয়ালেন। নন্দিতাও ভালোবেসে খুশির চুমু এঁকে দিলো গালে। সেইসঙ্গে জানালো, "আমি গর্ভবতী। তুমি বাবা হতে চলেছ।" মদন খুশির পর খুশির খবর পেয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। আনন্দে নন্দিতাকে কোলে তুলে নিয়ে পাকে পাকে ঘুরতে লাগল।
কিছুদিন পরে নতুন চাকরিতে যোগ দিতে গেল মদন। রাস্তায় দেখা হলো রিতার সাথে। কথাও হলো তাদের। ততদিনেও রিতার হাতে মাথায় বিয়ের কোনো চিহ্ন দেখতে পেলো না মদন। রিতা জানতে পারল মদন চাকরি পেয়েছে। মদনের তাড়া ছিল তাই রিতাকে বিদায় জানালো। মদন চলে যাবার সময় রিতার চোখে জল লক্ষ্য করল।
মনোজের সংসার
আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
বাড়ি থেকে বেরোলেই পুলিশ তাকে ধরে আচ্ছা করে পেটাচ্ছে।ভয়ে বাড়ি থেকে কেউ বেরোতে পারছেনা।ফলে গরিব মানুষ গুলোর হয়েছে যত বিপদ।বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন খায় মানুষ।শরীর যাদের সম্পদ।অর্থাৎ খাটলে যারা খেতে পায়।না খাটলে যারা খেতে পায়না।মনোজ হল সেরকমই একজন মানুষ। গ্রামে গরিব মানুষ বহু আছে।কিন্তু তার মতো অধীন গরিব কেউ নেই।কেননা তাদের অন্তত নিজস্ব ভিটা মাটি টুকু আছে।মাঠান হয়তো দশ বিঘা জমি নেই।ব্যাঙ্কে হয়তো দশ লাখ টাকা নেই।কিন্তু মাথার উপর প্রত্যেকের ছাদ আছে। মনোজের যে সেটুকুও নেই।গ্রামের বাইরে মাঠের ধারে সরকারের খাস জমির উপর তালপাতার একটা ছোট্ট কুঁড়ে করে সেখানে বাস করে। আকাশে মেঘ দেখলে ভয়ে তার জান শুকিয়ে যায়।যদি নিষ্ঠুর মেঘ ঝড় কিছু একটা করে বসে।
প্রকৃতির নিয়মে মনোজের চার সন্তান। মনোজের মতো ভূমিহীন মানুষের চার সন্তান হওয়া মানে বর্তমানে সেটা একটা সামাজিক অপরাধের মধ্যেই পড়ে।যদিও বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে মনোজকে অতগুলো বাচ্চা নিতে হয়েছে।কিন্তু মানুষ তো সেটা বুঝবে না।মানুষ বলবে ওটা একটা সামাজিক অপরাধ।
দুই
মনোজের প্রথম সন্তান একটা কন্যা সন্তান হলে তার স্ত্রী শুকতারার একটা পুত্র সন্তানের শখ হয়।স্ত্রীর শখ মেটাতে গিয়ে মনোজকে আবার বাচ্চা নিতে হয়।কিন্তু সেটা পুত্র সন্তান না হয়ে আবার একটা কন্যা সন্তান হয়।মনোজ তখন মনস্থির করে যে,আর কোনো সন্তান নয়।স্ত্রীর শখ হলেও আর নয়।কেননা গরিবের সংসার।গরিবের সংসারে দুটোই বেশি।এরপর তিনটে হলে খুব বেশি হয়ে যাবে।লোকেও নিন্দা করবে।তাছাড়া অধিক সন্তান নিয়ে মানুষ করাও আজকাল খুব কষ্টের।আচ্ছা আচ্ছা বড়লোক যারা তারাই তো একটা-দুটোর বেশি বাচ্চা নিচ্ছে না।তাহলে সে নিতে যাবে কোন দুঃখে!না,সে-ও আর নেবেনা। নিয়ে বাড়িতে শুধু বকরির পাল করে রাখলে তো হবেনা।তাদের মানুষ করতে হবে।সঠিকভাবে খেতে পরতে দিতে হবে।লেখাপড়া শেখাতে হবে। তবেই তো সন্তান বড় হয়ে বাবার নাম করবে।আর তখনই হবে সন্তান নেওয়ার সার্থকতা।তাছাড়া কোনো সার্থকতা নেই।
কিন্তু শুকতারা শোনেনা সেকথা।সে আবার বাচ্চা নিতে চায়।আর মনোজ চায়না।এই নিয়ে তাদের দু-জনের মধ্যে ঝামেলা হয়।হলে শুকতারা তার বাপের বাড়ি চলে যায়।নিজে রান্না করে খেতে মনোজের তখন খুব কষ্ট হয়।ফলে শুকতারাকে সে আনতে যায়।কিন্তু শুকতারা আসতে চায়না।সে পরিষ্কার ভাষায় বলে দেয় যে,আবার বাচ্চা নিলে তবেই সে আসবে।না নিলে আসবে না।
বাধ্য হয়ে মনোজকে তখন বলতেই হয়,"আবার বাচ্চা নেবো চল।"
শুকতারা এবার মনোজের সঙ্গে বাড়ি চলে আসে।কিন্তু নিয়তির কি খেলা!সেটাও একটা কন্যা সন্তান হয়।এরপর চার বারের বেলায় বাচ্চা নেওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে আবার গণ্ডগোল হয়। শুকতারা আবার বাপের বাড়ি চলে যায়।মনোজ তাকে আবার ধরে আনে।আনলে পরে তাদের এবার একটা পুত্র সন্তান হয়।শুকতারার তো একটা পুত্র সন্তানেরই শখ ছিল।তার শখ পূরণ হয়।এরপর তারা আর কোনো বাচ্চা নেয়না। নেয়না তো নেয়না।দিদিমণিদের কন্ডোম আর বড়ি ব্যবহার করে বন্ধ করে রেখেছে।
তিন
পেশায় মনোজ ভ্যান চালক।ভ্যান চালিয়ে তার সংসার চলে।স্ত্রী সন্তানদের প্রতিপালন করে। হঠাৎ লকডাউন শুরু হয়ে সে এখন ভীষণ বিপদে পড়ে গেছে।এক টাকা রোজগার নেই।ভ্যানটা নিয়ে যে কোথাও বেরোবে সে উপায়ও নেই।পুলিশ গ্রামের দিকেও চলে আসছে।এবং এসে যদি বাড়ির বাইরে কাউকে দেখছে তো তার আর রক্ষে নেই।এমতাবস্থায় বাইরে বেরোনো যে সমীচীন নয় মনোজ সেটা বেশ ভালো করেই জানে।বেরিয়ে যে কাজ হবেনা সেটাও জানে।তবু মনোজের মন মানল না।ভ্যান নিয়ে সে একদিন বেরিয়ে গেল।
চার
গিয়ে মোড়ে সে যেই দাঁড়িয়েছে অমনি একটা পুলিশের গাড়ি চলে এল।গাড়ি থেকে দুটো পুলিশ নামলো।পুলিশ দুটো নামতে দেখে মনোজ দৌড়ে পালাতে লাগল।নাহলে তাকে যদি এসে খপ করে ধরে ফেলে!
পুলিশ দুটোও তার পিছু ধাওয়া করল,"এই দাঁড়া বলছি,দাঁড়া বলছি,দাঁড়া বলছি এখনো।..."
কিন্তু মনোজ দাঁড়ালো না।দৌড়াতে দৌড়াতে সে মাঠে নেমে পড়ল।পুলিশ দুটো তখন দাঁড়িয়ে গেল।মাঠে নামলো না।রাতে বৃষ্টি হয়েছে।মাঠে যে এখন কাদা।ইউনিফর্মে যে তাহলে কাদা লেগে যাবে।কিন্তু তারা বলতে ছাড়লো না,"শালা,বেঁচে গেলি যা।ধরতে পারলে আজ তোর যা করতাম ভালোই করতাম।"
পাঁচ
পুলিশের মার খুব সাংঘাতিক।পুলিশের মার যে একবার খেয়েছে সে কাল-গু হেগে মরেছে। অতএব মনোজ দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠের মধ্যে পালিয়ে গেল।যাতে এতদূর পর্যন্ত পুলিশ তাকে ধরতে আবার তেড়ে না আসে।এবং সেখানে গিয়ে সে ভিজে মাটিতে পা পিছলে পড়ে গেল।"আ:,মরেছি গো!"মনোজের মুখ থেকে তখন আপনি আর্ত চিৎকারটি বেরিয়ে গেল।কিন্তু মনোজ তখন উঠল না।পড়ে পড়ে সে ভাবতে লাগল,সে যদি এখন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যেত তাহলে তার কি যে হতো!কি যে হতো!সে মারতে নিষেধ করলেও শুনত না।মারতই।মারতে মারতে তাকে আধমরা করে তবে ছাড়ত।যাক,পুলিশের হাতে যে ধরা পড়েনি সেটা তার ভাগ্য।
ছয়
মনোজ এবার মাঠ থেকে উঠে বাড়ি চলে আসবে।তার আগে সে মাঠের চারদিকটা একবার তাকিয়ে দেখল।না,মাঠে কোনো জনমানুষ নেই। কোনো জনমানুষ নেই।মাঠে কোনো জনমানুষ দেখতে না পেলেও মনোজ তার পায়ের কাছে একটা জিনিস দেখতে পেল।চকচকে একটা জিনিস।জিনিসটার সামান্য অংশ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পুরোটাই নরম কাদার তলায় পুঁতে রয়েছে। জিনিসটা যে কি জিনিস সেটা দেখতে হলে কাদার তলা থেকে জিনিসটাকে উপরে তুলে আনতে হবে।অতএব মনোজ দুই হাত দিয়ে জায়গাটার কাদা সরাতে লাগল।সরাতে সরাতে জিনিসটা একসময় তার হাতে চলে এল।এলে পরে মনোজ সেটা গামছায় জড়িয়ে বাড়ি নিয়ে চলে এল।ঠিক যেভাবে ছেলেরা খালে বিলে মাছ ধরে সেই মাছ গামছায় করে জড়িয়ে বাড়ি নিয়ে আসে।
সাত
মনোজ বাড়ি এলে পরে শুকতারা তার দিকে তাকালো।তাকিয়ে প্রশ্ন করল,"তুমি কি মাছ ধরে আনলে?"
মনোজ বলল,"না।"
"তাহলে মাছ ধরার মতো তোমার হাতে পায়ে এত কাদা কেন?"
"এমনি।"
"গামছায় কি তাহলে?"
মনোজ বলল,"একটা জিনিস আছে।"
শুকতারা জিজ্ঞেস করল,"কি জিনিস আছে?"
মনোজ বলল,"পুকুর থেকে আগে হাত পায়ের কাদা ধুয়ে আসি।তারপর বলছি।"মনোজ পুকুর থেকে হাত পায়ের কাদা ধুয়ে এসে বলল,"বালতিতে জল আছে?"
শুকতারা বলল,"আছে।"
মনোজ তখন গামছার বাঁধনটা আলগা করে দিয়ে সেই চকচকে জিনিসটা বালতির জলে ডুবিয়ে দিল।দেওয়ার পর বলল,"ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে জিনিসটা জল থেকে তোল।কাদা লেগে থাকেনা।"
শুকতারা তাই করল।করলে পরে মনোজ বলল,"কি জিনিস এবার দ্যাখ!"
শুকতারা জিনিসটা দেখে বলল,"এ যে খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি দুর্গা ঠাকুরের মূর্তি গো!তুমি কোথায় পেলে?এর যে অনেক টাকা দাম!অনেক অনেক টাকা দাম!"
মনোজ এবার ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে বলল,"আস্তে!"
খুব আস্তে এবং নিচু গলায় শুকতারা তখন বলল,"কোথায় পেলে?"
মনোজ বলল,"কুড়িয়ে পেলাম।"
"কোথায় কুড়িয়ে পেলে?"
"মাঠে।"
"মাঠে তুমি কি করতে গিয়েছিলে?"
পুরো ঘটনাটা মনোজ তখন শুকতারাকে খুলে বলল।কিছু গোপন করল না।
ঘটনার বিশদ বর্ণনা শুনে শুকতারা তখন বুঝে নিল যে,এটা দুর্গা ঠাকুরের একান্ত আশীর্বাদ।তার আশীর্বাদ ভিন্ন এতবড় প্রাপ্তি কখনোই সম্ভব নয়। অতএব সে আর দেরি করল না।তক্ষুনি দুর্গা ঠাকুরের স্মরণ করল।করে বলল,"তোমাকে ধন্যবাদ ঠাকুর,তোমাকে ধন্যবাদ।অনেক অনেক ধন্যবাদ।"শুধু শুকতারা নয়,মনোজও স্মরণ করল।অত:পর মনোজের সংসারে সুখ হবে। জীবনের দৈন্যতা দূর হবে।হবেই হবে।
আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
বাড়ি থেকে বেরোলেই পুলিশ তাকে ধরে আচ্ছা করে পেটাচ্ছে।ভয়ে বাড়ি থেকে কেউ বেরোতে পারছেনা।ফলে গরিব মানুষ গুলোর হয়েছে যত বিপদ।বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন খায় মানুষ।শরীর যাদের সম্পদ।অর্থাৎ খাটলে যারা খেতে পায়।না খাটলে যারা খেতে পায়না।মনোজ হল সেরকমই একজন মানুষ। গ্রামে গরিব মানুষ বহু আছে।কিন্তু তার মতো অধীন গরিব কেউ নেই।কেননা তাদের অন্তত নিজস্ব ভিটা মাটি টুকু আছে।মাঠান হয়তো দশ বিঘা জমি নেই।ব্যাঙ্কে হয়তো দশ লাখ টাকা নেই।কিন্তু মাথার উপর প্রত্যেকের ছাদ আছে। মনোজের যে সেটুকুও নেই।গ্রামের বাইরে মাঠের ধারে সরকারের খাস জমির উপর তালপাতার একটা ছোট্ট কুঁড়ে করে সেখানে বাস করে। আকাশে মেঘ দেখলে ভয়ে তার জান শুকিয়ে যায়।যদি নিষ্ঠুর মেঘ ঝড় কিছু একটা করে বসে।
প্রকৃতির নিয়মে মনোজের চার সন্তান। মনোজের মতো ভূমিহীন মানুষের চার সন্তান হওয়া মানে বর্তমানে সেটা একটা সামাজিক অপরাধের মধ্যেই পড়ে।যদিও বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে মনোজকে অতগুলো বাচ্চা নিতে হয়েছে।কিন্তু মানুষ তো সেটা বুঝবে না।মানুষ বলবে ওটা একটা সামাজিক অপরাধ।
দুই
মনোজের প্রথম সন্তান একটা কন্যা সন্তান হলে তার স্ত্রী শুকতারার একটা পুত্র সন্তানের শখ হয়।স্ত্রীর শখ মেটাতে গিয়ে মনোজকে আবার বাচ্চা নিতে হয়।কিন্তু সেটা পুত্র সন্তান না হয়ে আবার একটা কন্যা সন্তান হয়।মনোজ তখন মনস্থির করে যে,আর কোনো সন্তান নয়।স্ত্রীর শখ হলেও আর নয়।কেননা গরিবের সংসার।গরিবের সংসারে দুটোই বেশি।এরপর তিনটে হলে খুব বেশি হয়ে যাবে।লোকেও নিন্দা করবে।তাছাড়া অধিক সন্তান নিয়ে মানুষ করাও আজকাল খুব কষ্টের।আচ্ছা আচ্ছা বড়লোক যারা তারাই তো একটা-দুটোর বেশি বাচ্চা নিচ্ছে না।তাহলে সে নিতে যাবে কোন দুঃখে!না,সে-ও আর নেবেনা। নিয়ে বাড়িতে শুধু বকরির পাল করে রাখলে তো হবেনা।তাদের মানুষ করতে হবে।সঠিকভাবে খেতে পরতে দিতে হবে।লেখাপড়া শেখাতে হবে। তবেই তো সন্তান বড় হয়ে বাবার নাম করবে।আর তখনই হবে সন্তান নেওয়ার সার্থকতা।তাছাড়া কোনো সার্থকতা নেই।
কিন্তু শুকতারা শোনেনা সেকথা।সে আবার বাচ্চা নিতে চায়।আর মনোজ চায়না।এই নিয়ে তাদের দু-জনের মধ্যে ঝামেলা হয়।হলে শুকতারা তার বাপের বাড়ি চলে যায়।নিজে রান্না করে খেতে মনোজের তখন খুব কষ্ট হয়।ফলে শুকতারাকে সে আনতে যায়।কিন্তু শুকতারা আসতে চায়না।সে পরিষ্কার ভাষায় বলে দেয় যে,আবার বাচ্চা নিলে তবেই সে আসবে।না নিলে আসবে না।
বাধ্য হয়ে মনোজকে তখন বলতেই হয়,"আবার বাচ্চা নেবো চল।"
শুকতারা এবার মনোজের সঙ্গে বাড়ি চলে আসে।কিন্তু নিয়তির কি খেলা!সেটাও একটা কন্যা সন্তান হয়।এরপর চার বারের বেলায় বাচ্চা নেওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে আবার গণ্ডগোল হয়। শুকতারা আবার বাপের বাড়ি চলে যায়।মনোজ তাকে আবার ধরে আনে।আনলে পরে তাদের এবার একটা পুত্র সন্তান হয়।শুকতারার তো একটা পুত্র সন্তানেরই শখ ছিল।তার শখ পূরণ হয়।এরপর তারা আর কোনো বাচ্চা নেয়না। নেয়না তো নেয়না।দিদিমণিদের কন্ডোম আর বড়ি ব্যবহার করে বন্ধ করে রেখেছে।
তিন
পেশায় মনোজ ভ্যান চালক।ভ্যান চালিয়ে তার সংসার চলে।স্ত্রী সন্তানদের প্রতিপালন করে। হঠাৎ লকডাউন শুরু হয়ে সে এখন ভীষণ বিপদে পড়ে গেছে।এক টাকা রোজগার নেই।ভ্যানটা নিয়ে যে কোথাও বেরোবে সে উপায়ও নেই।পুলিশ গ্রামের দিকেও চলে আসছে।এবং এসে যদি বাড়ির বাইরে কাউকে দেখছে তো তার আর রক্ষে নেই।এমতাবস্থায় বাইরে বেরোনো যে সমীচীন নয় মনোজ সেটা বেশ ভালো করেই জানে।বেরিয়ে যে কাজ হবেনা সেটাও জানে।তবু মনোজের মন মানল না।ভ্যান নিয়ে সে একদিন বেরিয়ে গেল।
চার
গিয়ে মোড়ে সে যেই দাঁড়িয়েছে অমনি একটা পুলিশের গাড়ি চলে এল।গাড়ি থেকে দুটো পুলিশ নামলো।পুলিশ দুটো নামতে দেখে মনোজ দৌড়ে পালাতে লাগল।নাহলে তাকে যদি এসে খপ করে ধরে ফেলে!
পুলিশ দুটোও তার পিছু ধাওয়া করল,"এই দাঁড়া বলছি,দাঁড়া বলছি,দাঁড়া বলছি এখনো।..."
কিন্তু মনোজ দাঁড়ালো না।দৌড়াতে দৌড়াতে সে মাঠে নেমে পড়ল।পুলিশ দুটো তখন দাঁড়িয়ে গেল।মাঠে নামলো না।রাতে বৃষ্টি হয়েছে।মাঠে যে এখন কাদা।ইউনিফর্মে যে তাহলে কাদা লেগে যাবে।কিন্তু তারা বলতে ছাড়লো না,"শালা,বেঁচে গেলি যা।ধরতে পারলে আজ তোর যা করতাম ভালোই করতাম।"
পুলিশের মার খুব সাংঘাতিক।পুলিশের মার যে একবার খেয়েছে সে কাল-গু হেগে মরেছে। অতএব মনোজ দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠের মধ্যে পালিয়ে গেল।যাতে এতদূর পর্যন্ত পুলিশ তাকে ধরতে আবার তেড়ে না আসে।এবং সেখানে গিয়ে সে ভিজে মাটিতে পা পিছলে পড়ে গেল।"আ:,মরেছি গো!"মনোজের মুখ থেকে তখন আপনি আর্ত চিৎকারটি বেরিয়ে গেল।কিন্তু মনোজ তখন উঠল না।পড়ে পড়ে সে ভাবতে লাগল,সে যদি এখন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যেত তাহলে তার কি যে হতো!কি যে হতো!সে মারতে নিষেধ করলেও শুনত না।মারতই।মারতে মারতে তাকে আধমরা করে তবে ছাড়ত।যাক,পুলিশের হাতে যে ধরা পড়েনি সেটা তার ভাগ্য।
মনোজ এবার মাঠ থেকে উঠে বাড়ি চলে আসবে।তার আগে সে মাঠের চারদিকটা একবার তাকিয়ে দেখল।না,মাঠে কোনো জনমানুষ নেই। কোনো জনমানুষ নেই।মাঠে কোনো জনমানুষ দেখতে না পেলেও মনোজ তার পায়ের কাছে একটা জিনিস দেখতে পেল।চকচকে একটা জিনিস।জিনিসটার সামান্য অংশ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পুরোটাই নরম কাদার তলায় পুঁতে রয়েছে। জিনিসটা যে কি জিনিস সেটা দেখতে হলে কাদার তলা থেকে জিনিসটাকে উপরে তুলে আনতে হবে।অতএব মনোজ দুই হাত দিয়ে জায়গাটার কাদা সরাতে লাগল।সরাতে সরাতে জিনিসটা একসময় তার হাতে চলে এল।এলে পরে মনোজ সেটা গামছায় জড়িয়ে বাড়ি নিয়ে চলে এল।ঠিক যেভাবে ছেলেরা খালে বিলে মাছ ধরে সেই মাছ গামছায় করে জড়িয়ে বাড়ি নিয়ে আসে।
মনোজ বাড়ি এলে পরে শুকতারা তার দিকে তাকালো।তাকিয়ে প্রশ্ন করল,"তুমি কি মাছ ধরে আনলে?"
মনোজ বলল,"না।"
"তাহলে মাছ ধরার মতো তোমার হাতে পায়ে এত কাদা কেন?"
"এমনি।"
"গামছায় কি তাহলে?"
মনোজ বলল,"একটা জিনিস আছে।"
শুকতারা জিজ্ঞেস করল,"কি জিনিস আছে?"
মনোজ বলল,"পুকুর থেকে আগে হাত পায়ের কাদা ধুয়ে আসি।তারপর বলছি।"মনোজ পুকুর থেকে হাত পায়ের কাদা ধুয়ে এসে বলল,"বালতিতে জল আছে?"
শুকতারা বলল,"আছে।"
মনোজ তখন গামছার বাঁধনটা আলগা করে দিয়ে সেই চকচকে জিনিসটা বালতির জলে ডুবিয়ে দিল।দেওয়ার পর বলল,"ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে জিনিসটা জল থেকে তোল।কাদা লেগে থাকেনা।"
শুকতারা তাই করল।করলে পরে মনোজ বলল,"কি জিনিস এবার দ্যাখ!"
শুকতারা জিনিসটা দেখে বলল,"এ যে খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি দুর্গা ঠাকুরের মূর্তি গো!তুমি কোথায় পেলে?এর যে অনেক টাকা দাম!অনেক অনেক টাকা দাম!"
মনোজ এবার ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে বলল,"আস্তে!"
খুব আস্তে এবং নিচু গলায় শুকতারা তখন বলল,"কোথায় পেলে?"
মনোজ বলল,"কুড়িয়ে পেলাম।"
"কোথায় কুড়িয়ে পেলে?"
"মাঠে।"
"মাঠে তুমি কি করতে গিয়েছিলে?"
পুরো ঘটনাটা মনোজ তখন শুকতারাকে খুলে বলল।কিছু গোপন করল না।
ঘটনার বিশদ বর্ণনা শুনে শুকতারা তখন বুঝে নিল যে,এটা দুর্গা ঠাকুরের একান্ত আশীর্বাদ।তার আশীর্বাদ ভিন্ন এতবড় প্রাপ্তি কখনোই সম্ভব নয়। অতএব সে আর দেরি করল না।তক্ষুনি দুর্গা ঠাকুরের স্মরণ করল।করে বলল,"তোমাকে ধন্যবাদ ঠাকুর,তোমাকে ধন্যবাদ।অনেক অনেক ধন্যবাদ।"শুধু শুকতারা নয়,মনোজও স্মরণ করল।অত:পর মনোজের সংসারে সুখ হবে। জীবনের দৈন্যতা দূর হবে।হবেই হবে।
নাগা মরিচ
মৌসুমী বিশ্বাস
ধীরেন দার বাগানে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম । কত রকমের গাছ ! আলু থেকে শুরু করে কাঁচা লংকা ; কাঁচা লংকা আবার কত রকমের । সব লংকার নামও জানি না ।
ধীরেন দা কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম; কোনো টার নাম বোতাম লংকা , কোনো টার নাম দার্জিলিং লংকা , সূর্য মুখী লংকা । আবার কোনো টার নাম নাগা মরিচ , বোম্বাই মরিচ ।
এতো ধরনের লংকা গাছ দেখে তো আমার চক্ষু চরক গাছ !
আমাকে অবাক হতে দেখে ধীরেন দা বলল -- দেখে ছিস কোনো দিন নাগা মরিচ !
আমি বললাম -- না ; এই প্রথম।
পরম যত্নে ধীরেন দা নাগা মরিচ গাছের গোরা খুরতে খুরতে বলল -- এই দেখ ; এ গুলো ও নাগা ।
দেখলাম কোনো টার রং লাল কোনো টার রং খয়েরি আবার কোনো টার রং হলুদ ।
অবাক হয়ে বললাম -- এত্ত ; সব নাগা!
ধীরেন দা বলল -- হ্যাঁ ; সব নাগা মরিচ ।
কোথায় কোথায় হয় জানিস ?
মাথা নাড়ালাম-- না ; জানি না।
-- বাংলা দেশ , ভুটান , ভারতের আসাম , নাগাল্যান্ড, মণিপুর ধীরেন দা বলল।
শুধু গাছ চাষ করে না ধীরেন দা ; গাছ সম্বন্ধে প্রচুর জ্ঞান ও রাখে ।
-- জানিস এই নাগা এত ঝাল যে ; খেলে ভূত ছেড়ে পালাবে। তারজন্য এর নাম -- ' ভূত জলোকিয়া '।
বুঝলাম ' ভূত জলোকিয়া ' সত্যি হলেও; ভূত পালানোর ব্যাপার টা মজা করছে!
ধীরেন দা-- সম্পর্কে আমার জামাই বাবু । আমার মাসতুতো দিদির বর । রেলের একজন কর্মচারী হিসাবে রিটায়ার করার পর বাড়ি করেছে কর্ম স্হলের কাছেই ।
আমি আর আমার স্বামী প্রায় যাই দিদির বাড়ি । রেল কোয়ার্টারে যখন থাকত ধীরেন দা তখনও কোয়ার্টারের লাগোয়া এক ফালি বাগানে এমন বিভিন্ন সব্জির চাষ করত। যত বার গেছি কিছু না কিছু সব্জি আমাকে ব্যাগে করে দিয়ে দিত। আমি ও সেই সব্জি আনন্দ করে বাড়ি নিয়ে আসতাম ।
সে বার গেছি দিদির বাড়ি তে-- দেখি গাছ ভর্তি পেঁপে । স্বাস্থ্য বতী গাছে গাঢ় সবুজ রঙের পেঁপে গুলো সব মাটির দিকে তাকিয়ে আছে ।
আমি পেঁপে গাছের দিকে দেখছি দেখে ধীরেন দা বলল -- আজ তোকে ব্যাগ ভর্তি করে পেঁপে দেব ।
আমি কিছু বলার আগেই দিদি বলল -- ধুর ; ও পেঁপে খায় না । ছোট বেলায় মাসি কত জোর করতো; কিছু তেই খেতে চাই তো না । ভাতের সাথে পেঁপে সিদ্ধ করে মেখে জোর করে মুখে গুঁজে দিলে থু থু করে ফেলে দিত।
বললাম-- দিদি, সেই আমি আর আজকের আমি; অনেক তফাৎ।
দিদি বলল-- কি রকম !
আমি বললাম -- পেঁপের এতো সুন্দর তরকারি করে দেব না; মুখে লেগে থাকবে !
ধীরেন দা এতো খন দুই বোনের কথা শুনছিল ।
আমার শেষের কথা টা লুফে নিয়ে বলল -- তোর বিখ্যাত পেঁপের রেসিপি টা বল তো শুনি!
আমি আবার রান্না টা একটু ভালোই করি । আজ কাল নেট ঘাটলে রান্না থেকে কান্না; সব ই পাওয়া যায় । আমার মেয়ে নেট থেকে কি ভাবে রান্না শেখা যায়; দু এক বার আমাকে দেখানোর চেষ্টা করেছে । দেখেছি কিন্তু আমার ভালো লাগে নি । নেটে দেখেছি -- জনৈকা মহিলার মুখ দেখা যাচ্ছে না ; কিন্তু গয়না পরা সুন্দর হাত টা কে এমন করে নাড়াতে নাড়াতে রান্না শেখাচ্ছে ; যেন তোমরা আমার গয়না পরা সুন্দর হাত টা ই দেখ ; রান্না না দেখলেও চলবে!
বিরক্ত হয়ে বললাম -- রাখ তোর ----- স কিচেন ।
দেখবি আমি কেমন ' চিকেন কড়াই ' বানাই!
খাওয়ার পর মেয়ে আঙুল চাটতে চাটতে বলল -- দারুণ মা দারুণ; নেট দুনিয়া ফেল ।
বললাম-- পেঁপের তরকারি করতে বেশি কিছু লাগবে না । সামান্য কাটা আর বাটা পেয়াঁজ, এক চামচ আদা বাটা, টম্যাটো, জিরে আর ধনে গুড়ো, লাল লংকা আর গোল মরিচ গুড়ো, গরম মসলা, তেজ পাতা, কাঁচা লংকা , সামান্য ঘি, পাঁচ ছ টা কাজু বাদাম বাটা, এক চামচ পোস্ত বাটা, দু টো আলু আর একটা পেঁপে ডুমো ডুমো করে কাটা ।
ধীরেন দা বলল-- এত্ত সব ! তাহলে তরকারি তো ভালো হবেই !
দিদি বলল -- তা কেন ! পেঁপের কোনো স্বাদ নেই । স্বাদে ভালো করতে হলে ও টুকু লাগবেই ।
ধীরেন দা বলল -- হয়ে যাক তাহলে আজকেই । দিদি কে সরিয়ে নেমে পর ময়দানে । দেখি তোর হাতের জোর !
খেতে বসে হাত চাট ছিল ধীরেন দা ।
বলল-- হ্যাট্স আফ তোকে । দারুণ । পেঁপের তরকারি যে এমন স্বাদের হয়; এই জানলাম । তোর দিদি কে শিখিয়ে দে ।
আজ আলু তুলেছি । পুরস্কার স্বরূপ এক ব্যাগ আলু আর বেগুন দেব তোকে ।
কিন্তু আজ ধীরেন দা কে দেখে আমার চোখে জল এসে গেল । বিছানায় শুয়ে ধীরেন দা । কাৎরাচ্ছিল । কোমরে ব্যথা । ইসারায় বসতে বলল । পায়ের কাছে বসলাম ।
বললাম-- দিদি, ডাক্তার দেখিয়েছো !
দিদি বলল -- ডঃ সরকার দেখে গেছেন । কয়েক টা টেস্ট করতে বলেছেন । দেখি কি হয়! উনি তো মনে করছেন স্পন্ডিলাইটিসের ব্যথা ।
পেঁপের তরকারি খেয়ে আমাকে আরো একটা জিনিস দিল ধীরেন দা । নাগা মরিচের চারা! পেয়ে খুশি হলাম । আবার শঙ্কিত ও হলাম । পারব আমি এই চারা গাছ কে বড় করতে! আমাদের আসানসোলের বাড়ি তে মাটি নেই। পুরো টা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো । আগেকার দিনের বাড়ি ।
আমার ও একটু গাছ লাগানোর শখ আছে । ধীরেন দা জানতো সে টা । মাঝে মাঝে পরামর্শ ও দিত । আমার সব ফুলের গাছ । টবে বসানো। গোলাপ, জবা, বেলি, গ্যাদা, চন্দ্র মল্লিকা, রজনী গন্ধা । সাধারন মানের সব গাছ । যে টা যখন ফোটার ফোটে । আমার এই ছোট্ট ছাদ বাগান নিয়েই আমি ব্যস্ত থাকি ।
কিন্তু লংকা গাছ! যত্ন করতে পারব তো !
ধীরেন দা বলল -- দেখ নাগার চারা সাধারনত পলি মাটিতে ভালো হয় ।কিন্তু আমি দোঁয়াশ মাটিতেই লাগিয়ে বাঁচাতে পেরেছি । লংকা ও পাচ্ছি । তুইও পারবি ।
বললাম-- আমার তো টব; টবের মাটিতে হবে!
ধীরেন দা বলল-- হ্যাঁ হবে । মাটির সাথে খানিকটা গোবর সার মিশিয়ে দিবি । দেখবি ফন ফনিয়ে বেড়ে উঠবে ।
এ ছাড়া ও ঘরে সার বানিয়ে নিতে পারিস । সারা যত সব্জি কাটিস তার খোসা না ফেলে বালতিতে জমিয়ে রাখবি । কিছু দিন রাখার পর দেখবি; সব পচে সার হয়ে গেছে । সে টা যে কোনো গাছের গোড়ায় দিলে; গাছ খুব দ্রুত বাড়ে এবং ভালো ফল দেয় ।
ঘরে এসে সময় করে লেগে গেলাম টবের পেছনে। পুরো মাটি গুলো ছাদের ওপর ফেলে প্রথমে ঝাঁঝরি দিয়ে ঝেরে নিলাম । তারপর ভালো করে গোবর সার মিশিয়ে দিলাম মাটির সাথে । সার মেশানো মাটি গুলো টবে দিয়ে খানিকটা জল মিশিয়ে; পুরো এক দিন রেখে দিলাম।
দু টো চারার জন্য দুটো টব তৈরি করলাম ।
পরের দিন খুব ভোরে উঠে চারা দু টো কে দুটো টবে পুঁতে দিয়ে গোড়ার চার পাশে জল ছিটিয়ে দিলাম ।
সেপ্টেম্বর মাস ; ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব টা চলে এসেছে । মনে হয় রোঁদে খুব একটা ক্ষতি করবে না ! তবুও আমি বেলার দিকে গিয়ে টব দু টো কে রোঁদ থেকে বাঁচাতে ছায়ায় রেখে এলাম। সন্ধ্যার সময় আবার খানিকটা জল নিয়ে গাছের গোরায় ছিটিয়ে দিলাম।
ধীরেন দা বলে-- সরাসরি গাছের গোড়ায় জল দিবি না । হাত দিয়ে ছড়িয়ে দিবি গাছের গোড়ার চার পাশে।
স্পন্ডিলাইটিস নয়; টেস্টে ধরা পড়েছে বোন ক্যান্সার ।
দিদি বলল-- জানিস ক' দিন ধরে খাওয়া দাওয়া কমে গেছিল। রাতে জ্বর আসছিল। ডাক্তার দেখানোর কথা বললে ; কিছু তেই যেতে চাইত না । ছোট বেলায় জাম গাছ থেকে পড়ে কোমরে চোট পেয়ে ছিল। বিছানায় তিন মাস শুয়ে ছিল । তারপর আর কোনো সমস্যা ছিল না।
বয়স কালে সে টা ই এখন ক্যান্সারে দাঁড়িয়ে গেল।
দিদি কে বড্ড শুকনো লাগছিল। একমাত্র সন্তান বুবুই । রেলের কারখানায় চাকরি করে । বাবাকে খুব যত্ন করছিল।
ধীরেন দা র মুমূর্ষু অবস্থা দেখে চোখের জল আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না।
-- এই দেখ; এই বেগুন টা কে বিটি বেগুন বলে ।
সাদা গোল গোল ভারি সুন্দর দেখতে বেগুন গুলো দেখিয়ে ধীরেন দা বলল ।
আমি টেনে টেনে বললাম-- বে ----- গু ------ন ।
-- সে কি রে! বেগুনের কত পুষ্টি গুন জানিস ! খেয়ে ছিস ডিম দিয়ে বেগুন ভাজা? বেগুন বাহার? আহা শীত কালে এক থালা গরম ভাতের সাথে বেগুন ভাজা আর শিম বেগুন ধনে পাতা দিয়ে রুই মাছের ঝোল । আমার আর কিছু লাগে না; বুঝলি!
-- আমি জানি তুমি নিম - বেগুন ও খেতে খুব ভালো বাসো।
ধীরেন দা র চোখ গুলো চক চক করে উঠল ।
-- অ্যাই, আমার মনের কথা টা বলে ফেলেছিস। খেয়ে ছিস কখনো নিম - বেগুন! তুই তো তিতো ভালো বাসিস না ।
জানি তিতো খেলে শরীরের অনেক উপকার হয় । কিন্তু জ্ঞান পাপী তো! তবে নিম- বেগুন আমিও ভালোবাসি ।
বললাম-- না গো; নিম-বেগুন আমি ও খেতে খুব ভালো বাসি ।
-- আচ্ছা; তোকে এক দিন বেগুন বাহার করে খাওয়াবো। তোর দিদির কাছ থেকে শিখেছি।
অষ্টমী তে অঞ্জলি দেব বলে পাড়ার প্যান্ডেলে গিয়ে ছিলাম।
অঞ্জলি দিয়ে ঠাকুর কে বললাম-- ধীরেন দা কে ভালো করে দাও ঠাকুর !
অনেক খন ধরে মুঠো ফন টা বেজে যাচ্ছে । শুনতেই পাই নি । এই এক অসুবিধা! ফোন টা সর্বদা সাথে সাথে রাখতে হয় । ঘরে ফোন ; রান্না ঘরে আমি । কি করে শুনব!
-- হ্যালো দিদি, ধীরেন দা কেমন আছে?
জানি এ টা একটা জ্ঞিগাসা মাত্র! আমি তো জানি--- ধীরেন দা কেমন আছে!
বিছানার সাথে মিশে গেছে ধীরেন দা । মুখের শুধু যন্ত্রণার আওয়াজ ।
চিন্তাই করতে পারছি না--- যে বাগান ছাড়া আর কিছু জানত না । কোন্ সব্জির চারা কখন লাগাতে হবে; কখন ফুল আসবে; সব জানা ।
কোনো দিন দেখিনি ধীরেন দা ফ্যামিলি নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেছে । দিদি মাঝে মাঝে খুব রাগ করত। বেড়াতে যাওয়া নিয়ে টুকটাক রাগা রাগি ও হত ।
সেই ধীরেন দা বিছানায় শুয়ে!
দিদি বলল-- তোকে সূতীর কাপড় আনতে বলে ছিলাম; এনে ছিস ।
শাড়ি গুলো বাড়িয়ে দিলাম দিদির দিকে।
দিদি বলল-- এখন আর বাথরুমে ও যেতে পারছে না । বিছানাতে ই পেচ্ছাব পায়খানা করে দিচ্ছে । সূতীর কাপড় ভাঁজ করে পড়িয়ে রাখছি । নোংরা হলে খুলে মাটির নিচে পুঁতে দিচ্ছে বুবাই ।
বুবাই বলল -- ঘর সব সময় ফিনাইল দিয়ে ধুতে হচ্ছে । নয়তো গন্ধে টেকা যাচ্ছে না ।
দিদি বলল-- শুয়ে থাকতে থাকতে বেটশোল হয়ে যাবে। আরো কষ্ট বাড়বে ।
ও পাশে দিদি।
বলল-- বোন অঞ্জলি দিয়ে এলি! জানিস আমিও অঞ্জলি দিতে গেছিলাম ।
ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করলাম--
ঠাকুর আমার স্বামী কে তুমি মুক্তি দাও।
বুক টা কেমন মোচার দিয়ে উঠল।
ধীরেন দা আমার দিদির থেকে বেশ খানিকটা বড়। রেলে ভালো পোস্টে চাকরি করত।
ধীরেন দা র সাথে দিদির যখন আলাপ; তখন দিদি ক্লাস নাইনে পড়ে । দিদি বেশ সুন্দর দেখতে ছিল। সব চেয়ে ভালো লাগত ওর ঘন লম্বা চুল গুলি। সেই চুল দেখেই বোধ হয় ধীরেন দা দিদির প্রেমে পড়ে ছিল।
সারা জীবনে দিদি কে এক বার ও চুল কাটতে দেয় নি ।
দিদির যখন আঠার; তখন ওর বিয়ে হয়ে যায় ।
ধীরেন দা র বাবা মা কেউ ছিলেন না । খুব ভদ্র, আর ভালো মানুষ ধীরেন দা ।
ওদের যখন বিয়ে হয়; তখন আমার বয়স সাত কি আট । নিতান্তই বালিকা । ধীরেন দা আমাকে নিজের বোনের মতো দেখত। আমাকে খুব খেপাত।
বলতো-- আমাকে তুই জামাই বাবু ডাকি না কেন ?
আমি বলতাম-- জামাইবাবু আবার কি! তুমি তো আমার দাদা।
মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলত -- হ্যাঁ রে ; আমি তোর দাদা ই। আমাকে ধীরেন দা বলেই ডাকিস।
ধীরেন দা আমাকে দেখে শুনে বিয়ে দিয়ে ছিল।
আসানসোলে যখন আমার বিয়ে ঠিক হল ; তখন অভিমান করে বললাম-- ও তোমরা সবাই এক সাথে থাকবে; আর আমাকে দূর করে দিচ্ছ।
-- দূর করে দিচ্ছি মানে? তুই কি অনেক দূর চলে যাচ্ছিস ! আসানসোল আর কত দূর ! মাঝে মাঝে আসবি । আমরাও যাব। দূরত্ব কমে যাবে!
ধীরেন দা বলল ।
আমি আমার জন্ম ভূমি ছেড়ে থাকতে পারতাম না । সুযোগ পেলেই বার বার ছুটে গেছি বাপের বাড়ি; দিদির বাড়ি । দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে।
-- এই দেখ; এই টা হচ্ছে চায়না রোজ। ধীরেন দা বলল ।
-- অ্যামা, এ টা তো আমার টবে আছে!
-- এই টা দেখ ; এই টা তোর টবে আছে? বীচ বিউটি ।
কি সুন্দর ফুল টা দেখতে! হলদে মাঝে কালচে লাল ।
কত রকমের ফুলের নাম বলে গেল ধীরেন দা । সিক্রেট হার্ট, গোলাপী রঙের । মুটা বিলেস, গোলাপী রঙের; ডবল পাপড়ি । সাধারণত জবা ফুলের পাঁচ পাপড়ি ই হয় । কিন্তু এই জবা ফুলের ডবল পাপড়ি । আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম ।
অনেক খন ধরে ফোন টা বেজে যাচ্ছে । দৌড়ে গিয়ে ধরলাম ।
ও পাশে বুবাই ।
-- মাসি, বাবা কে এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করলাম । অবস্থা ভালো নয় । ডাক্তার বাবু বলছেন -- মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে । মা বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো। কি করব বুঝতে পারছি না!
হঠাৎ আমার মাথা টা ঘুরে গেল । দু চোখে অন্ধকার দেখ ছিলাম । সামনের চেয়ার টা আকরে ধরলাম । আপন জন কে হারানোর আশঙ্কায় মন টা বিমর্ষ হয়ে গেল ।
গাছ পাগল ধীরেন দা ; জ্ঞান নেই। রোগাক্রান্ত শরীর; নিস্তেজ। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ।
পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথে; কারোর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই । কে মা কে বাবা কে স্ত্রী কে পুত্র কে কন্যা; সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে অপেক্ষা মান যাত্রী। যাত্রা কালে যেন বলছে-- " আবার যদি কখনো কোনো কালে দেখা হয়; মনে কি পড়িবে প্রিয়!"
আমি আর এখানে এক মূহুর্তে থাকতে চাই না । হাসপাতালের কড়ি ডোর ধরে হাঁটা লাগালাম। পথ যেন আর শেষ হয় না! বার বার মনে হচ্ছে -- ধীরেন দা জবাব পেয়ে গেছে; ধীরেন দা জবাব পেয়ে গেছে !
দৌড়াতে শুরু করলাম । খুব জোরে একটা হোঁচট খেলাম। পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম । পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল-- " ধীরে হাঁট ; পড়ে যাবি যে !"
মৌসুমী বিশ্বাস
ধীরেন দার বাগানে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম । কত রকমের গাছ ! আলু থেকে শুরু করে কাঁচা লংকা ; কাঁচা লংকা আবার কত রকমের । সব লংকার নামও জানি না ।
ধীরেন দা কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম; কোনো টার নাম বোতাম লংকা , কোনো টার নাম দার্জিলিং লংকা , সূর্য মুখী লংকা । আবার কোনো টার নাম নাগা মরিচ , বোম্বাই মরিচ ।
এতো ধরনের লংকা গাছ দেখে তো আমার চক্ষু চরক গাছ !
আমাকে অবাক হতে দেখে ধীরেন দা বলল -- দেখে ছিস কোনো দিন নাগা মরিচ !
আমি বললাম -- না ; এই প্রথম।
পরম যত্নে ধীরেন দা নাগা মরিচ গাছের গোরা খুরতে খুরতে বলল -- এই দেখ ; এ গুলো ও নাগা ।
দেখলাম কোনো টার রং লাল কোনো টার রং খয়েরি আবার কোনো টার রং হলুদ ।
অবাক হয়ে বললাম -- এত্ত ; সব নাগা!
ধীরেন দা বলল -- হ্যাঁ ; সব নাগা মরিচ ।
কোথায় কোথায় হয় জানিস ?
মাথা নাড়ালাম-- না ; জানি না।
-- বাংলা দেশ , ভুটান , ভারতের আসাম , নাগাল্যান্ড, মণিপুর ধীরেন দা বলল।
শুধু গাছ চাষ করে না ধীরেন দা ; গাছ সম্বন্ধে প্রচুর জ্ঞান ও রাখে ।
-- জানিস এই নাগা এত ঝাল যে ; খেলে ভূত ছেড়ে পালাবে। তারজন্য এর নাম -- ' ভূত জলোকিয়া '।
বুঝলাম ' ভূত জলোকিয়া ' সত্যি হলেও; ভূত পালানোর ব্যাপার টা মজা করছে!
ধীরেন দা-- সম্পর্কে আমার জামাই বাবু । আমার মাসতুতো দিদির বর । রেলের একজন কর্মচারী হিসাবে রিটায়ার করার পর বাড়ি করেছে কর্ম স্হলের কাছেই ।
আমি আর আমার স্বামী প্রায় যাই দিদির বাড়ি । রেল কোয়ার্টারে যখন থাকত ধীরেন দা তখনও কোয়ার্টারের লাগোয়া এক ফালি বাগানে এমন বিভিন্ন সব্জির চাষ করত। যত বার গেছি কিছু না কিছু সব্জি আমাকে ব্যাগে করে দিয়ে দিত। আমি ও সেই সব্জি আনন্দ করে বাড়ি নিয়ে আসতাম ।
সে বার গেছি দিদির বাড়ি তে-- দেখি গাছ ভর্তি পেঁপে । স্বাস্থ্য বতী গাছে গাঢ় সবুজ রঙের পেঁপে গুলো সব মাটির দিকে তাকিয়ে আছে ।
আমি পেঁপে গাছের দিকে দেখছি দেখে ধীরেন দা বলল -- আজ তোকে ব্যাগ ভর্তি করে পেঁপে দেব ।
আমি কিছু বলার আগেই দিদি বলল -- ধুর ; ও পেঁপে খায় না । ছোট বেলায় মাসি কত জোর করতো; কিছু তেই খেতে চাই তো না । ভাতের সাথে পেঁপে সিদ্ধ করে মেখে জোর করে মুখে গুঁজে দিলে থু থু করে ফেলে দিত।
বললাম-- দিদি, সেই আমি আর আজকের আমি; অনেক তফাৎ।
দিদি বলল-- কি রকম !
আমি বললাম -- পেঁপের এতো সুন্দর তরকারি করে দেব না; মুখে লেগে থাকবে !
ধীরেন দা এতো খন দুই বোনের কথা শুনছিল ।
আমার শেষের কথা টা লুফে নিয়ে বলল -- তোর বিখ্যাত পেঁপের রেসিপি টা বল তো শুনি!
আমি আবার রান্না টা একটু ভালোই করি । আজ কাল নেট ঘাটলে রান্না থেকে কান্না; সব ই পাওয়া যায় । আমার মেয়ে নেট থেকে কি ভাবে রান্না শেখা যায়; দু এক বার আমাকে দেখানোর চেষ্টা করেছে । দেখেছি কিন্তু আমার ভালো লাগে নি । নেটে দেখেছি -- জনৈকা মহিলার মুখ দেখা যাচ্ছে না ; কিন্তু গয়না পরা সুন্দর হাত টা কে এমন করে নাড়াতে নাড়াতে রান্না শেখাচ্ছে ; যেন তোমরা আমার গয়না পরা সুন্দর হাত টা ই দেখ ; রান্না না দেখলেও চলবে!
বিরক্ত হয়ে বললাম -- রাখ তোর ----- স কিচেন ।
দেখবি আমি কেমন ' চিকেন কড়াই ' বানাই!
খাওয়ার পর মেয়ে আঙুল চাটতে চাটতে বলল -- দারুণ মা দারুণ; নেট দুনিয়া ফেল ।
বললাম-- পেঁপের তরকারি করতে বেশি কিছু লাগবে না । সামান্য কাটা আর বাটা পেয়াঁজ, এক চামচ আদা বাটা, টম্যাটো, জিরে আর ধনে গুড়ো, লাল লংকা আর গোল মরিচ গুড়ো, গরম মসলা, তেজ পাতা, কাঁচা লংকা , সামান্য ঘি, পাঁচ ছ টা কাজু বাদাম বাটা, এক চামচ পোস্ত বাটা, দু টো আলু আর একটা পেঁপে ডুমো ডুমো করে কাটা ।
ধীরেন দা বলল-- এত্ত সব ! তাহলে তরকারি তো ভালো হবেই !
দিদি বলল -- তা কেন ! পেঁপের কোনো স্বাদ নেই । স্বাদে ভালো করতে হলে ও টুকু লাগবেই ।
ধীরেন দা বলল -- হয়ে যাক তাহলে আজকেই । দিদি কে সরিয়ে নেমে পর ময়দানে । দেখি তোর হাতের জোর !
খেতে বসে হাত চাট ছিল ধীরেন দা ।
বলল-- হ্যাট্স আফ তোকে । দারুণ । পেঁপের তরকারি যে এমন স্বাদের হয়; এই জানলাম । তোর দিদি কে শিখিয়ে দে ।
আজ আলু তুলেছি । পুরস্কার স্বরূপ এক ব্যাগ আলু আর বেগুন দেব তোকে ।
কিন্তু আজ ধীরেন দা কে দেখে আমার চোখে জল এসে গেল । বিছানায় শুয়ে ধীরেন দা । কাৎরাচ্ছিল । কোমরে ব্যথা । ইসারায় বসতে বলল । পায়ের কাছে বসলাম ।
বললাম-- দিদি, ডাক্তার দেখিয়েছো !
দিদি বলল -- ডঃ সরকার দেখে গেছেন । কয়েক টা টেস্ট করতে বলেছেন । দেখি কি হয়! উনি তো মনে করছেন স্পন্ডিলাইটিসের ব্যথা ।
পেঁপের তরকারি খেয়ে আমাকে আরো একটা জিনিস দিল ধীরেন দা । নাগা মরিচের চারা! পেয়ে খুশি হলাম । আবার শঙ্কিত ও হলাম । পারব আমি এই চারা গাছ কে বড় করতে! আমাদের আসানসোলের বাড়ি তে মাটি নেই। পুরো টা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো । আগেকার দিনের বাড়ি ।
আমার ও একটু গাছ লাগানোর শখ আছে । ধীরেন দা জানতো সে টা । মাঝে মাঝে পরামর্শ ও দিত । আমার সব ফুলের গাছ । টবে বসানো। গোলাপ, জবা, বেলি, গ্যাদা, চন্দ্র মল্লিকা, রজনী গন্ধা । সাধারন মানের সব গাছ । যে টা যখন ফোটার ফোটে । আমার এই ছোট্ট ছাদ বাগান নিয়েই আমি ব্যস্ত থাকি ।
কিন্তু লংকা গাছ! যত্ন করতে পারব তো !
ধীরেন দা বলল -- দেখ নাগার চারা সাধারনত পলি মাটিতে ভালো হয় ।কিন্তু আমি দোঁয়াশ মাটিতেই লাগিয়ে বাঁচাতে পেরেছি । লংকা ও পাচ্ছি । তুইও পারবি ।
বললাম-- আমার তো টব; টবের মাটিতে হবে!
ধীরেন দা বলল-- হ্যাঁ হবে । মাটির সাথে খানিকটা গোবর সার মিশিয়ে দিবি । দেখবি ফন ফনিয়ে বেড়ে উঠবে ।
এ ছাড়া ও ঘরে সার বানিয়ে নিতে পারিস । সারা যত সব্জি কাটিস তার খোসা না ফেলে বালতিতে জমিয়ে রাখবি । কিছু দিন রাখার পর দেখবি; সব পচে সার হয়ে গেছে । সে টা যে কোনো গাছের গোড়ায় দিলে; গাছ খুব দ্রুত বাড়ে এবং ভালো ফল দেয় ।
ঘরে এসে সময় করে লেগে গেলাম টবের পেছনে। পুরো মাটি গুলো ছাদের ওপর ফেলে প্রথমে ঝাঁঝরি দিয়ে ঝেরে নিলাম । তারপর ভালো করে গোবর সার মিশিয়ে দিলাম মাটির সাথে । সার মেশানো মাটি গুলো টবে দিয়ে খানিকটা জল মিশিয়ে; পুরো এক দিন রেখে দিলাম।
দু টো চারার জন্য দুটো টব তৈরি করলাম ।
পরের দিন খুব ভোরে উঠে চারা দু টো কে দুটো টবে পুঁতে দিয়ে গোড়ার চার পাশে জল ছিটিয়ে দিলাম ।
সেপ্টেম্বর মাস ; ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব টা চলে এসেছে । মনে হয় রোঁদে খুব একটা ক্ষতি করবে না ! তবুও আমি বেলার দিকে গিয়ে টব দু টো কে রোঁদ থেকে বাঁচাতে ছায়ায় রেখে এলাম। সন্ধ্যার সময় আবার খানিকটা জল নিয়ে গাছের গোরায় ছিটিয়ে দিলাম।
ধীরেন দা বলে-- সরাসরি গাছের গোড়ায় জল দিবি না । হাত দিয়ে ছড়িয়ে দিবি গাছের গোড়ার চার পাশে।
স্পন্ডিলাইটিস নয়; টেস্টে ধরা পড়েছে বোন ক্যান্সার ।
দিদি বলল-- জানিস ক' দিন ধরে খাওয়া দাওয়া কমে গেছিল। রাতে জ্বর আসছিল। ডাক্তার দেখানোর কথা বললে ; কিছু তেই যেতে চাইত না । ছোট বেলায় জাম গাছ থেকে পড়ে কোমরে চোট পেয়ে ছিল। বিছানায় তিন মাস শুয়ে ছিল । তারপর আর কোনো সমস্যা ছিল না।
বয়স কালে সে টা ই এখন ক্যান্সারে দাঁড়িয়ে গেল।
দিদি কে বড্ড শুকনো লাগছিল। একমাত্র সন্তান বুবুই । রেলের কারখানায় চাকরি করে । বাবাকে খুব যত্ন করছিল।
ধীরেন দা র মুমূর্ষু অবস্থা দেখে চোখের জল আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না।
-- এই দেখ; এই বেগুন টা কে বিটি বেগুন বলে ।
সাদা গোল গোল ভারি সুন্দর দেখতে বেগুন গুলো দেখিয়ে ধীরেন দা বলল ।
আমি টেনে টেনে বললাম-- বে ----- গু ------ন ।
-- সে কি রে! বেগুনের কত পুষ্টি গুন জানিস ! খেয়ে ছিস ডিম দিয়ে বেগুন ভাজা? বেগুন বাহার? আহা শীত কালে এক থালা গরম ভাতের সাথে বেগুন ভাজা আর শিম বেগুন ধনে পাতা দিয়ে রুই মাছের ঝোল । আমার আর কিছু লাগে না; বুঝলি!
-- আমি জানি তুমি নিম - বেগুন ও খেতে খুব ভালো বাসো।
ধীরেন দা র চোখ গুলো চক চক করে উঠল ।
-- অ্যাই, আমার মনের কথা টা বলে ফেলেছিস। খেয়ে ছিস কখনো নিম - বেগুন! তুই তো তিতো ভালো বাসিস না ।
জানি তিতো খেলে শরীরের অনেক উপকার হয় । কিন্তু জ্ঞান পাপী তো! তবে নিম- বেগুন আমিও ভালোবাসি ।
বললাম-- না গো; নিম-বেগুন আমি ও খেতে খুব ভালো বাসি ।
-- আচ্ছা; তোকে এক দিন বেগুন বাহার করে খাওয়াবো। তোর দিদির কাছ থেকে শিখেছি।
অষ্টমী তে অঞ্জলি দেব বলে পাড়ার প্যান্ডেলে গিয়ে ছিলাম।
অঞ্জলি দিয়ে ঠাকুর কে বললাম-- ধীরেন দা কে ভালো করে দাও ঠাকুর !
অনেক খন ধরে মুঠো ফন টা বেজে যাচ্ছে । শুনতেই পাই নি । এই এক অসুবিধা! ফোন টা সর্বদা সাথে সাথে রাখতে হয় । ঘরে ফোন ; রান্না ঘরে আমি । কি করে শুনব!
-- হ্যালো দিদি, ধীরেন দা কেমন আছে?
জানি এ টা একটা জ্ঞিগাসা মাত্র! আমি তো জানি--- ধীরেন দা কেমন আছে!
বিছানার সাথে মিশে গেছে ধীরেন দা । মুখের শুধু যন্ত্রণার আওয়াজ ।
চিন্তাই করতে পারছি না--- যে বাগান ছাড়া আর কিছু জানত না । কোন্ সব্জির চারা কখন লাগাতে হবে; কখন ফুল আসবে; সব জানা ।
কোনো দিন দেখিনি ধীরেন দা ফ্যামিলি নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেছে । দিদি মাঝে মাঝে খুব রাগ করত। বেড়াতে যাওয়া নিয়ে টুকটাক রাগা রাগি ও হত ।
সেই ধীরেন দা বিছানায় শুয়ে!
দিদি বলল-- তোকে সূতীর কাপড় আনতে বলে ছিলাম; এনে ছিস ।
শাড়ি গুলো বাড়িয়ে দিলাম দিদির দিকে।
দিদি বলল-- এখন আর বাথরুমে ও যেতে পারছে না । বিছানাতে ই পেচ্ছাব পায়খানা করে দিচ্ছে । সূতীর কাপড় ভাঁজ করে পড়িয়ে রাখছি । নোংরা হলে খুলে মাটির নিচে পুঁতে দিচ্ছে বুবাই ।
বুবাই বলল -- ঘর সব সময় ফিনাইল দিয়ে ধুতে হচ্ছে । নয়তো গন্ধে টেকা যাচ্ছে না ।
দিদি বলল-- শুয়ে থাকতে থাকতে বেটশোল হয়ে যাবে। আরো কষ্ট বাড়বে ।
ও পাশে দিদি।
বলল-- বোন অঞ্জলি দিয়ে এলি! জানিস আমিও অঞ্জলি দিতে গেছিলাম ।
ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করলাম--
ঠাকুর আমার স্বামী কে তুমি মুক্তি দাও।
বুক টা কেমন মোচার দিয়ে উঠল।
ধীরেন দা আমার দিদির থেকে বেশ খানিকটা বড়। রেলে ভালো পোস্টে চাকরি করত।
ধীরেন দা র সাথে দিদির যখন আলাপ; তখন দিদি ক্লাস নাইনে পড়ে । দিদি বেশ সুন্দর দেখতে ছিল। সব চেয়ে ভালো লাগত ওর ঘন লম্বা চুল গুলি। সেই চুল দেখেই বোধ হয় ধীরেন দা দিদির প্রেমে পড়ে ছিল।
সারা জীবনে দিদি কে এক বার ও চুল কাটতে দেয় নি ।
দিদির যখন আঠার; তখন ওর বিয়ে হয়ে যায় ।
ধীরেন দা র বাবা মা কেউ ছিলেন না । খুব ভদ্র, আর ভালো মানুষ ধীরেন দা ।
ওদের যখন বিয়ে হয়; তখন আমার বয়স সাত কি আট । নিতান্তই বালিকা । ধীরেন দা আমাকে নিজের বোনের মতো দেখত। আমাকে খুব খেপাত।
বলতো-- আমাকে তুই জামাই বাবু ডাকি না কেন ?
আমি বলতাম-- জামাইবাবু আবার কি! তুমি তো আমার দাদা।
মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলত -- হ্যাঁ রে ; আমি তোর দাদা ই। আমাকে ধীরেন দা বলেই ডাকিস।
ধীরেন দা আমাকে দেখে শুনে বিয়ে দিয়ে ছিল।
আসানসোলে যখন আমার বিয়ে ঠিক হল ; তখন অভিমান করে বললাম-- ও তোমরা সবাই এক সাথে থাকবে; আর আমাকে দূর করে দিচ্ছ।
-- দূর করে দিচ্ছি মানে? তুই কি অনেক দূর চলে যাচ্ছিস ! আসানসোল আর কত দূর ! মাঝে মাঝে আসবি । আমরাও যাব। দূরত্ব কমে যাবে!
ধীরেন দা বলল ।
আমি আমার জন্ম ভূমি ছেড়ে থাকতে পারতাম না । সুযোগ পেলেই বার বার ছুটে গেছি বাপের বাড়ি; দিদির বাড়ি । দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে।
-- এই দেখ; এই টা হচ্ছে চায়না রোজ। ধীরেন দা বলল ।
-- অ্যামা, এ টা তো আমার টবে আছে!
-- এই টা দেখ ; এই টা তোর টবে আছে? বীচ বিউটি ।
কি সুন্দর ফুল টা দেখতে! হলদে মাঝে কালচে লাল ।
কত রকমের ফুলের নাম বলে গেল ধীরেন দা । সিক্রেট হার্ট, গোলাপী রঙের । মুটা বিলেস, গোলাপী রঙের; ডবল পাপড়ি । সাধারণত জবা ফুলের পাঁচ পাপড়ি ই হয় । কিন্তু এই জবা ফুলের ডবল পাপড়ি । আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম ।
অনেক খন ধরে ফোন টা বেজে যাচ্ছে । দৌড়ে গিয়ে ধরলাম ।
ও পাশে বুবাই ।
-- মাসি, বাবা কে এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করলাম । অবস্থা ভালো নয় । ডাক্তার বাবু বলছেন -- মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে । মা বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো। কি করব বুঝতে পারছি না!
হঠাৎ আমার মাথা টা ঘুরে গেল । দু চোখে অন্ধকার দেখ ছিলাম । সামনের চেয়ার টা আকরে ধরলাম । আপন জন কে হারানোর আশঙ্কায় মন টা বিমর্ষ হয়ে গেল ।
গাছ পাগল ধীরেন দা ; জ্ঞান নেই। রোগাক্রান্ত শরীর; নিস্তেজ। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ।
পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথে; কারোর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই । কে মা কে বাবা কে স্ত্রী কে পুত্র কে কন্যা; সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে অপেক্ষা মান যাত্রী। যাত্রা কালে যেন বলছে-- " আবার যদি কখনো কোনো কালে দেখা হয়; মনে কি পড়িবে প্রিয়!"
আমি আর এখানে এক মূহুর্তে থাকতে চাই না । হাসপাতালের কড়ি ডোর ধরে হাঁটা লাগালাম। পথ যেন আর শেষ হয় না! বার বার মনে হচ্ছে -- ধীরেন দা জবাব পেয়ে গেছে; ধীরেন দা জবাব পেয়ে গেছে !
দৌড়াতে শুরু করলাম । খুব জোরে একটা হোঁচট খেলাম। পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম । পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল-- " ধীরে হাঁট ; পড়ে যাবি যে !"
Comments
Post a Comment